আপনি কি আসলেই কোকাকোলায় আসক্ত | Coca-Cola Bangladesh
বন্ধুবান্ধব বা পারিবারিক কোন দাওয়াত কিংবা প্রিয়জনের সাথে আড্ডা, এক বোতল কোমল পানীয় ছাড়া কোনো আলাপচারিতা বা দাওয়াতই যেন জমেই ওঠে না। কোমল পানীয়ের কথা চিন্তা করলেই বাজারের অন্য সব ব্র্যান্ডের কথা বাদ দিয়ে প্রথম যে নামটি আমাদের মাথায় আসে তা হল কোকা-কোলা।
কোকা-কোলা বিশ্বের অন্যতম পুরনো কার্বনেটেড পানীয় উৎপাদনকারী এবং বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত। অনন্য স্বাদ এবং বিশ্বব্যাপী তাদের মার্কেটিং কৌশলের জন্য তারা আজ এই অবস্থানে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কীভাবে তারা এটা করলো? আর বাংলাদেশে কোকাকোলার যাত্রাই বা কবে থেকে ? কিভাবে দেশের বাজারে কোকাকোলা নিজেদের শক্ত অবস্থান করে নিয়েছিল। এবং আমাদের আজকের ভিডিও শেষ হবে সাম্প্রতিককালে কোকাকোলাকে নিয়ে ঘটা বিতর্ক নিয়ে।
বাংলাদেশে কোকাকোলার ইতিহাস (History of Coca-Cola in Bangladesh)
বাংলাদেশে কোকা-কোলা তাবানি বেভারেজের (TBCL) মাধ্যমে ঢাকায় এবং কে রাহমান-এর মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে ১৯৬২ সালে। সচেতনতার অভাব, পণ্য সম্পর্কে ধারণা না থাকা এবং অপর্যাপ্ত বিপণনের কারণে শুরুতে কঠিন সময় পার করলেও পরবর্তীতে এর ব্যবসায় গতি আসে।
দ্যা কোকা-কোলা কোম্পানি ছয় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। কৌশলগত দিক থেকেও দেশটি কোকা-কোলার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ইউনিটের সমন্বয়ে বাংলাদেশে দ্য কোকা-কোলা সিস্টেম গঠিত। ইউনিটগুলো যথাক্রমে- কোকা-কোলা বাংলাদেশ লিমিটেড (CCBL), ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেড (আইবিপিএল) এবং আব্দুল মোনেম লিমিটেড (AML)।
১৯৮২ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আব্দুল মোনেম লিমিটেড (AML)-এর পানীয় ইউনিট কোকা-কোলার ফ্র্যাঞ্চাইজি বোতলজাতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। কোম্পানিটি ১৯৮৭ সালে কুমিল্লায় তার পূর্ণাঙ্গ বোতলজাতকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করে। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি কোকা-কোলা বাংলাদেশের প্রধান প্রধান বাজারের বোতলজাতকরণ, প্যাকেজিং, বিক্রয় এবং বিতরণের দায়িত্ব পালন করছে। এই ব্র্যান্ডের বয়স যখন ২০ বছর পার হয়, তখন বেশ কিছু স্থানীয় পানীয় বাজারে আসে। ধারণা করা হয় সে সময় আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড তাদের প্রথম কার্বনেটেড পানীয় বাজারে নিয়ে আসে।
এদিকে, কোকা-কোলার পাশপাশি পেপসিকোও দেশে কাজ করছিল। তাই বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাচ্ছিল। সেটা অনেকটা প্রত্যাশিতই ছিল। এক গবেষণায় দেখা যায় যে কোকা-কোলা তার শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৯০ সালের এক রিপোর্টে জানা যায়, টিসিসিসি (কোকা-কোলা কোম্পানির সংক্ষিপ্ত রূপ) বাংলাদেশের বাজারের ৭০% দখল করে অপ্রতিদ্বন্দ্বী কোমল পানীয় ব্র্যান্ডে পরিণত হয়।
২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি, কোকা-কোলা কোম্পানির একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেড দেশে ৭৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ভালুকায় একটি বোতলজাতকরণ কারখানার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে। রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও ঢাকা অঞ্চলের প্রায় ১০ কোটি গ্রাহককে সেবা দিতে আবির্ভাব হয়েছিলো প্রতিষ্ঠান টির। প্ল্যান্ট টি উদ্বোধন করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এ.এম.এ. মুহিত। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। ভালুকায় এই কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসায়ের অগ্রগতি ও স্থানীয় সমাজ বা জনগণের টেকসই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলো কোকাকোলা। কিন্তু বাংলাদেশের উত্তারঞ্চলের প্রায় দশ কোটি মানুষকে সেবা দিয়ে আসা ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজেস প্রাইভেট লিমিটেড বাংলাদেশ International Beverages Private Ltd (IBPL) সম্প্রতি নিজেদের ব্যাবসা গুটিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় রিপোর্ট করা হয়েছে যে, কোকা-কোলা বাংলাদেশ বেভারেজেস লিমিটেড কিনে নিতে চলেছে তুরস্কের কোকা-কোলা আইসেক। ইতিমধ্যেই সাক্ষরিত হয়ে গিয়েছে চুক্তিও। জানা গিয়েছে, সিসিবিবিকে ১৩০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে অধিগ্রহণ করতে চলেছে সিসিআই। তবে কেন এই হস্তান্তর তার কোনও সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে বর্তমানে ফিলিস্তিন – ইসরায়েল যুদ্ধে, ইসরায়েল এর প্রতি কোকাকোলার মৌন সমর্থন এবং আর নানান কারনে বাংলাদেশে ঘূর্নিঝড়ের মতো বয়ে যাওয়া বয়কট কোকাকোলা ক্যাম্পেইন থামাতেই কি এই পদক্ষেপ? জানা গেছে কোকা-কোলা ব্র্যান্ডের পণ্য উৎপাদন, বিতরণ ও বাজারজাত করে থাকা সিসিআই কোম্পানির প্রায় ১১টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে কার্যক্রম রয়েছে। দেশগুলো হলো- তুরস্ক, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, ইরাক, জর্ডান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, পাকিস্তান, সিরিয়া, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান।
২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কোকা-কোলা কোম্পানির আন্তর্জাতিক সংগীতায়োজন কোক স্টুডিওর পর্দা উঠে বাংলাদেশেও। ইউটিউবে নিজেদের চ্যানেলে একলা চলো শিরোনামে প্রকাশিত বাংলা ফিউশান গানটিই কোক স্টুডিও বাংলার প্রথম গান। শুরুতে সফলতা পেলেও বয়কট জোয়ারে ভাটা পড়েছে কোক স্টুডিওর জনপ্রিয়তা তেও। ২০২৩ সালের শেষের দিকে আর্মি স্টেডিয়ামে কোক স্টুডিও কর্তৃক আয়োজিত বিশাল এক কনসার্ট এ দেখা যায়নি দর্শকদের আনাগোনা। বাংলাদেশে কোক স্টুডিওর ( কোক স্টুডিও বাংলা) ভবিষ্যৎও এখন শংকার মূখে।
বাংলাদেশে কোকাকোলার উত্থান ও পতন ( Ups and Down of Coca-Cola in Bangladesh)
ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিন এর ওপর নির্বিচারে হামলা, এবং ইসরায়েল এর প্রতি কোকাকোলার মৌন সমর্থনের কারনে মুসলিম বিশ্বে নিজেদের ব্যাবসা প্রসারে বেগ পেতে হয়েছে কোকাকোলা কে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে শুরু হয় কোকাকোলা বয়কটের ক্যাম্পেইন। এ ধাক্কা কে সামাল দিতে ২০১৬ সালের অন্যতম সেনসেশন বাঁ হাতি কাটার মাস্টার খ্যাত মুস্তাফিজুর রহমানকে কাজে লাগায় কোকাকোলা। ব্যবসার প্রসারে কোকাকোলা মুস্তাফিজুরকে তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন চিত্রে নিয়ে আসে।
২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ইউরোয় রোনালদোর কোকাকোলা কাণ্ডনিশ্চয়ই সবার মনে আছে? সংবাদ সম্মেলনে এসে টেবিলে থেকে কোকাকোলার বোতল সরিয়ে রেখে পর্তুগিজ তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো হাতে পানির বোতল তুলে নেন। সবাইকে আহ্বান জানান, কোকাকোলা পান না করে পানি পান করুন।
এ ঘটনার কারণে কোকাকোলার প্রায় চার বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি! এই ঘটনার পরে আবারও বাংলাদেশে তীব্র সাড়া দিয়ে ওঠে বয়কট কোকাকোলা ক্যাম্পেইন। এই ধাক্কাকে সামলাতে কোকাকলা আবারও ফন্দি আঁটে বিনোদন জগতের তারকাদের নিয়ে। সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনেতা তাহসান রহমান খান এবং সঙ্গীতশিল্পী শায়ান চৌধুরী অর্ণব কে কোকাকোলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ও সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে যুক্ত করে।
কেন কোকাকোলা বয়কট করল বাংলাদেশ? (Why did Bangladesh boycott Coca-Cola?)
গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে নজিরবিহীন হামলা চালানোর পর থেকে দুই পক্ষে যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোকা-কোলাসহ বেশ কিছু পশ্চিমা পণ্য বর্জনের ডাক দেয় সাধারণ মানুষ। ফলে ম্যাকডোনাল্ডস-কেএফসির বিক্রিতে ধস নামে।
ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ায় কোকা-কোলা নিষিদ্ধ করে তুরস্ক।
এ ছাড়া ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ায় তুরস্কের সংসদে নিষিদ্ধ করা হয় বিশ্বখ্যাত কোম্পানি কোকা-কোলা এবং নেসলের পণ্য। গত ৭ নভেম্বর এক বিবৃতিতে পশ্চিমা পণ্য নিষিদ্ধের তথ্য জানায় দেশটির সংসদ। এতে বলা হয়, যেসব কোম্পানি ইসরায়েলকে সমর্থন দেয়, সেসব কোম্পানির পণ্য তুরস্কের সংসদ এলাকার রেস্টুরেন্ট, ক্যাফেটেরিয়া (Cafeteria) এবং চায়ের দোকানগুলোতে বিক্রি করা হবে না।
একই ঘটনা দেখা গেছে বাংলাদেশেও। ইসরাইলকে সমর্থন দেয়ায় বাংলাদেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী কোকাকোলা ও এই কোম্পানির সাথে জড়িত যেকোন পণ্য বা সেবা বয়কটের ডাক দিয়েছেন। কোক স্টুডিও বাংলার আয়োজিত লাইভ কনসার্ট তীব্র নিন্দার শিকার হয়।
বাংলাদেশে এবারই প্রথম নয়। ২০১৩ সালেও ইসরায়েল – ফিলিস্তিন ইস্যুকে কেন্দ্র করে কোকাকোলা এবং পেপসি কোলা বয়কটের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশের জনগন। এরপর ২০২১ এবং সবশেষ ২০২৩ সালে কোকাকোলা বয়কটের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশের বিশাল একটি গোষ্ঠী।
এর আগে ২০২১ সালে ইসরাইল কে সমর্থনের জন্য মালয়েশিয়ার পিপিআইএম নামের একটি মুসলিম গ্রুপের ডাকা বয়কটের ঘটনায় বিপাকে পড়েছিলো সফট ড্রিঙ্কস জায়ান্ট কোকাকোলা।
কোকা-কোলা এবং পেপসির মতো পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলি যখন গাজায় ইসরায়েলি নিপীড়নের বিষয়ে নীরব ছিল, তখন দেশীয় কোলা ব্র্যান্ড মোজো (Mojo Drink)তাদের “সাপোর্ট প্যালেস্টাইন” প্রচারাভিযান শুরু করেছিল। এই উদ্যোগের অধীনে, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত গাজার বেসামরিক লোকদের সহযোগীতায় একটি তহবিলে তারা ১ কোটি টাকা জমা দেয়।
বাংলাদেশের মুসলিম জনগণের ফিলিস্তিনের নির্যাতিতদের জন্য দৃঢ় সংহতি থকার কারণে মোজোর বিক্রি বেড়েছে, এমনটিই বলেছেন, আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড যারা কিনা মোজোরও মালিক। তারা আরো জানিয়েছেন, কোলা সেগমেন্টে গত দুই মাসে মোজোর মার্কেট শেয়ার পাঁচ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে 34% হয়েছে।
অন্যদিকে কোকা-কোলা গত বছর উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে দাম বাড়ালেও এই শীতে তার কিছু কোলার বোতলের দাম কমাতে বাধ্য হয়েছে। এর পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো কোকাকোলা-পেপসি বয়কটের ডাক।
অনেক বিশ্লেষকই ধারণা করছেন, কোকা-কোলা তার নিজস্ব বোতলজাত প্ল্যান্ট তুর্কি ফার্মের কাছে হস্তান্তর করে নিজস্ব বিপণন সমস্যা মোকাবেলা করতে চাচ্ছে। যেহেতু তুর্কি বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুস্লিম দেশ। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেনো বাংলাদেশ এর উত্তারঞ্চলে গড়ে ওঠা কোকাকোলার এই বিশাল প্রতিষ্ঠান কে বিক্রি করে দিতে হলো তুরস্কের কাছে? এর একমাত্র জবাব হতে পারে ফিলিস্তিনি নিপিড়ীত মানুষের প্রতি সংহতি জানিয়ে সারা বাংলার মানুষের বয়কট কোকাকোলা ক্যাম্পেইন।
দর্শক, আজকে এই পর্যন্তই। ফিলিস্তিনে ইসরায়েল এর নির্বিচা্রে গনহত্যা চলাকালীন এই সময়ে বাংলাদেশে কেনো কোকাকোলা নিজেদের স্বত্ত্ব বিক্রি করে দিলো তুরস্কের একটি কোম্পানির কাছে ? আপনাদের মুল্যবান মতামত কমেন্ট বক্স এ জানাতে ভুলবেন না। আমাদের সঙ্গী হওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।