জমি দখল করে বিলাসবহুল প্রজেক্ট! আশিয়ান সিটি | Ashiyan City
“ নে বাবা, তোরা এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমা”
২০০০ থেকে ২০১০ সালের দিকে যাদের বেড়ে ওঠা, মোটামোটি সবার কাছেই এই লাইনটা বেশ পরিচিত। ২০০৬ সালের দিকের একটা টিভি কমার্শিয়াল এর লাইন টা। কমার্শিয়াল্টা ছিল আসিয়ান সিটির। যেখানে দেখা যায় এক বয়স্ক বাবা তার তিন প্রবাসী ছেলে সন্তানের জন্য আসিয়ান সিটিতে তিনটা প্লট কিনে তাদের কাছে তিন বোতল সরিষার তেল কুরিয়ার করে পাঠান। যাতে করে তারা আরাম করে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে।
কিন্তু বাস্তবে পুরো চিত্রটাই আসলে উলটো। আসিয়ান সিটিতে প্লট কিনে আসলে কোন গ্রাহক শান্তিতে নাকে তেল ঘুমাতে পারেন নি। শুধু তাই নয় আসিয়ান সিটি তাদের আশে পাশে থাকা জমির মালিকদের শান্তি করে ঘুমাতে দেয় নি। অবৈধভাবে জমি দখল, ভুয়া জমি, একই প্লট একাধিকবার বিক্রি করা থেকে শুরু করে হামলা এমনকি খুনের মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে এই আসিয়ান সিটি।
প্রিয় পাঠক আমাদের আজকের ব্লগটা একটু অন্যরকম। আমরা আজকে আসিয়ান গ্রুপ নিয়ে তো কথা বলবোই, সেই সাথে কথা বলবো, ভয়ংকর এক ভূমিদস্যু আসিয়ান সিটিকে নিয়েও। তাহলে চলুন ব্লগটি শুরু করা যাক। আশিয়ান গ্রুপ যাত্রা শুরু ২০০৫ সালে। সে সময় তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকার আবাসন মার্কেটটাকে ক্যাপচার করা।
প্রথম দিকে তারা আ্সিয়ান ল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। যদিও পরে তারা আবাসন খাত ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি খাতে তাদের ব্যবসাকে সম্প্রসারন করে। তাই নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আসিয়ান সিটি।এটা তাদের একটা ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প Ashiyan City প্রায় ১২০০ একর জমি নিয়ে গঠিত, যা হজ ক্যাম্প ও উত্তরার পাশেই, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপরীতে অবস্থিত। প্রকল্পটি A থেকে F পর্যন্ত ৬টি ব্লকে বিভক্ত।
পরবর্তী সময়ে আশিয়ান গ্রুপ দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তারা প্রতিষ্ঠা করেছে Ashiyan Medical College এবং Ashiyan Medical College Hospital, যা গুণগত চিকিৎসা ও শিক্ষাসেবা প্রদান করে। এছাড়াও, Rokeya Begum International School & College এর মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছে।
এছাড়াও Ashiyan Food & Beverage Industries Ltd. খাদ্য উৎপাদন শিল্পে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি নানা ধরনের খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন ও বিপণন করে।
সেই সাথে আশিয়ান গ্রুপ বাংলা দৈনিক মানবকণ্ঠ পত্রিকার মালিক ও পরিচালনাকারী, যা বাংলাদেশে একটি জনপ্রিয় পত্রিকা। এছাড়াও, তারা Poisa Bazar Supershop পরিচালনা করে, যা জনগণের খুচরা বাজারের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
প্রিয় পাঠক এতো গেলো আশিয়ান গ্রুপের কিছু ভালো দিকের কথা। এবার আশা যাক আসিয়ান সিটির কালো অধ্যায় নিয়ে। ২০০৬ সালের দিকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পত্রিকার পাতা আর টিভির পর্দা সয়লাব করে আশিয়ান সিটি প্লট বিক্রি করা শুরু করে।
দুদক এর একটা রিপোর্ট থেকে জানা আয় শুধু মাত্র ২০১২ সাল পর্যন্ত আসিয়ান সিটি ৩০-৩৫ লাখ টাকায় পাঁচ কাঠার প্রায় সাড়ে ছয় হাজার প্লট বিক্রি করেছে । মোটে যার পরিমানে দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি। যেই ক্রেতাদের আবার সিংহভাগই প্রবাসী বাংলাদেশী। আসলে নানা কারণে শুরু থেকেই আসিয়ান সিটির টার্গেটে ছিল প্রবাসী বাংলাদেশিরা। কেননা প্রবাসীদের কাছে বেশ ভালো পরিমান অর্থ যেমন থাকতো। তেমনি আবার প্রবাসে অবস্থান করার কারনে নিজে এসে প্লটের কাগজপত্র নিজে ভেরিফাইড করার সুযোগ তেমন একটা ছিল না বললেই চলে। এজন্য অনেকটা আসিয়ান সিটির উপর অন্ধের মতো ভরসা করতে হতো তাদের। আর এই জিনিসটাকেই কাজে লাগায় আসিয়ান সিটি।
দুদকের আরেকটা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় আশিয়ান সিটির যে পরিমাণ জমি আছে, মানুষের কাছে বিক্রি করা হয়েছে তার চেয়ে দশগুণ বেশি জমি। নিজস্ব জমি যেটুকু আছে তার একটা বড় অংশই আবার জোর করে দখল করা। শুধু মানুষের জমি কিংবা বাড়ি নয়। অনেক সময় এমনকি কবরস্থান পর্যন্ত দখল করে প্লট বানিয়েছে আসিয়ান সিটি। দখল করেছে সরকারের খাস জমি ও জলাধারও।
পরবর্তীতে ২০১২ সালে আটটি পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠনের করা এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট আশিয়ান সিটি প্রকল্পকে অবৈধ বলে রায় দেয়। পরে হাইকোর্টেরই আরেকটি রিভিউ বেঞ্চ প্রকল্পটিকে বৈধ ঘোষণা করলে রিট আবেদনকারীরা আপিল বিভাগে যায়। এদিকে আবার আপিল বিভাগ ২০১৭ সালের আগস্টে হাইকোর্টের রিভিউ বেঞ্চের রায়ে স্থগিতাদেশ দিয়ে আশিয়ান সিটির সব ধরনের কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
শুধু তাই নয় প্রবাসী বাংলাদেশীদের সহজে টার্গেট করতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে আবাসন মেলারও আয়োজন করা হতো আর এতে প্রবাসীরা আকৃষ্টও হতো। আশিয়ান সিটি প্লট মালিক সমবায় সমিতি থেকে জানা যায় প্রায় ৮০ ভাগ প্লটই কিনেছেন প্রবাসীরা।
এছাড়াও জানা যায়, তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে, ২০০৫ সালে প্রকল্পের জন্য রাজউক ও ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে ৪৩ একর জমির অনুমোদন নেয় আশিয়ান সিটি। পরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জমির পরিমাণ ১,১৯৭ একর করে রাজউক ও জেলা প্রশাসনের অনুমোদন নেয়া হয়। তবে বাস্তবে আসলে এই পরিমাণ জমির অস্তিতই ছিল না। অর্থ্যাত আশিয়ান সিটি ক্রেতাদের কাছ বহু কাল্পনিক প্লট বিক্রি করেছে।
এখানেই শেষ নয় ,জানা যায় এখন অব্দি আশিয়ান সিটির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে অর্ধ শতাধিক মামলা হয়েছে রাজধানীর খিলক্ষেত ও উত্তরা থানায়। কিন্তু কোনো মামলাতেই এখন পর্যন্ত চার্জশীট দেয়নি পুলিশ। এর বাইরে আদালতে মামলা হয়েছে ১৫টি। পুলিশকে এসব মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয় আদালত। এগুলোরও কোনো তদন্ত প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত দাখিল করেনি পুলিশ।
প্রিয় পাঠক এতকিছুর পরও আসলে আসিয়ান সিটির সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ হয় নি। জানা যায় গত ২৭ ডিসেম্বর অবৈধভাবে আশিয়ান সিটির জমি দখল, সীমাহীন প্রতারণা, জালিয়াতি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের প্রতিবাদে খিলক্ষেত থানার বড়ুয়া দক্ষিণ পাড়ার বাসিন্দা আনোয়ারা মায়া সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে সেগুনবাগিচায় ঢাকা রির্পোর্টাস ইউনিটিতে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। পরে তাকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। এ হামলা উপেক্ষা করে আসিয়ান সিটির দখল দারিত্বের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন আনোয়ারা মায়ার মেয়ে। তিনি তার মায়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান।
এছাড়াও গত ১৫ জানুয়ারি খিলক্ষেতে, জমি দখলে বাধা দেওয়ায় আসিয়ান সিটির ১০ থেকে ২০ জন সন্ত্রাসী ধারালো অস্ত্র নিয়ে স্থানীয়দের উপর হামলা করে। এতে করে একজন নিহত এবং বাকি কয়েকজনকে আশাংকাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই ঘটনার এখন অব্দি কোন বিচার হয় নি। এমনকি এখন অব্দি আসিয়ান সিটি তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
যাই হোক , প্রিয় পাঠক আমাদের বিজনেস ম্যানিয়ার আজকের ব্লগটি এই অব্দি। ব্লগটি ভালো লাগলে আমাদের জানাতে ভুলবেন না। সেই সাথে লাইক কমেন্ট আর শেয়ার করে আমাদের সাথেই থাকবেন। আর কি কি বিষয়ের উপর ব্লগ পড়তে চান তাও জানাবেন।