Ratan Tata’র ফিরে আসার গল্প । Success Story of India’s Business King
৯০-এর দশকের ঘটনা, যখন টাটা সন্সের (Tata Sons) চেয়ারম্যান রতন টাটার নেতৃত্বে টাটা মোটরস তার গাড়ি টাটা ইন্ডিকা চালু করেছিল। কিন্তু, সেই সময়ে রতন টাটার আশা অনুযায়ী টাটার গাড়ি বিক্রি হচ্ছিল না। টাটা ইন্ডিকা নিয়ে খারাপ রেসপন্স এবং ক্রমাগত লোকসানের কারণে, তিনি প্যাসেঞ্জার কার বিজনেস বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং এর জন্য তারা আমেরিকান গাড়ি নির্মাতা ফোর্ড মোটরসের (Ford Motor) সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
ফোর্ডের চেয়ারম্যান বিল ফোর্ডের (বিল ফোর্ড) সঙ্গে সাক্ষাত করেন যখন রতন টাটা তার প্যাসেঞ্জার কার ব্যবসা ফোর্ড মোটরসের কাছে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন ফোর্ড চেয়ারম্যান বিল ফোর্ড তাকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন যে, “আপনি যদি কিছুই না জানেন , তবে আপনি কেন প্যাসেঞ্জার কার ডিভিশন শুরু করলেন? ” তারপর বিল আরো বলেন, “আমরা যদি আপনার এই ব্যবসা কিনি তাহলে আপনার উপকার করা হবে।” বিল ফোর্ডের এই কথাগুলো রতন টাটার হৃদয় ও মনে গেঁথে গিয়েছিল, কিন্তু তার স্বভাব অনুযায়ী তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাননি এবং ভারতে ফিরে আসেন।
এর পর কি হয়েছিল সে কথায় পরে আসছি।
তার আগে জেনে নেই টাটা গ্রুপের কর্নধার রতন টাটা সম্পর্কে যিনি ১৯৯১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন। যিনি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে শুধু ভারত নয়, পরিচিত ছিলেন সারা বিশ্বে ।
১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর নাভাল এবং সুনি টাটার ঘরে তাঁর জন্ম হয় । রতন টাটার বয়স যখন মাত্র ১০ বছর তখন তার মা – বাবা আলাদা হয়ে যান। সাত বছরের ছোটো ভাই জিমিকে নিয়ে তখন তিনি অথৈ সাগরে পড়েন। ওই দুরবস্থায় দুই ভাইয়ের দেখাশোনা করতেন তাদের দাদী নাভাজবাই টাটা।
রতন টাটা মুম্বাইয়ের কেম্পিয়ন স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পরে তিনি ক্যাথেড্রাল অ্যান্ড জন কনন স্কুল-এ স্কুল শিক্ষা শেষ করেন। স্কুল শিক্ষা শেষ করার পর তিনি ১৯৬২ সালে কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ট্রাকচার ইঞ্জিনিয়ারিং ও আর্কিটেচার বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন । ১৯৭৫ সালে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়তে বাণিজ্য ও অ্যাডভেঞ্চেড ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন।৷ শুনলে হয়তো অবাক হবেন, এক সময় টাটা গ্রুপে চাকরি পেতে নিজের বায়োডেটা জমা দিতে হয়েছিল খোদ রতন টাটাকে। ভারতে ফিরে রতন টাটা প্রথমেই টাটা গ্রুপে যুক্ত হননি, বরং তিনি যোগ দিয়েছিলেন IBM -এ। প্রথমদিকে তাঁর পরিবারের কেউ এ বিষয়ে জানতেনও না। কিন্তু পরবর্তীতে টাটা গ্রুপের তৎকালীন চেয়ারম্যান জেআরডি টাটা বিষয়টি জানতে পেরে রীতিমতো অবাক হন ও সরাসরি রতন টাটাকে ফোন করে জানান, ‘IBM এ কাজ করার জন্য তুমি ভারতে আসোনি।’ এরপরেই টাটা গ্রুপে চাকরির জন্য নিজের একটি বায়োডেটা জমা দিতে বলা হয় রতন টাটাকে। কিন্তু সেই সময় নিজের বায়োডেটা ছিল না তাঁর কাছে। তাই তিনি আইবিএম অফিসে একটি বৈদ্যুতিক টাইপরাইটারে টাইপ করে নিজের বায়োডেটা জমা দিয়েছিলেন। এরপর 1962 সালে রতন টাটা, টাটা গ্রুপে চাকরি পান। এমন নয় যে, টাটা গ্রুপে যোগদানের পর প্রথমেই শীর্ষপদে আসীন হন রতন টাটা। বরং পরিবারের একজন হওয়া সত্ত্বেও সব কাজের অভিজ্ঞতার পর ধীরে ধীরে কোম্পানির শীর্ষপদে পৌঁছান রতন টাটা। 1991 সালে, রতন টাটা টাটা সন্স এবং টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। তখন অনেকেই তার সমালোচনা করেন। সব সমালোচককে ভুল প্রমাণিত করে ২১ বছর ধরে সুদক্ষ হাতে তিনি টাটা গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে বিশ্বের 100টি দেশে টাটা গ্রুপের বিস্তার ঘটে। আবার রতন টাটার নেতৃত্বেই টেটলি টি, জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার এবং কোরাস অধিগ্রহণ করেছিল টাটা গ্রুপ।
এবার ফিরে আসা যাক শুরুর দিকের গল্পে, বিল ফোর্ডের সেই বিদ্রুপ এর জবাব দিতে ভারত ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি একটি বড় সিদ্ধান্ত , তিনি প্যাসেঞ্জার কার ব্যবসা বিক্রির সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন এবং তারপরে ভারতের অটোমোবাইল সেক্টরে বিপ্লব আনার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে ব্যর্থতা সাফল্যের একটি চাবিকাঠি । তিনি তার পুরো মনোযোগ টাটা মোটরসকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন এবং এক দশকেরও কম সময়ে, তিনি নিজেকে এই সেক্টরের রাজা বানিয়ে ফোর্ডের দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ নেন যা সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এই ঘটনার পর ৯ বছর পেরিয়ে যায় এবং এই বছরগুলিতে, টাটা মোটরস নতুন উচ্চতা স্পর্শ করতে এগিয়ে চলে যখন ফোর্ড মোটরস দেউলিয়া হওয়ার পথে। এই সময়ে, রতন টাটার গ্রুপ ফোর্ডের জাগুয়ার এবং ল্যান্ড রোভার ব্র্যান্ড কেনার প্রস্তাব দেয়। এই চুক্তি নিয়ে যখন রতন টাটা এবং বিল ফোর্ডের মধ্যে বৈঠক হয়েছিল, তখন ফোর্ডের চেয়ারম্যান বিল ফোর্ডের সুর বদলে গিয়েছিল। তিনি এই প্রস্তাবের জন্য রতন টাটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আপনি জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভার কিনে আমাদের একটি বড় উপকার করছেন।
টাটা সাম্রাজ্যের অধিপতি রতন টাটা জীবনে একের পর এক মাইলফলক ছুঁলেও, একা একাই কাটিয়ে দিয়েছেন এতগুলি বছর। একাধিক বার জীবনে সম্পর্ক এলেও, পরিণয়সূত্রে বাঁধা পড়া হয়নি তাঁর। তা নিয়েও খোলামেলা তিনি।একটি সাক্ষাৎকারে রতন টাটাকে বলতে শোনা যায়, “চার-চার বার বিবাহবন্ধনে প্রায় আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোনও না কোনও কারণে, কিছু না কিছু আতঙ্ক কাজ করেছে মনে। প্রতি বারই তাই পিছিয়ে এসেছিলাম।” জানা যায়, আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসে একবার এক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রতন টাটার। বিয়েও করবেন বলে ঠিক করে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় ফিরে আসতে হয় তাঁকে। কিন্তু তাঁর জীবনের সেই নারী ভারতে আসতে পারেননি। পরিবারের আপত্তি থাকায় রতন টাটাকে বিয়ে করেননি বলে জানিয়েছিলেন শিল্পপতি নিজেই।
রতন টাটার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন অভিনেত্রী সিমি গরেওয়ালও। সিমির একটি চ্যাট শো-তেও হাজির হন রতন টাটা।
রতন টাটার বিয়ে না করার কারণগুলো ব্যক্তিগত হলেও এ নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। অনেকেই মনে করেন, শৈশবের কিছু ঘটনা তাঁর জীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, দত্তক বাবার ঘরে বেশি দিন মায়ের সঙ্গে থাকতে পারেননি শিশু রতন টাটা। রতন টাটার বাবা নাভাল টাটা কিন্তু টাটা পরিবারে এসেছিলেন একজন দত্তক হিসেবে। প্রথম স্ত্রী সোনির ঘরে জন্ম হয় রতন টাটার। রতন টাটার বয়স যখন ১০ বছর, তখন মা–বাবার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। রতন টাটা ও সাত বছরের ছোট ভাই জিমি দাদির কাছে মানুষ হতে থাকেন। শিশু বয়সে বেশ মানসিক কষ্ট নিয়ে বেড়ে ওঠেন দুই ভাই। বাবার সঙ্গে মায়ের ছাড়াছাড়ির বিষয়টি দুই ভাই মেনে নিতে পারেননি। মা–বাবার তিক্ত সম্পর্কের সাক্ষী ছিলেন রতন টাটা। আর এটাই সংসারজীবন সম্পর্কে তাঁকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। পাশাপাশি বিয়ে তাঁর জীবনের জন্য একটি ভীতিকর বিষয় হয়ে উঠেছিল । আর এই ভীতির কারণেই তাঁর জীবনে সাজনাতলার অভিজ্ঞতা হয়নি। জীবন, সংসার—টাটা গ্রুপই তাঁর জন্য সবকিছু।
দেশের অন্যতম বড় শিল্পপতি। শুধু দেশ বলি কেন, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও তাঁর পা পড়েছে। দেশ-বিদেশের অজস্র শিল্পপতির তথা উঠতি তরুণের কাছে আদর্শের জায়গাও তিনি। তাঁর কথা শোনা যায়, বিশ্বের ধনীতমের মুখেও। রতন টাটার অভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধির প্রশংসা করেন এলন মাস্ক ( Elon Musk) নিজে।একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, টাটা দেশের ধনীতমদের মধ্যে ৪৩৩ নম্বরে। তাঁর আগে আরও ৪৩২ জন। কিছুটা অবাকই হতে হয়– যে সংস্থা এতদিনের পুরনো– যে সংস্থার চেয়ারম্যান দেশ তথা বিদেশের এত বড় একজন শিল্পপতি– তিনি কী ভাবে সম্পদের তালিকায় এতটা নিচের সারিতে থাকতে পারেন? টাটাদের একাধিক সংস্থার মালিক বিভিন্ন চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ।ব্যক্তি রতন টাটার হাতে অতি অল্প সংস্থারই মালিকানা হয়েছে। এছাড়া, রতন টাটা নিজেও নানারকম সেবামূলক কাজ করে থাকেন। তাই দান-ধ্যানের স্বভাব তাঁরও কিছু কম নেই। সেই কারণে, সম্পত্তির বড় অংশই তিনি দান কার্যে উৎসর্গ করে থাকেন। রতন টাটার বর্তমান সম্পত্তির পরিমাণ ৩৫০০ কোটি টাকা। বর্তমানে ভারতীয় শিল্পমহলে তাঁর সমকক্ষ গৌতম আদানি বা মুকেশ আম্বানির সম্পত্তির পরিমাণ সেখানে অনেকটা বেশি।
সারা ভারতে যে গুটিকয়েক শিল্পপতি নিজের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে কাজ করে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে নাম রয়েছে রতন টাটার। তিনি ফোর্বসের ধনী তালিকায় স্থান পান না বটে, তবে জায়গা করে নিয়েছেন সমগ্র আ আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসীর মনে। তিনি শুধুমাত্র ব্যবসায়ী হিসেবে যে দেশবাসীর মনে জায়গা পেয়েছেন এমন নয়।তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি দেশ ও বিশ্বে টাটা গ্রুপকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। তিনি সবসময় নিজেকে মাটির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের তালিকাতেই রেখেছেন।
ভারতীয় শিল্পপতি তথা টাটাগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান এমিরেটাস রতন টাটার বিকল্প পাওয়া কঠিন। সিঙ্গুর আন্দোলনও কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি তাঁর ভাবমূর্তিতে। অন্য শিল্পপতিদের সাথে তাঁর পার্থক্য এখানেই। ধনকুবেরদের অদ্ভুদ অনেক নেশা থাকে। বিশেষ করে নিজে পাইলটের আসনে বসে আকাশযান চালানোর নেশা থাকে অনেকে বিজনেস আইকনের। কিন্তু এক্ষেত্রেও রতন টাটা যেন অন্য সবার চেয়ে ব্যাতিক্রম। তিনি অন্যদের মত বেসামরিক উড়োজাহাজের পাশাপাশি চালিয়েছেন সামরিক ফাইটার প্লেন। ২০০৭ সালে প্রথম ভারতীয় পাইলট হিসেবে তিনি মার্কিন F-16 ফ্যালকন যুদ্ধবিমান ওড়ানো প্রথম ভারতীয় পাইলট ঘোষিত হন। রতন টাটা শুধু একজন শিল্পপতিই নন, একজন পথপ্রদর্শক, একজন আইডল।
কেমন লাগলো আমাদের আজকের ব্লগটি? কমেন্টে অবশ্যই জানাতে ভুলবেন না। ভালো লাগলে লাইক দিন নিউজলেটার , সাবস্ক্রাইব করুন এবং শেয়ার করুন সবার সাথে।