Vanguard Group : বিশ্ব অর্থনীতির আসল গডফাদার । Vanguard in Bangla
আচ্ছা যদি প্রশ্ন করি যে, বিগত ৫০ বা ৬০ বছর ধরে কে বা কারা গোটা পৃথিবীটার উপর ছড়ি ঘুড়িয়ে যাচ্ছে? জানি, খুব সোজা একটি প্রশ্ন, বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই মুহূর্তেই বলে উঠবেন “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র” (United States) ! কিন্তু বসের উপরও তো বস থাকে, তাই না ! তেমন ই দুটি বস হচ্ছে ওয়ার্ল্ড মোস্ট লার্জার মানি ম্যানেজার কোম্পানি “ব্ল্যাক রক এবং ভ্যানগার্ড”। এই দুই পাপেট মাস্টার সিকরেটলি কন্ট্রোল করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সহ তামাম দুনিয়াটাকে। তার মধ্যে একটি ব্ল্যাক রক, যেটি নিয়ে আমরা আমাদের আগের একটি ভিডিও তে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। চাইলে আপনারা ভিডিও টি দেখে আসতে পারেন। তাই আজ আমরা কথা বলব শুধু ভ্যানগার্ডকে নিয়ে।
আপনি যদি গুগল এ Top 10 shereholder company লিখে সার্চ দেন তবে ভ্যানগার্ড এর নাম সবার উপরে দেখতে পাবেন। দারুণ অর্থনৈতিক উত্থানের দুই দশক পেরিয়ে ১৯৯৯ সালের দিকে আমেরিকার অর্থনীতি নতুন সম্ভাবনার পথে হাটা শুরু করে এই ভ্যানগার্ড এর হাত ধরেই। অথচ ২০ বছর আগেও যেটা ছিলো টোটালি অকল্পনীয় একটা বেপার। ১৯৭৫ সালে, যখন ভ্যানগার্ড তার যাত্রা শুরু করেছিলো এমন একজন নাবিকের দক্ষ পরিচালনায়, যার ছিল আনলিমিটেড এমবিশন। তার নিছক ইচ্ছাশক্তি আর অসাধারণ মেধার বলে এক বিশাল বড় ফাইন্যান্সিয়াল এমপায়ার দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। তিনি জন ভোগল (John C. Bogle)।
1929 সালে জন্মগ্রহণ করা জন ভোগাল (John C. Bogle) যিনি কিনা পৃথিবীর বেশিরভাগ বাঘা বাঘা কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার, তার ই পরিবার কিন্তু 1929 সালের স্টক মার্কেট দুর্ঘটনায় তাদের বেশিরভাগ সম্পদ হারিয়েছিল। ভোগল তার কর্মজীবনের প্রথম দিকে, 1951 সালে ওয়েলিংটন ম্যানেজমেন্টে কোম্পানিতে যোগদান করেন এবং এক সময় ওয়েলিংটনের (Wellington) চেয়ারম্যানও হন। কিন্তু হঠাৎ করেই কোম্পানিটি মানুষের মাঝে তার আকর্ষণ হারাতে শুরু করে। এবং বেশ বাজে ভাবে ডাউন ফল করতে শুরু করে। এই খারাপ অবস্থা থেকে কোম্পানিকে বাঁচাতে ভোগল তাই অন্য আরেকটি কোম্পানির সাথে এটিকে মার্জ করার সিদ্ধান্ত নেন যার ফলাফল ছিলো শোচনীয়। আর এই সিদ্ধান্তের কারণেই ওয়েলিংটন ম্যানেজমেন্টে কোম্পানি থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়।
এরপর তিনি 1974 সালে তার নিজস্ব মিউচুয়াল ফান্ড কোম্পানি ভ্যানগার্ড (Vanguard) গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন।
ভ্যানগার্ড এর মাধ্যমে ভোগল এমন একটি অভিনব মালিকানা কাঠামো তৈরি করেছিলেন যেখানে মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ারহোল্ডাররা যেই তহবিলগুলিতে বিনিয়োগ করেছিলেন সেই অংশের ই মালিক হয়েছিলেন। অর্থাৎ তহবিলগুলি নিজেরাই বিনিয়োগ সংস্থার মালিক। ভ্যানগার্ড তহবিল বিনিয়োগকারীদেরকে নিজেই সংস্থার পরোক্ষ মালিক করে তোলে। এই কাঠামো ফার্মকে তার অপারেটিং কাঠামোতে যেকোনো মুনাফা অন্তর্ভুক্ত করার অনুমতি দেয়। এর ফলে এটি তহবিল বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগের খরচ কমিয়ে দেয়। ফলে ভ্যানগার্ড স্বল্প খরচের বিনিয়োগের রাজা বনে যায়। এর শেয়ার ক্রয় এবং ধরে রাখা বিনিয়োগকারীদের এবং অবসর গ্রহণকারীদের কাছে বেশ লাভজনক মনে হতে থাকে।
S&P 500 Index, বা Standard & Poor’s 500 Index, যা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 500টি নেতৃস্থানীয় পাবলিকলি ট্রেড করা কোম্পানির market-capitalization-weighted index। 1976 সালে, ভোগল ভ্যানগার্ড 500 তহবিল প্রবর্তন করে, যা এই S&P 500-এর রিটার্ন ট্র্যাক করে এবং খুচরা বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করা প্রথম সূচক তহবিল হিসাবে চিহ্নিত করে। ভ্যানগার্ড তার প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ প্রথম আন্ডাররাইটিংয়ে মাত্র 11 মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছিল৷ কিন্তু বর্তমানে, তহবিলটি 8 Trillion Dollar এর ও বেশি সম্পদ পরিচালনা করছে ৷ এখন পর্যন্ত এর 203টি মার্কিন তহবিল এবং 227টি আন্তর্জাতিক তহবিল রয়েছে৷ ফার্মটির 50 মিলিয়নেরও বেশি বিনিয়োগকারী রয়েছে। ভ্যানগার্ড বিশ্বের বৃহত্তম বন্ড তহবিলগুলির মধ্যে একটি।
আসলে বেশ অনাড়ম্বর ভাবে ওয়েলিংটন ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (Wellington Management Company) ছেড়ে দেওয়ার পরে, জ্যাক ভোগল একটি আর্থিক সাম্রাজ্য তৈরি করতে শুরু করেন, যা বিশ্ব এর আগে কখনও দেখেনি। অটল সংকল্পের সাথে, তিনি ভ্যানগার্ড তৈরি করেন। এটিকে একটি বিপ্লবী কোম্পানি ই বলা যায়, যা সকল প্রচলিত ধারনাকে অস্বীকার করে একটি বিস্ময়কর $ 8 ট্রিলিয়ন মূল্যের সম্পদ পরিচালনা করে আমেরিকার প্রধান আর্থিক পরাশক্তি হিসাবে তার স্থানকে মজবুত করেছে।
ভ্যানগার্ডের এই বিশাল তহবিলের মালিক আসলে কে?
এক কথায় সবাই। কোম্পানিটি তার সদস্যদের তহবিলের মালিকানাধীন, বা ফান্ড শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানাধীন। সোজা কথায়, ফান্ডের শেয়ারহোল্ডাররা ভ্যানগার্ডের মালিক। ভ্যানগার্ডের শেয়ারহোল্ডারদের ছাড়া অন্য কোনও বাইরের বিনিয়োগকারী নেই৷ তো কারা এই শেয়ার হোল্ডার? মূলত ভ্যানগার্ড এর কাস্টমাররাই এর শেয়ার হোল্ডার। ভ্যানগার্ড তার বেশিরভাগ তহবিলের দুটি শ্রেণী অফার করে: বিনিয়োগকারী শেয়ার এবং অ্যাডমিরাল শেয়ার। বিশ্বব্যাপী ৫0 মিলিয়নেরও বেশি ভ্যানগার্ড বিনিয়োগকারী রয়েছে।
ভ্যানগার্ডের প্রাথমিক আয়ের উৎস হল এই বিনিয়োগ তহবিল এবং অ্যাকাউন্টগুলি পরিচালনার জন্য চার্জ করা ফি-গুলি। অর্থাৎ এটি ম্যানেজমেন্ট ফি (management fee), অ্যাডভাইজরি ফি (advisor fee) এবং এর বিনিয়োগ পণ্য ও পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত প্রশাসনিক ফি-এর মাধ্যমে রাজস্ব তৈরি করে। তবে এই ফিগুলি কিন্তু ব্যবস্থাপনার অধীনে সম্পদের শতাংশ এবং নির্দিষ্ট তহবিল বা অ্যাকাউন্টের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। তাছাড়া, ভ্যানগার্ড সিকিউরিটিজ ধার প্রোগ্রাম এবং সিকিউরিটিজ ধার ফি এর মাধ্যমেও আয় করে।
অর্থাৎ ব্ল্যাক রকের মত কোন একক ব্যক্তি এর মালিক নয়। ব্ল্যাক রকের মত ভ্যানগার্ডের রাজনৈতিক ইনফ্লুয়েন্স খুব একটা নেই, আবার একেবারেই যে নেই তাও বলা যায় না। তবে অর্থনৈতিক প্রভাব অবশ্যই আছে। বর্তমানে সারা পৃথিবীর প্রায় ৯০ টি কোম্পানিতে ভ্যানগার্ডের শেয়ার আছে। ফেসবুক (Facebook), গুগোল (Google), এমাজন (Amazon), মাইক্রোসফট (Microsoft), এপল (Apple), ডিজনি (Disney), নেসকাফে (Nescafe), কোকাকোলা (Coca-Cola), পেপসি (Pepsi) কোথায় নেই তাদের ইনভেস্টমেন্ট? বরং প্রতিটি কোম্পানিতে ব্ল্যাক রকের চাইতে ভ্যানগার্ডের ইনভেস্টমেন্ট ই বেশি। তবে মজার বিষয় কি জানেন? যেই ব্ল্যাক রক গোটা পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ সম্পদের মালিক, সেই ব্ল্যাক রকেরও ১২% শেয়ার ভ্যানগার্ডের দখলে।
বিনোদন, খাদ্য, পোশাক, অস্ত্র, ওষুধ, সব জায়গায় নিজেদের সম্পদ তৈরি করে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত তিন ক্যালেন্ডার বছরে, বিনিয়োগকারীরা ভ্যানগার্ড তহবিলে 823 বিলিয়ন ডলার রেখেছে। বাকি মিউচুয়াল ফান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাথে তুলনা করলে সেই ইনফ্লোটির স্কেল বেশ বড়ই। মোট 4,000 টিরও বেশি মানি ম্যানেজমেন্ট ফার্ম রয়েছে। মর্নিংস্টার (Morningstar) এর ডেটা অনুযায়ী ফার্মগুলি সব মিলে সেই সময়ের মধ্যে মাত্র 97 বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। অন্যদিকে ভ্যানগার্ড তার সমস্ত প্রতিযোগীদের তুলনায় প্রায় সাড়ে আট গুণ বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছে। ইনডেক্স তহবিল বিনিয়োগের জয় মানে ভ্যানগার্ডের ব্যবসায়ীরা অ্যাপল, মাইক্রোসফট এবং অ্যামাজনের মতো স্টকগুলিতে প্রতিদিন 2 বিলিয়ন ডলারের মতো ফানেল করে, সেইসাথে হাজার হাজার ছোট কোম্পানিও রয়েছে, যারা ফার্মের তহবিল ট্র্যাক করে।
নিঃসন্দেহে, কর্পোরেট সিদ্ধান্তের উপর BlackRock এবং Vanguard এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।. যা রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার উপরও পরোক্ষ ভাবে প্রভাব ফেলে। এটা লক্ষণীয় যে ভ্যানগার্ড গ্রুপ হল BlackRock-এর বৃহত্তম স্টেকহোল্ডার। ভ্যানগার্ডের $7.25 ট্রিলিয়নের তুলনায় বিশ্বব্যাপী $8.59 ট্রিলিয়ন মোট সম্পদের সাথে BlackRock সামগ্রিকভাবে বৃহত্তম ফার্ম হিসাবে রয়ে গেছে। এবং উভয়ই দাবি করে যে তারা তাদের মালিকদের জন্য মুনাফা অর্জনকে অগ্রাধিকার দেয় কারণ এটি একটি সর্বজনীনভাবে ব্যবসা করা ফার্ম। সরকারের স্পন্সর অবসর পরিকল্পনা এবং সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের মতো ক্লায়েন্টদের সাথে এটির যথেষ্ট বড় পদচিহ্ন রয়েছে। ব্ল্যাক রক এবং ভ্যানগার্ড ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ পরিচালনা করে, তো সে অনুযায়ী তাদের কর্পোরেট সিদ্ধান্তের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব তো থাকবেই। যদিও তারা স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে না বলে দাবি করে। তাদের উল্লেখযোগ্য শেয়ার হোল্ডিংগুলি তাদের কর্পোরেট এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার মতো বিষয়গুলিতে সংস্থাগুলির সাথে যোগাযোগ করার অনুমতি দেয় মাত্র। কিন্তু সমালোচকরা বলেন ভিন্ন কথা। তারা যুক্তি দেন যে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তগুলি সাধারণত সরকারী নিয়মের সাথেই সম্পৃক্ত, এই প্রভাব পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কর্মগুলিকে পরিবর্তন করেই থাকে।
অর্থনীতির বলতে গেলে প্রতিটি সেক্টর তাদের অধিনে রয়েছে। গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি এবং রাজনীতি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তিনটি কোম্পানির বলয়ে আটকে গেছে। যাদের হাতে রয়েছে 30 ট্রিলিয়ন ডলার। যা আমেরিকা (America), চিন (China) এবং জার্মানির (Germany) সম্মিলিত জিডিপির ও বেশি আর তারা হল ভ্যানগার্ড (Vanguard), ব্ল্যাকরক( Blackrock) এবং স্টেট স্ট্রিট (State Street Corporation) । ব্ল্যাকরক বিষয়ে আরো জানতে চাইলে আমাদের পেইজ নিউজলেটার -এ ব্ল্যাকরক নিয়ে লেখা ব্লগটি পড়তে পারেন।