পাঁচ তারকা হোটেলের আড়ালে লুকানো অন্ধকার! | Unique Group Exposed
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ধরনের ফুড ভ্লগার যেমন রাফসান দ্যা ছোট ভাই কিংবা পেটুক কাপলদের মত ইউটিউবারদের জন্য হোটেল শেরাটন কিংবা হোটেল ওয়েস্টিনের মত ৫ তারকা হোটেলগুলোর সাথে আমরা কম বেশি সবাই বেশ পরিচিত। সাড়ে ৮ হাজার টাকার ইফতার ব্যুফে কিংবা ১০ হাজার টাকার গরুর স্টেক এমন ভিডিও হারহামেশাই আমরা ইউটিউবে দেখে থাকি। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জানেনা যে এই হোটেল শেরাটন কিংবা হোটেল ওয়েস্টিনের মতো ৫ তারকা হোটেলগুলো একই কোম্পানির অধীনে পরে। যার নাম হলো ইউনিউক গ্রুপ অব বাংলাদেশ লিমিটেড।
প্রিয় পাঠক বিজনেস ম্যানিয়ার আজকের ব্লগটি এই গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজটি কে নিয়েই যেখানে আমরা এই কোম্পানি নিয়ে আলচনার পাশাপাশি এমন কিছু ডার্ক ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করবো যা সচরাচর আমার চোখ এরিয়ে যায়। তাহলে চলুন ব্লগটি শুরু করা যাক। ইউনিক গ্রুপ এর যাত্রা শুরু হয় মো নূর আলী এর হাত ধরে। মো নূর আলী ১৯৫৪ সালে ঢাকার নবাবগঞ্জে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম মো হাকিম আলী ও মায়ের নাম সুফিয়া খাতুন। তিনি ঢাকা ভার্সিটি থেকে ১৯৭৭ সালে সোশিওলজিতে অনার্স পাশ করেন ও এর পরের বছর মাস্টার্স পাশ করেন অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে। তবে তার পরিবারের ব্যাপারে আর তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় নি কিংবা ইচ্ছে করেই পাবলিক রাখা হয় নি।
ইউনিক গ্রুপের মূল যাত্রাটা শুরু হয় ১৯৮৩ সালের দিকে। এবং তারা যাত্রাটা শুরু করে শ্রম রপ্তানির মাধ্যমে। সহজ ভাষায় বাংলাদেশ থেকে মালয়শিয়াতে কাজের জন্য শ্রমিক পাঠাতো। যদিও এরপরে আরো অনেক প্রতিষ্ঠান এই ব্যবসায় তাদের নাম লিখায় কিন্তু সবার আগে এই ধরণের ব্যবসা শুরু করার কারণে ইউনিক গ্রুপ একটা ফার্স্ট মুভার এডভান্টেজ পায়, আর ফলে একটা বিশাল লাভ তারা এই ব্যবসা থেকে আনতে সক্ষম হয়।
এছাড়া ১৯৮৩ সালেই ইউনিক গ্রুপ আরেকটি প্রতিষ্ঠান বোরাক ট্রাভেলস (প্রাঃ) লিমিটেড চালু করে। এটি মূলত এয়ারোফ্লট রাশিয়ান এয়ারলাইন্স এবং এশিয়ানা এয়ারলাইন্সের রিপ্রেজেন্টিটিভ হিসেবে ব্যাবসা শুরু করে। এছাড়াও সেই সময়েই এটি বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনা করতো। সহজ ভাষায় বললে এখন যে আমরা বিভিন্ন সেলিব্রেটিদের প্রাইভেট জেট এ যাতায়াত করতে দেখি। এই সুবিধায় ওই প্রতিষ্ঠানটি ৮০ এর দশকেই বাংলাদেশে চালু করে। এই দুই খাতে ব্যাপক সফলতা লাভের পর প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯১ সালে ইউনিক গ্রুপ ইউনিক ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস নামে আরে ও একটি প্রতিষ্ঠান চালু করে।
পরবর্তী মাত্র ৪ বছরের মাথাতেই ১৯৯৫ সালেই ইউনিক গ্রুপ চীনের কারিগরি সহায়তায় ইউনিক সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে আর একটা প্রতিষ্ঠান গঠন করে। এবং একই বছর ফ্রেইট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড-ও প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালে ইউনিক ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার লিমিটেড চালু হয়, যা বাংলাদেশের বিনিয়োগ বোর্ড ও সিঙ্গাপুরের বিল্ডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন অথরিটির কোলাবরেশন এ গঠিত। ২০০০ সালের নভেম্বরে ইউনিক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেড এর মাধ্যমে দ্য ওয়েস্টিন ঢাকা চালু করা হয়। এবং পরবর্তী সময়ে হোটেল শেরাটন চালু করা হয়।
২০১০ সালের ১০ মার্চ স্টারউড হোটেলস অ্যান্ড রিসোর্টস ওয়ার্ল্ডওয়াইড-এর সঙ্গে তিনটি হোটেল প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০১০ সালের ১৭ জুন বেক্সিমকো গ্রুপ ইউনিক হোটেলস অ্যান্ড রিসোর্টসে ৫% শেয়ার ১৬০ কোটি টাকায় কিনে নেয়। একই বছরের এপ্রিল মাসে নূর আলী ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
প্রিয় পাঠক বর্তমানে ইউনিক গ্রুপের অধীনে রয়েছে ২০টির মতো একক কোম্পানি ও ২৫টির মতো জয়েন্ট ভেঞ্চার । এছাড়াও প্রায় ৩৫০০ কর্মী তাদের প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করে থাকে। এবং শুরু গেল অর্থবছরেই তাদের বাতসরিক টার্ন ওভার ছিল প্রায় ২২ মিলিয়ন ইউএস ডলার। বর্তমানে ইউনিক গ্রুপের অধীনে রয়েছে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেড (ওয়েস্টিন ঢাকা, ওয়েস্টিন সার্ভিসড অ্যাপার্টমেন্টস, সেন্ট রেজিস, শেরাটন ঢাকা, হায়াত সেন্ট্রিক), বোরাক রিয়েল এস্টেট, ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেড, ইউনিক ইস্টার্ন (প্রাঃ) লিমিটেড, ইউনিক ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার লিমিটেড, ত্রিবেণী ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, সোনারগাঁ ইকোনমিক জোন লিমিটেড, আপডেট ইনস্টিটিউট, হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট, হানসা ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, ইউনিক শেয়ার ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, ইউনিক সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বোরাক ট্রাভেলস (প্রাঃ) লিমিটেড, চ্যালেঞ্জার ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেড, ইউনিক ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, ফ্রেইট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, দৈনিক আমাদের সময়, গুলশান ক্লিনিক লিমিটেড, দৈনিক অধিনায়ক এর মতো প্রতিষ্ঠান।
চলুন প্রিয় পাঠক এবার আসা যাক ইউনিক গ্রুপের ডার্ক ইতিহাস এর দিকে। ইউনিক গ্রুপের কালো অধ্যায় এর সূচনা হয় অনেক আগেই। কিন্তু নানা কারণে এত বছর ধরে এসব লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। আমরা জানি ২০০৭ সালে বাংলাদেশের রাজনীতি এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল আর সে সময় ২০০৭ সালেই নূর আলী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ২২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত হন। যদিও পরে নানা রাজনৈতিক কারণে নির্বাচনটি বাতিল হয়।
পরে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ হেলাল এবং হেলালের স্ত্রী রুপা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯৯৭ সালে ইউনিক গ্রুপকে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি দেয়ার ঘটনায় ৫০ কোটি টাকার চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করেন। যদিও পরের বছর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি মামলাটি প্রত্যাহার করে নেন এবং প্রকাশ্যে ক্ষমা চান। তিনি দাবি করেন, “একটি স্বার্থান্বেষী মহল” তার নামে এই মামলা করেছে।
এদিকে আবার একই বছর ২০০৮ সালের ২১ আগস্ট, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্য MiG-29 যুদ্ধবিমান ক্রয়ের দুর্নীতির মামলায় মোহাম্মদ নূর আলীসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন শেখ হাসিনা, সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান জামাল উদ্দিন আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর মির্জা আখতার মারুফ, এবং অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব মো. হোসেন সেরনিয়াবাত। কিন্তু “উপযুক্ত প্রমানের অভাব’ এটাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে কোন এক কারণে আদালত ২০১১ সালের ২ জুন এই মামলায় সবাইকে খালাস দেয়।
২০১৬ সালের ২৫ আগস্ট ইউনিক গ্রুপ নারায়ণগঞ্জ জেলায় একটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির অনুমোদন পায়। তবে এই অঞ্চল নির্মাণে ইউনিক গ্রুপ কৃষিজমি বালু দিয়ে ভরাট করে, যা ১২ হাজার কৃষকের জীবিকায় প্রভাব ফেলে এবং এটি ২০০৪ সালের হাইকোর্টের আদেশেরও লঙ্ঘন ছিল।
২০১৮ সালের ১৬ আগস্ট ইউনিক গ্রুপ, স্টার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কনসোর্টিয়ামের সদস্য হিসেবে, চীনের কুনমিং আয়রন অ্যান্ড স্টিল হোল্ডিং কোম্পানির সঙ্গে মোহেশখালীতে ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের একটি ইস্পাত কারখানা স্থাপনে চুক্তি করে। ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই ইউনিক গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি ও তিতাস গ্যাসের সঙ্গে চুক্তি করে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলায় ৫৮৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য। এটি দেশের সবচেয়ে বড় কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে জেনারেল ইলেকট্রিক (GE) এ প্রকল্পে অংশীদার হয়। তবে একই সময়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ইউনিক গ্রুপকে সোনারগাঁ উপজেলায় ভূমি ভরাট বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে জানায় যে ইউনিক গ্রুপের দুটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান—ইউনিক প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড এবং সোনারগাঁ ইকোনমিক জোন—মেঘনা নদীর তীরবর্তী জলাশয় ও আর্দ্রভূমি অবৈধভাবে ভরাট করছে।
২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনিক গ্রুপের চেয়ারপার্সন সালিনা আলী এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূর আলীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আসাদুজ্জামান নূর। মামলাটি দায়ের করেন জালাল আহমেদ স্পিনিং মিলস ও শাহ ফতেউল্লাহ টেক্সটাইল মিলসের চেয়ারম্যান সেলিম আহমেদ, ইউনিক হাইটস নামক একটি ভবনের ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন নিয়ে বিরোধের কারণে। ভবনটি ইউনিক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বোরাক রিয়েল এস্টেট নির্মাণ করেছিল। মামলার তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (PBI) অভিযোগপত্র দেয়।
তবে ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর বিচারক তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে ইউনিক গ্রুপের হোটেল ব্যবসায় আয় কমে যায় এবং নগদ অর্থের সংকট দেখা দেয়। একই সময়ে তাদের শেরাটন ঢাকা প্রকল্প নিয়ে আইনি জটিলতায় পড়তে হয়, যা ঢাকার বনানীতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন একটি কমপ্লেক্সের ওপর নির্মাণাধীন ছিল।
এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালের ২৫ মে পাবলিশড হওয়া এক প্রতিবেদন অনুযায়ী আদালত থেকে মো নূর আলীকে সকল প্রকার বিদেশ যাত্রায় নিষেধজ্ঞা দেওয়া হয়। প্রিয় পাঠক আমাদের বিজনেজ মিনিয়ার আজকের ব্লগটি এই অব্দি।
ব্লগটি কেমন লাগলো তা আমাদের জানাতে ভুলবেন না। সেই সাথে আর কোন কোন টপিকের উপর আপনি ব্লগ পড়তে চান তাও আমাদের কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা কোন সমালোচনা বা আমাদের জন্য কোন সাজেশন থাকলে তাও জানাতে পারেন। দেখা হবে নতুন কোন টপিক নিয়ে নতুন কোন ব্লগে সেই অব্দি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন আর সচেতন থাকুন। ধন্যবাদ।