ভাই-বোনের দ্বন্দে বিপাকে হাজার কোটি টাকার ট্রান্সকম গ্রুপ | Transcom Group | Business Mania
ট্রান্সকম গ্রুপ ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্টিত হয়ে সুদির্ঘ ২৯ বছর বাংলাদেশে সুনামের সাথে ব্যবসা পরিচালনা করে চলেছে । অষুধ,ইলেক্ট্রনিক্স,খাদ্য ও পানী,চা ভোগ্য পণ্য,মিডিয়া সহ ৯ টি খাতে তাদের ব্যবসা রয়েছে
কিন্তু দীর্ঘ এই যাত্রায়, সুনামের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানটি এখন এক অভাবনীয় সংকটের মুখোমুখি।
মায়ের বিরুদ্ধে মেয়ে শাযরেহ হকের মামলা, বড় বোনের সাথে সম্পদ নিয়ে টানাপোড়েন ।
সবকিছু মিলিয়ে ট্রান্সকম গ্রুপের উত্তরাধিকারীরা এখন ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে এক জটিল দ্বন্দ্বে আবদ্ধ।
দির্ধ সময় ধরে দেশের শীর্ষে থাকা এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সাম্রাজ্যের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে?
তাহলে শেষ পর্যন্ত, ৩ দশকের অপরে রাজত্ব করা এই প্রতিষ্ঠান কি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?”
বিজনেস ম্যানিয়ার আজকের এই ব্লগ পোস্টে, আমরা তুলে ধরব ট্রান্সকমের গৌরবময় উত্থানের ইতিহাস।
এবং এর প্রতিষ্ঠাতা লতিফুর রহমানের দূরদর্শিতার গল্প, কিভাবে তিনি এই সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন।
সেই সাথে দেখবো, কি কারণে এবং কিভাবে শুরু হলো এই ভয়াবহ দ্বন্দ্ব, এবং এর পেছনে কারা রয়ে
১৮৮০-এর দশকে লতিফুর রহমানের পূর্বপুরুষরা চা ও পাটশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
লতিফুর রাহমানের দাদা, খান বাহাদুর মজিবুর রহমান ছিলেন চা ও পাটশিল্পের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী
এরই ভিত্তিতে লতিফুর রহমান এর রক্তেও ছিল ব্যবসার প্রতি সীমািহীন আগ্রহ। লতিফুর রহমানের জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৮ আগস্ট, ভারতের জলপাইগুড়িতে। জীবনের শুরুর দিনগুলো থেকেই তিনি একটি ঐতিহ্যবাহী এবং শিক্ষিত পরিবারে বেড়ে ওঠেন, যেখানে ব্যবসা ছিল নিত্য দিনের আলোচনার অংশ। ঢাকা শহরের গেন্ডারিয়ায় বসবাসরত তাঁর পরিবার ছিল সুশিক্ষা ও সংস্কৃতির অনুগামী। তিনি সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। পরে শিলংয়ের সেন্ট এডমন্ডস স্কুলে এবং কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়ন করেন ।
১৯৬৫ সালে, লতিফুর রহমান ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ১৯৬৬ সালে নিজেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ডব্লিউ রহমান জুট মিলে ট্রেইনি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এই সময় তিনি হাতেকলমে শিখেছিলেন ব্যবসার বাস্তবতা । কিভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হয় এবং কীভাবে সাফল্য অর্জন করা যায়।
লতিফুর রহমান তাঁর ব্যবসার পাশাপাশি ছিলেন একজন আদর্শ পারিবারিক মানুষ।
১৯৬৫ সালে, শাহনাজ রহমানকে বিয়ে করেন, যাকে তিনি বহু বছর ধরে পাশে পেয়েছেন।
তাঁদের সংসারে এসেছে চার সন্তান: সিমিন রহমান, শাজরেহ হক, শাজনীন রহমান এবং আরশাদ ওয়ালিউর রহমান।
১৯৭২-সালে সরকার ব্যাক্তি মালিকানাধীন কল-কারখানা জাতীয়করনের সিধান্ত নেয়, যার ফলে লতিফুর রাহমানের জুট মিল টিও সরকারের অধিনে চলে যায়, এমনকি তার মতিঝিল এর অফিস টিও সরকার অধিগ্রহন করে। এর ভেতর চরম আর্থিক সঙ্কটে পরেন তিনি। বেশির ভাগ দিনে পকেটে হয়তো ১০০-২০০ টাকাও থাকতনা। কিন্তু নিজের ভেতর থাকা উদ্যক্তা স্বভাবের কারনে বেশি দিন তাকে এই কষ্ট করতে হয়নি ।ব্যাংক হতে ৫০ লক্ষ টাকা ঋণ ও মাত্র ৫ জন কর্মী নিয়ে তিনি ট্রান্সকম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন । আর এর পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। লতিফুর রহমানের হাত ধরে ট্রান্সকম হয়ে ওঠে একটি বিস্তৃত ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য।
পাট ও চা খাতের বাইরেও ট্রান্সকম প্রবেশ করে বৈদ্যুতিক পণ্য, ইলেকট্রনিকস, খাদ্য ও পানীয়, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
লতিফুর রাহমানের লক্ষ্য ছিল শুধু একটি খাতে সীমাবদ্ধ না থেকে, বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করা।
১৯৯০ সালে, ট্রান্সকম অধিগ্রহণ করে বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্মিথক্লাইন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ (এসকেঅ্যান্ডএফ)-কে, এবং তার নামকরণ করে এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস।
এসকেএফ আজ বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে ওষুধ শিল্পে তাদের প্রবেশ ঘটে এবং সেখানে তারা দ্রুত সফলতাও অর্জন করে।
এর কিছু বছর পর, ১৯৯৩ সালে ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস যাত্রা শুরু করে। বৈদ্যুতিক পণ্য এবং ইলেকট্রনিকসের ক্ষেত্রে এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তারা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদন এবং বিক্রয় শুরু করে, যা আজকের দিনে তাদের অন্যতম সফল ব্যবসায়িক ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ট্রান্সকমের আয় সবসময়ই দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। ২০২০ সালে তাদের বার্ষিক আয় ছিল ৮০ কোটি মার্কিন ডলার, যা প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক দক্ষতার প্রতিফলন।
তবে ট্রান্সকমের সত্যিকারের সাফল্য আসে ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে, যখন তারা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ খাতে প্রবেশ করে।
২০০৩ সালে ট্রান্সকম ফুডস লিমিটেডের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের বাজারে পিৎজা হাটের ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে আসে। তারপর ২০০৬ সালে যোগ হয় কেএফসি।
আজকের দিনে কে এফ সি ও পিঁজা হাট ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ৩৯টিরও বেশি শাখা পরিচালনা করছে, যা বাংলাদেশের ফুড অ্যান্ড বেভারেজ খাতে তাদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।
এছাড়া ট্রান্সকম বেভারেজ লিমিটেডও এই খাতের একটি সফল উদ্যোগ। পেপসিকোর সঙ্গে তাদের অংশীদারিত্বের ফলে তারা পেপসি, সেভেনআপ, মিরিন্ডা, মাউন্টেইন ডিউ সহ আরও অনেক পানীয়ের উৎপাদন ও বিতরণ করছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের কারখানা এবং উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে হাজার হাজার কর্মী কাজ করছে।
বাংলাদেশের সবথেকে দুইটি জনপ্রিয় পত্রিকা প্রথম আলো , দি ডেইলি স্টার এবং জনপ্রিয় রেডিও মাধ্যম এবিসি রেডিও ৮৯.২ এফ এম এর স্বত্তাধিকার ও ট্রান্সকম গ্রুপ।
ট্রান্সকম ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিডিসিএল)-এর কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়।
এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিক্রয় ও বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, যা সারা দেশে ১ লাখ ২০ হাজার ফার্মেসি এবং ৭০ হাজারেরও বেশি দোকানে ওষুধ এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করে থাকে।
ট্রান্সকম শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, বৈশ্বিক বাজারেও তাদের শক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের বিভিন্ন কোম্পানি এখন আন্তর্জাতিক মানের পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করছে।
২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, ট্রান্সকম গ্রুপের বার্ষিক আয় ৬৮৫.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল। প্রতিষ্ঠানটির সামগ্রিক বৃদ্ধির হার এবং কর্মী সংখ্যা এটির আকার ও সক্ষমতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেয়। বর্তমানে ট্রান্সকম ২৫,০০০-এরও বেশি কর্মীকে নিয়োগ করে চলছে, যা দেশের অন্যতম বৃহৎ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে।
এভাবে, লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে এবং তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এর ওপর ভিত্তি করে, ট্রান্সকম গ্রুপ আজ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সফল ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর একটি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
২০২০ সালের ১ জুলাই, কুমিল্লার চিওড়া গ্রামে নিজের বাড়িতে ৭৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন লতিফুর রহমান।
আর ট্রান্সকম গ্রুপের দীর্ঘদিনের শান্ত পরিবেশে প্রথম ফাটল ধরে ঠিক তার মৃত্যুর পর।
তার রেখে যাওয়া বিশাল সম্পত্তি নিয়ে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় যা আজ কোম্পানির শীর্ষপর্যায়ে রীতিমতো সংকট তৈরি করছে।
লতিফুর রহমানের ছোট মেয়ে শাযরেহ হক প্রথম অভিযোগ উত্থাপন করেন, যেখানে তিনি অভিযোগ করেন যে তার বড় বোন সিমিন রহমান এবং মা শাহনাজ রহমান তাকে ও তার ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে তাদের ন্যায্য সম্পত্তির ভাগ থেকে বঞ্চিত করেছেন।
শাযরেহ হকের মামলার মূল বিষয়বস্তু ছিল ট্রান্সকম লিমিটেডের ২৩ হাজার ৬০০ শেয়ার। অভিযোগ অনুসারে, সিমিন রহমান নকল স্বাক্ষর ও জালিয়াতির মাধ্যমে সেই শেয়ার নিজের নামে করেছেন, যেখানে ফখরুজ্জামান ভুঁইয়া এবং অন্যান্য কোম্পানি কর্মকর্তাদেরও সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর তিনি এই জালিয়াতি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং অভিযোগ করেন যে তার স্বাক্ষর এবং টিপসইও জাল করা হয়েছে।
এই দ্বন্দ্ব শুধু পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং আরও বড় আকারে অর্থসম্পদ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। শাযরেহ হকের মতে, তাদের বাবা ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রেখে গেছেন, যা শরিয়া আইন অনুযায়ী সমানভাবে ভাগ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শাহনাজ রহমান এবং সিমিন রহমান, সেই সম্পদের বড় অংশ নিজেদের কাছে রেখে, বেশ কয়েকজন সহযোগীর সহায়তায় “ডেথ অফ সেটেলমেন্ট” তৈরি করেন। ডেথ অফ সেটেলমেন্ট বলতে একজন মৃত ব্যক্তির আমানত মৃত্যু পরবর্তি নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া কে বোঝানো হয় । ডেথ অফ সেটেলমেন্ট জন্য ইন্ডেমনিটি বন্ড ও এফিডেফিটের প্রয়োজন পরতে পাড়ে।
আরও একটি মামলায় উল্লেখ করা হয় যে লতিফুর রহমান মৃত্যুর আগে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং এফডিআরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা রেখে যান, যা ওয়ারিশদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন হওয়ার কথা। কিন্তু নমিনি হিসেবে তার মা শাহনাজ রহমান সেই টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নেন এবং ট্রান্সকম লিমিটেডের ১৮ শতাংশ শেয়ার কিনে পরে সিমিন রহমানকে সেই শেয়ার দান করেন।
বর্তমানে, এই মামলাগুলোর তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ইতিমধ্যেই সিমিন রহমান ও শাহনাজ রহমানসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। শেয়ার ও সম্পদ নিয়ে ট্রান্সকম গ্রুপের এই অভ্যন্তরীণ সংকট প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যতের উপর বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।
ট্রান্সকম গ্রুপের এই আইনি সংকটের সমাধান খুঁজতে গেলে বেশ কয়েকটি সম্ভাবনা সামনে আসে। পারিবারিক বিরোধ আদালতের মাধ্যমে সমাধান হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদি আইনি লড়াই কোম্পানির সুনাম ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে, পারিবারিক সমঝোতা একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে, যা কোম্পানির স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়ক হবে।
লতিফুর রহমান একজন সফল ব্যবসায়ীর পাশাপাশি , ছিলেন দেশের জন্য অনুপ্রেরণার প্রতীক।
তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা পরবর্তি প্রজন্মের কাছে সততা আর দূরদর্শিতার সাথে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা ও সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে তা যুগ যুগ ধরে টিকে থাকার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার রেখে যাওয়া এই সাম্রাজ্যর পতন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক কারন হতে পারে।
তাই এখন একটাই প্রশ্ন এখন সবার সম্মুখে এই সংকট কি দ্রুত সমাধান হবে, নাকি দীর্ঘমেয়াদে ট্রান্সকম গ্রুপকে আরও সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে?
আপনাদের কি মতামত? জানিয়ে দিন আমাদের কমেন্ট বক্স এ আর দেখতে থাকুন বিজনেস ম্যানিয়া।