সামিট গ্রুপ যেভাবে বিদ্যুৎ খাত হতে ১৪ হাজার কোটি টাকা লুট করেছিল!! Summit Group | Business Mania
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেক্টরে মাফিয়া
১৭ হাজার কোটি টাকার এলএনজি (LNG) টার্মিনাল এর কাজ মাত্র ১০ দিনের প্রক্রিয়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ডঃ তৌফিক ইলাহির একক সিদ্ধান্তে সামিট (Summit) গ্রুপকে কাজ দেয়া হয়। কাজে লাগানো হয় জ্বালানি ও বিদ্যুৎখাতের বিশেষ আইন। বিদ্যুতের পাশাপাশি আমদানি করা গ্যাস সরবরাহের জন্য একটি ভাসমান এলএনজি (LNG) টার্মিনাল বা FXRU এই কোম্পানির হাতে, এটিও দেয়া হয়েছে বিশেষ আইনে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে তৃতীয় এলএনজি (LNG) টার্মিনাল তৈরিতে বেশকিছু কোম্পানি আগ্রহ দেখালেও তৌফিক ইলাহির নির্দেশে কোনরকম যাচাই বাছাই ছাড়াই কেবল সামিট (Summit) কে কাজ দেয়া হয়। ১৫ বছর মেয়াদী চুক্তিতে চালু থাকবে অন্তত ৫ হাজার ২৩৫ দিন, দৈনিক ৩ লাখ ডলার হিসেবে কর ও মুষল বাদে এ সময় রিগেসিফিকেশন (regasification) চার্জ বাদে সামিট (Summit) এর আয় হবে ১৫৭ কোটি ৫লক্ষ ডলার । তবে বর্তমানে টার্মিনালটি (terminal) বন্ধ থাকলেও ক্যাপাসিটি বাবদ ২৭০ কোটি টাকা পেট্রো (Petro) বাংলার কাছে দাবি করছে কোম্পানিটি। আলোচিত বা সমালোচিত যাই বলি না কেন বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী সামিট (Summit) গ্রুপের নানা জানা অজানা কাহিনি নিয়ে বিজনেস ম্যানিয়ার (Business Mania) আজকের ব্লগ পোস্টটি।
সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আজিজ খান। আলোচিত এই ব্যাক্তি দেশের সম্পদের পরিমাণের ৪১ গুণ বেশি সম্পদ রয়েছে সিঙ্গাপুরে l সিঙ্গাপুরের ৪১ তম ধনী সামিট গ্রুপের আজিজ খান। সিঙ্গাপুরের ১৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বিপরীতে দেশে মাত্র ৩৩০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। দেশে তার পরিবারের সাত সদস্যের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১২০০ কোটি টাকা। আজিজ পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন১২০টি কোম্পানির নথি সংগ্রহ করা হয়েছে।
১৯৫৫ সালের ঢাকায় এক সেনা অফিসারের ঘর আলো করে জন্ম হয় বর্তমান সমিতি গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খানের।
সাত ভাই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল ( অবসরপ্রাপ্ত ) ফারুখ খান তার বড় ভাই একজন প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য। সামিট গ্রুপ অফ কোম্পানির সহ-সভাপতি হলেন জাফর উদ্দিন খান,লতিফ খান এবং ফরিদ খান।
পিতৃহারা এক বন্ধুর সঙ্গে প্রথম ব্যবসায়িক উদ্যোগ নেন ১৯৭৩ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে অংশীদার হওয়ার জন্য তার বাবার কাছ থেকে মাত্র ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা শুরু করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন (Institute of Business Administration) (IBA) থেকে মাস্টার্স (Master’s) ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি পুরান ঢাকার চকবাজার (Chawkbazar) ও উর্দু রোডে রাসায়নিক ব্যবসায়ী (chemical business) হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। পরে তিনি আনোয়ার গ্রুপের (Anwar Group) আনোয়ার হোসেন (Anwar Hossain) এবং ফিনিক্স গ্রুপের (Phoenix Group) দিন মোহাম্মদ (Din Mohammad) এর মত সুপরিচিত ব্যবসায়ীদের সহায়তায় তার কোম্পানি গড়ে তোলেন। সরকারের মালিকানাধীন পূবালী ব্যাংক (Pubali Bank) এবং রূপালী ব্যাংক (Rupali Bank) আজিজ খানকে প্রাথমিক ঋণ প্রদান করেছিল।
এরপর তিনি প্লাস্টিকের ব্যবসা শুরু করে এবং পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে স্থায়ী নাগরিক হওয়ার পর সিঙ্গাপুরে (Singapore) তার প্রথম বাড়িটি ক্রয় করেন। মোহাম্মদ আজিজ খান সিঙ্গাপুরের (Singapore) একজন স্থায়ী নাগরিক (permanent resident)। তার স্ত্রী আনজুমান আজিজ খান বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের (Singapore) দ্বৈত নাগরিক (dual citizen)। তাদের ঢাকার বাড়ি সেরেনিটি’স লজ (Serenity’s Lodge), যা তৈরি করেছেন প্রখ্যাত স্থপতি (architect) নাহাস আহমেদ খলিল (Nahas Ahmed Khalil)।
আয়েশা, আদিবা এবং আজিজা তাদের তিন কন্যা। সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল (Summit Power International) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (Managing Director) ও সিইও (CEO) হলেন আয়েশা খান। তার দ্বিতীয় কন্যা ডঃ আদিবা আজিজ খান ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় (Cambridge University) ওলফসন কলেজের (Wolfson College) ফেলো (Fellow)। তার কনিষ্ঠ কন্যা আজিজা আজিজ খান সামিট গ্রুপ অফ ইন্টারন্যাশনাল (Summit Group of International) এর পরিচালক (Director)।
সামিট গ্রুপ (Summit Group) বাংলাদেশের বৃহত্তম সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম। সামিট পাওয়ার লিমিটেড (Summit Power Limited) ১৯৯৭ সালের ৩০ শে মার্চ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গোষ্ঠীর আওতাধীন শিল্পের মধ্যে রয়েছে যোগাযোগ (Communication), বাণিজ্য (Commerce), পাওয়ার এন্ড ইলেক্ট্রিসিটি (Power and Electricity), শিপিং (Shipping) সহ ১৬টি প্রতিষ্ঠান। সিঙ্গাপুরে (Singapore) অবস্থিত সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল (Summit Power International) এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ৭ই জুন ২০১৪ সামিট পাওয়ার (Summit Power) এটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়।
১৮ বছর বয়সে জুতা (shoe) তৈরীর ব্যবসা শুরু করতে ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে বাবার কাছ থেকে। ভালো মুনাফা (profit) হওয়া বছর ঘুরতেই বাবার ধার পরিশোধ করে এগিয়ে যান সামনের দিকে, জুতা (shoe) তৈরীর পাশাপাশি পিভিসি (PVC) আমদানি শুরু করেন আজিজ খান। আরো নতুন নতুন ব্যবসায়ে বিনিয়োগ (investment) শুরু করেন তিনি। এরপর আর এই ব্যবসায়ী (businessman) আজিজ খানকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রায় ২৩ বছর পর ১৯৯৩ সালে বিদ্যুৎ (power) উৎপাদনে বিনিয়োগ করেন আজিজ খান। এখন তার কোম্পানি বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান (power producer) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ (investment) আছে এই গ্রুপের। বিদ্যুৎ উৎপাদন (power generation) ছাড়াও জ্বালানি (energy) খাত, তথ্যপ্রযুক্তির (IT) যোগাযোগ নেটওয়ার্ক (communication network), বন্দর (port) অবকাঠামো ব্যবসায় সফল নাম সামিট (Summit)। ভারতের বিদ্যুৎ (power) খাতে ও বিনিয়োগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এছাড়াও দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশের সাথে বড় ধরনের বিনিয়োগের (investment) চিন্তাভাবনার রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটির। সামিট পাওয়ার (Summit Power), সামিট কোড এলায়েন্স (Summit Alliance) ও খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (Khulna Power Company Limited) এই তিনটি কোম্পানি এখন দেশের শেয়ার বাজারের (share market) তালিকাভুক্ত। বছরে এই কোম্পানির আয় প্রায় ৮০০ কোটি টাকা । কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৬ হাজারেরও বেশি। বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সামিট গ্রুপের ভূমিকা নজর কাড়ার মত। প্রতিষ্ঠানটির ১৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র (power plants) রয়েছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২.১৫ হাজার মেগাওয়াট (MW)। যা দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৮%। আর বেসরকারি খাতে প্রায় ১৯ শতাংশই সামিটের (Summit)। দেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষকে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করছে প্রতিষ্ঠানটি। গ্যাস (gas) সংকট মোকাবেলায় ভাসমান টার্মিনাল (floating terminal) তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি (IT) সেবা উন্নত করতে ইন্টারনেট (internet) খাতে বিনিয়োগ (investment) করেছে সামিট। তৈরি করেছে ৪৭ হাজার কিলোমিটার (km) ফাইবার অপটিক (fiber optic) লাইন। সামিট কমিউনিকেশন (Summit Communication) বর্তমানে ১ হাজার ২০০ জিবিপিএস (Gbps) ইন্টারনেট (internet) সরবরাহ করছে। ঢাকার মুন্সিগঞ্জ (Munshiganj), ভারতের কলকাতা (Kolkata), ও পাটনাতে (Patna) আছে সামিটের নৌ বন্দর (port)। ঢাকার মুগদার পুলে অবস্থিত সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট (Summit Alliance Port) এর মাধ্যমে ভারত থেকে তুলা (cotton), চাল (rice), গম (wheat), নানা খাদ্যশস্য (food grains) ভারত থেকে আমদানি করছে। এর সাথে সাথে কিছু পণ্য রপ্তানি (export) করা হচ্ছে।
কিন্তু এত সাফল্যের পরও নানান অভিযোগের (allegations) তীর রয়েছে সামিট গ্রুপের (Summit Group) দিকে। আজিজ খানের বড় ভাই মোহাম্মদ ফারুক খান হাসিনা সরকার আমলে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন (tourism) মন্ত্রী ছিলেন। আর এরই সুবাদে গত এক দশকে আজিজ খানের সামিট গ্রুপ (Summit Group) লুট করেছে বিদ্যুৎ (power) খাতের কোটি কোটি টাকা। এছাড়া কোনো দরপত্র (tender) ছাড়াই সামিট গ্রুপকে মহেশখালীতে (Maheshkhali) ১৭ হাজার কোটি টাকার এলএনজি (LNG) টার্মিনালের কাজ দিয়েছে হাসিনা সরকার। এছাড়া ক্যাপাসিটি চার্জের (capacity charge) নামে সামিট গ্রুপ (Summit Group) লুট করেছে হাজার হাজার কোটি টাকা । সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকার কারণে কোনো রকমের প্রতিযোগিতা (competition) ছাড়া রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (power plant) নির্মাণ, বিশেষ আইনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি (energy) সরবরাহের নামে হাজার কোটি টাকা পাচারসহ, টেন্ডার (tender) ছাড়া জ্বালানি অবকাঠামো (infrastructure) ছাড়াও বড় বড় প্রকল্পের (projects) অনুমোদন নেয় সামিট (Summit)। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ (investment) রয়েছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার , যা বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ বেসরকারি বিনিয়োগ (investment)।
অন্যদিকে দেশের একমাত্র এলএনজি (LNG) টার্মিনালের মালিক সামিট (Summit), তাই দেশের গ্যাসের (gas) দেশীয় উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি না করে, এলএনজি (LNG) আমদানি বাড়ানোর জন্য এই প্রতিষ্ঠানটির দায় (responsibility) রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ (Awami League) সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ আইন (special law) ২০১০ পাশ করার পর এই আইনের সব রকমের সুযোগ-সুবিধা সামিট গ্রুপ (Summit Group) ভোগ করে। খুব ভালোভাবে দেখলে মনে হবে এ আইনটি কেবলমাত্র সামিট গ্রুপকে (Summit Group) সুবিধা প্রদানের জন্য পাশ করানো হয়েছে। সরকারের সকল ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা থাকার কারণে এই সামিট গ্রুপ (Summit Group) ও সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান (chairman) আজিজ খান বিদ্যুৎ খাতে মাফিয়া (mafia) হয়ে উঠেছে। জ্বালানি সংকট (energy crisis) প্রকটকালেও নারায়ণগঞ্জের (Narayanganj) মেঘনা ঘাটে (Meghna Ghat) ৬০০ মেগাওয়াট (MW) গ্যাস (gas) ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয় সরকার। এছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানটির আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় সিঙ্গাপুরে (Singapore), কারণ এই প্রতিষ্ঠানের বিদেশী নিবন্ধন (foreign registration) থাকার কারণে এই প্রতিষ্ঠানের আয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। একক ছত্র প্রভাবের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির (corruption) মাধ্যমে সামিট গ্রুপ (Summit Group) বিপুল পরিমাণে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে আর হয়ে উঠেছে বিদ্যুৎ খাতের মাফিয়া (mafia)।
বিজনেস ম্যানিয়ার আজকের ব্লগ পোস্টটি ভাল লেগে থাকলে লাইক ও সাবস্ক্রাইব করুন। পরবর্তি ব্লগে কি নিয়ে দেখতে চান টা জানিয়ে দিন আমাদের কমেন্ট বক্স এ ।