আইনি লড়াইয়ের পর কি টিকে থাকবে সিকদার গ্রুপ ? | Sikder Group Legal Battle | Sikder group | Business Mania

Sikder Group। ১৯৫০-এর দশকে Zainul Haque Sikder এর প্রতিষ্ঠা করা এই গ্রুপটি রিয়েল এস্টেট, তৈরি পোশাক, ব্যাংকিং, বিদ্যুৎ উৎপাদন, অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবার মতো বহু খাতে বিস্তার লাভ করেছে।

বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও পরিচালিত হচ্ছে তাদের ব্যবসা। বছরের পর বছর ধরে দেশিও অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এই গ্রুপ, সাথে তৈরি করেছে নানা আলোচনা ও বিতর্কও।

আজকের ব্লগটিতে থাকছে Sikder Group-এর ইতিহাস, ব্যবসায়িক বিস্তার ও বর্তমান প্রভাবের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ। তাহলে চলুন শুরু করা যাক।

Sikder Group বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং প্রভাবশালী পারিবারিক ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর একটি, যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫০-এর দশকে। প্রতিষ্ঠাতা Zainul Haque Sikder ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোক্তা, যিনি দেশভাগের পরে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে ব্যবসার ভিত্তি গড়ে তোলেন। তাঁর হাত ধরেই গড়ে ওঠে এই গ্রুপের প্রাথমিক কাঠামো, যা ধীরে ধীরে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে বিস্তৃত হয়েছে বহু খাতে।

প্রথম দিকে গ্রুপের মূল ব্যবসা ছিল রিয়েল এস্টেট খাতে। ৫০ ও ৬০ দশকের ঢাকা ছিল গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায়, যেখানে আবাসন এবং জমির বাজার ছিল তুলনামূলক খোলা। Zainul Haque Sikder এই খাতেই সম্ভাবনা দেখেন এবং ধাপে ধাপে নিজের ব্যবসার ভিত্তি শক্ত করে তোলেন। শহরের জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমির চাহিদাও বাড়ছিল, আর সেই সময়েই তিনি শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিনিয়োগ শুরু করেন।

এরপর তিনি নজর দেন টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাতে। তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে ৮০ ও ৯০-এর দশকে। কিন্তু Sikder Group অনেক আগেই এই খাতে সম্ভাবনা চিনে নিয়েছিল। এই সেক্টরে তাদের বিনিয়োগ ছিল দেশের রপ্তানিমুখী অর্থনীতির সঙ্গে একটি কৌশলগত সংযুক্তি।

স্বাস্থ্যসেবা খাতে অবদান রাখতে ১৯৯২ সালে গ্রুপটি প্রতিষ্ঠা করে Z.H. Sikder Women’s Medical College & Hospital। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ, কারণ তখন দেশে নারীদের জন্য আলাদা মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল খুবই কম। এই প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসা শিক্ষার প্রসার ও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পাশাপাশি Sikder Group আর্থিক খাতেও প্রবেশ করে National Bank Limited-এর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে। দেশের অন্যতম পুরনো বেসরকারি এই ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গ্রুপটি ব্যাংকিং খাতের জটিল অথচ লাভজনক জগতে প্রবেশ করে। এর মাধ্যমে তারা শুধু নিজস্ব ব্যবসার অর্থায়ন সুবিধা বাড়ায়নি, বরং দেশের আর্থিক পরিসরেও একটি বড় ভূমিকা রাখতে শুরু করে।

২০১১ সালে তারা বিদ্যুৎ খাতে প্রবেশ করে PowerPac Holdings-এর মাধ্যমে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট বরাবরই একটি বড় চ্যালেঞ্জ । সে সময়ও তা ভিন্য ছিল না। PowerPac সরকারের কাছ থেকে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। পরে ২০১৬ সালে তাদের আরেকটি প্রতিষ্ঠান PowerPac Ports Limited মোংলা বন্দরের দুটি জেটি পরিচালনার চুক্তি পায়, যা দেশের বন্দর অবকাঠামোর উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল।

Sikder Group-এর আরও বড় একটি উদ্যোগ ছিল Mongla Economic Zone-এর উন্নয়ন। Public-private partnership মডেলে ২০৫ একর জমিতে এই ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ তারা শুরু করে PowerPac Economic Zone (Pvt.) Ltd. নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এখানে ইতিমধ্যেই গ্রুপের কয়েকটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান যেমন PowerPac Petroleum, PowerPac মুতিয়ারা খুলনা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, PowerPac Steel Mills এবং Sikder Insurance কোম্পানি জমি পেয়েছে এবং কারখানা নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিল্প বিকাশ এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছে এই গ্রুপ।

২০১৮ সালে RAJUK-এর সঙ্গে অংশীদারিত্বে তারা শুরু করে Central Business District (CBD) প্রকল্প, যেখানে জাপানি কোম্পানি Kajima Corporation-ও ছিল সহযোগী। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল পূর্বাচলে একটি আধুনিক আন্তর্জাতিক মানের বানিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে তোলা। প্রায় ৯৬,০০০ কোটি টাকার সম্ভাব্য বিনিয়োগ নিয়ে এটি দেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ রিয়েল এস্টেট ও কমার্শিয়াল প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়।

২০২১ সালে প্রতিষ্ঠাতা Zainul Haque Sikder-এর মৃত্যুর পর গ্রুপটির নেতৃত্বে আসেন তার দুই ছেলে Rick Haque Sikder এবং Ron Haque Sikder। বর্তমানে তারাই গ্রুপটির কার্যক্রম এবং ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণ পরিকল্পনা পরিচালনা করছেন।

আজকের Sikder Group কেবল একটি ব্যবসায়িক নাম নয়, এটি একটি শক্তিশালী শিল্প সাম্রাজ্য, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতের বিভিন্ন স্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে বহু বছর ধরে।Sikder Group শুরুটা করেছিল একটি টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তখনও তারা দেশের বাইরে এতটা বিস্তৃত ছিল না, বরং পোশাক খাতেই মূল ফোকাস ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই গ্রুপ নানা খাতে প্রবেশ করতে থাকে, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বন্দর, এমনকি আন্তর্জাতিক ব্যবসা পর্যন্ত। তবে সব সময় যে আলোচনায় এসেছে ইতিবাচক কারণে, তা নয়।

২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য তাদের মালিকানাধীন একটি কারওয়াশ ব্যবসার বিরুদ্ধে মামলা করে প্রায় ৬.৬ মিলিয়ন ডলারের। অভিযোগ ছিল, প্রতিষ্ঠানটি শ্রমিকদের ঠিকমতো মজুরি দেয়নি, ওভারটাইমের টাকা বঞ্চিত করেছে, এমনকি শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন করেছে। এই ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে বেশ আলোচনায় আসে।

এরপর ২০১১ সালে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন পায় Mongla Economic Zone পরিচালনার জন্য। এই ইকোনমিক জোন গড়ে তুলতে শুরু করে PowerPac Economic Zone নামে একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। মূলত দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন, শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এটা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিশিয়েটিভ।

কিন্তু ২০১৬ সালের শেষ দিকে প্রকাশ্যে আসে আর্থিক দায়ের তথ্য। বিভিন্ন ব্যাংকে Sikder Group-এর মোট ঋণ দাঁড়ায় প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা। দেশের বড় বড় ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা এই গ্রুপের ওপর তখন থেকেই বাড়তে থাকে নজরদারি।

২০২০ সালে আসে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। Exim Bank-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে গুলশানে অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। মামলার মূল অভিযুক্ত ছিলেন Ron Haque Sikder এবং Dipu Haque Sikder। অভিযোগের পর তারা দেশ ত্যাগ করেন , বিশেষভাবে, একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ‘রোগী’ সেজে দেশ ছাড়েন বলে গণমাধ্যমে উঠে আসে।

এই ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র আলোচনা শুরু হয়। তবে পরে আদালত তাদের নির্দোষ ঘোষণা করে। মামলার বাদী নিজেই জানিয়ে দেন, তার আদালতের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে কোনো আপত্তি নেই। ফলাফল , Ron ও Dipu, দুজনেই মামলা থেকে অব্যাহতি পান।

এই ঘটনাগুলো Sikder Group-এর সাম্প্রতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত অধ্যায়। যেখানে রয়েছে ব্যবসায়িক প্রসার, সরকারি প্রকল্পের অংশগ্রহণ, আবার রয়েছে বিতর্ক, আইনি লড়াই এবং জনমতের ভিন্নতা।

বর্তমানে Sikder Group নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ঢাকার একটি আদালত সম্প্রতি তাদের পুর্বাচলের ১০০ একর জমি জব্দের আদেশ দিয়েছে, যা PowerPac Holdings-এর মাধ্যমে Central Business District প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ।

এছাড়া, Janata Bank প্রায় ৮৪৩ কোটি টাকার বকেয়া ঋণ আদায়ে PowerPac Mutiara Jamalpur Power Plant নিলামে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে ।

তবে, Sikder Group একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা কোনো সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছে না। বরং, চলমান প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ।

এই পরিস্থিতিতে, Sikder Group-এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আইনি প্রক্রিয়া, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার উপর।

এই ছিল Sikder Group-এর ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমাদের বিশ্লেষণ। যদি ব্লগটি আপনাদের পছন্দ হয়ে থাকে, তাহলে ই-মেইল সাবস্ক্রাইব করে পাশেই থাকবেন । ভবিষ্যতে কোন‌ কোম্পানির উপর লেখা পড়তে চান তা কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না, আসসালামুয়ালাইকুম।