শাসক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় এস আলমের অর্থ সাম্রাজ্য | How S Alam Group Looted BD Banks | Business Mania
গত ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ যেসব প্রতিষ্ঠান শৈল্পিকভাবে করেছে, তার মধ্যে এস আলম গ্রুপ অন্যতম। পত্র-পত্রিকায় তাদের বিরুদ্ধে অনেক লেখালেখি হলেও, বিচার বিভাগের মতো জনসম্পদকে সরকারী ছত্রছায়ায় ব্যবহার করে তারা সবকিছু এড়াতে সক্ষম হয়েছে। এস আলমের বিরুদ্ধে আঙুল তুললেও সেই আওয়াজ বেশি দূর কখনও পৌঁছাতে পারেনি। স্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের থেকে হাজার কোটি টাকা পাচার করে, তাদের নিরাপত্তার সহিত জামাই আদরে বিদেশে পাঠিয়েছে সদ্য বিদায়ী সরকার।
এস আলম গ্রুপের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের গল্প মোটেই নতুন নয়। অথচ তাদের বিরুদ্ধে করা প্রতিটি তদন্ত একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে, কিংবা সরাসরি বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দেশের অর্থনীতি এবং প্রভাব পড়েছে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর।
এস আলমের ব্যবসার বিস্তার
১৯৮৫ সালে সাইফুল আলম এস আলম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। তাদের ব্যবসার পরিধি পণ্য বাণিজ্য (Product Trading) থেকে মাছ ধরা (Fishing), নির্মাণ সামগ্রী (Construction Materials) থেকে আবাসন ব্যবসা (Real Estate), টেক্সটাইল (Textile) থেকে মিডিয়া (Media), আন্তঃনগর বাস (Intercity Bus) থেকে শিপিং (Shipping), এবং জ্বালানি (Energy) ও বিদ্যুৎ (Electricity) থেকে ব্যাংকিং (Banking) ও ইন্স্যুরেন্স (Insurance) পর্যন্ত বিস্তৃত।
এস আলম গ্রুপের দেশের প্রায় ৬ টি ব্যাংকে রয়েছে শেয়ার। সর্বশেষ ইসলামী ব্যাংকের (Islamic Bank) মতো একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানও তাদের দখলে চলে যায়। মিডিয়া থেকে স্টেইনলেস স্টিল (Stainless Steel), তৈরী পোশাক (Garments) থেকে রিয়েল স্টেট (Real Estate), ঠিকাদারী (Contracting)—এস আলম গ্রুপ বছরের পর বছর ধরে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছে। কিন্তু তাদের ব্যবসার ক্যাশ ফ্লো থেকে অর্থপাচার (Money Laundering) করে কোনো ধরনের জবাবদিহি ছাড়াই তারা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতির সম্মুখীন করেছে।
ব্যাংকিং খাতে এস আলমের প্রভাব
ইসলামী ব্যাংক একসময় দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে অনুকরণীয় নাম ছিল। কিন্তু সদ্য বিদায়ী আওয়ামী সরকার এই ব্যাংকের ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বারদের সরিয়ে দেয় এবং ক্ষমতা চলে যায় এস আলমের হাতে। এভাবে ইসলামী ব্যাংকের ৫০ হাজার কোটি টাকা চলে যায় এস আলমের পকেটে। শুধু ইসলামী ব্যাংকই (Islamic Bank) নয়, আরও পাঁচটি ব্যাংক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে ইচ্ছেমতো লুট করেছে তারা।
ব্যাংকগুলোতে নেওয়া ঋণ (Loan) ফেরত না আসায় এই ব্যাংকগুলো দেড় বছর ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাহিদামতো টাকা জমা রাখতে পারছে না। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার (Former Governor Abdur Rouf Talukdar) বিশেষ সুবিধা দিয়ে এসব ব্যাংকের কার্যক্রম স্বাভাবিক রেখেছিলেন। এখন রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Central Bank) এসব সুবিধা কমিয়ে দিয়েছে এবং এক কোটি টাকার বেশি অর্থের চেক ক্লিয়ারিং (Check Clearing) সুবিধাও বন্ধ করে দিয়েছে।
অর্থ পাচারের কৌশল ও বিদেশি বিনিয়োগ
এস আলম গ্রুপের সত্ত্বাধিকারী মো: সাইফুল ইসলাম শুধু সিঙ্গাপুরেই (Singapore) এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (Billion USD) ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের (Bangladesh Bank) কোনো রকম স্টেইটমেন্ট কিংবা অফিশিয়াল প্রসিডিউরের (Official Procedures) তোয়াক্কা না করেই তিনি এই ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। সাইফুল ইসলামের স্ত্রী ফারজানা হক (Farzana Haque) এস আলমের ব্যবসা শুধু সিঙ্গাপুরেই নয়, সাইপ্রাসের (Cyprus) মতো দেশগুলোতে এবং মধ্যপ্রাচ্যেও (Middle East) বিস্তৃত করেছেন।
হাইকোর্টের রুল ও মামলার আদেশ
২০২২ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক রিপোর্টের (Reports) ভিত্তিতে হাইকোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (Bangladesh Financial Intelligence Unit), দুর্নীতি দমন কমিশন (Anti-Corruption Commission), এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (CID) এস আলমের ঋণ কেলেঙ্কারি তদন্তের নির্দেশ দেয়। কিন্তু হাইকোর্টের রুল জারির পরও অর্থ পাচার থামানো যায়নি। মাঝে আদালত এস আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত করা যাবে না এই মর্মে রুলও জারি করে।
এস আলম গ্রুপ শুধু অর্থপাচারেই (Money Laundering) সীমাবদ্ধ ছিল না; সরকারী প্রজেক্টগুলোতেও একক প্রভাব দেখিয়ে কাজ আদায় করা, ঘুষ (Bribery) দিয়ে চাকরী, দখল দারী (Land Grabbing), এবং জমি দস্যুতা করাসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত ছিল। সরকার ও প্রশাসনকে নিজের মামা বাড়ি মনে করে যা খুশি তাই করে গিয়েছে এই গ্রুপ।
পরিশেষে
এস আলমের মতো সিন্ডিকেট (Syndicate) বিদ্যুৎ (Electricity) থেকে প্রশাসন (Administration) সব লুটেপুটে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করেছে। হাজার হাজার কোটি টাকার এই লুটপাট হয়তো নতুন করে পদ্মা সেতুর (Padma Bridge) মতো মেগা প্রজেক্টের (Mega Project) সূচনা করাতে পারতো। তবে নতুন সরকার এস আলমের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে কিনা, সেটাই এখন প্রশ্ন। আমাদের উচিত এই ধরনের অপশক্তির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা, যাতে ভবিষ্যতে কোনো এস আলম গ্রুপ আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
পোস্টটি ভাল লেগে থাকলে লাইক ও শেয়ার করতে ভুলবেন না! পরবর্তী পোস্ট দেখতে চোখ রাখুন বিজনেস ম্যানিয়ায়।