ক্ষমতা, চাঁদা দাবি এবং জমি দখলের লড়াই! | Rongdhonu vs Bashundhara | Business Mania
রংধনু গ্রুপ (Rongdhonu Group)—একটি নাম, যা বাংলাদেশের ব্যবসায়িক জগতে সাফল্য, ক্ষমতা, এবং বিতর্কের মিসিলে গড়ে উঠেছে। ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করে তারা দেশের রিয়েল এস্টেট (Real Estate), কৃষি, এবং খুচরা খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ারে (Player) পরিণত হয়েছে। তবে তাদের ইতিহাস শুধুমাত্র সাফল্যের নয়; জমি দখল, চাঁদা দাবি, এবং শত্রুতার এক নাটকীয় কাহিনি।
এই গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ২০২১ সালে বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কের নাটকীয় মোড়। এক সময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও, তা দ্রুতই শত্রুতায় পরিণত হয়। এর কেন্দ্রে রয়েছে একটি ভাইরাল ভিডিও, যেখানে দেখা যায় রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের পা ধরে মাফ চাইছেন। এই দৃশ্য জনমনে দাগ কেটে যায় এবং তাদের দ্বন্দ্বকে আরও জটিল করে তোলে।
business mania আজকের আলোচনায় আমরা জানব কীভাবে রংধনু গ্রুপের সেই অধ্যায় এখনো প্রাসঙ্গিক, কারণ এই ঘটনা তাদের বর্তমান ব্যবসার দিক নির্ধারণে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। একসময়ের বন্ধুত্ব কীভাবে শত্রুতায় পরিণত হলো এবং এর প্রভাব তাদের ব্যবসায়িক খাতে কতটা গভীর !
রংধনু গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ২০০৮ সালে রংধনু বিল্ডার্স (Rongdhonu Builders) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই প্রতিষ্ঠানটি অল্প সময়ের মধ্যেই রিয়েল এস্টেট (Real Estate) খাতে তার অবস্থান সুদৃঢ় করে। ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে মানসম্পন্ন আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে এটি ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করে। তবে, গ্রুপটির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আরও বড়। রংধনু বিল্ডার্স (Rongdhonu Builders) এর সাফল্যকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ শুরু করে।
২০১০ সালে জ্বালানি খাতে প্রবেশের মাধ্যমে চালু হয় RG Refueling Station & CNG (Compressed Natural Gas), যা সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানির চাহিদা মেটাতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এরপর এক ছাদের নিচে ভোক্তাদের সমস্ত প্রয়োজন মেটাতে ২০১২ সালে চালু হয় মেহেদি মার্ট (Mehedi Mart) । এটি রাজধানীর অন্যতম আধুনিক শপিং মল (Shopping mall) হিসেবে পরিচিতি পায়।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রংধনু এগ্রো অ্যান্ড বেভারেজ (Rongdhanu Agro & Beverage)। মাছ চাষ, দুগ্ধ খামার এবং কৃষি উৎপাদনে এই প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় কৃষকদের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেও প্রশংসিত হয়েছে।
এরপর, ২০১৮ সালে আরবিকা কফি (Arabica Coffee) এবং বাজার শারাবেলা চালু হয়। আরবিকা কফি (Arabica Coffee) দেশের ক্যাফে (Cafe) সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে, যেখানে বাজার শরবেলা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য একত্রে সহজলভ্য করে। একই সময়ে, প্রযুক্তি খাতে প্রবেশ করে RIT। এর উদ্যোগ, যেমন আগুন টেক এবং থান্ডারবোল্ট (Thunderbolt), প্রতিষ্ঠানের বৈচিত্র্যময় উদ্ভাবনকে সামনে নিয়ে আসে।
রংধনু গ্রুপ (Rongdhonu Group) তাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগের মাধ্যমে শুধু আর্থিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নেও কাজ করছে। গ্রুপটির এই বহুমুখী উদ্যোগের পেছনে রয়েছে তাদের দূরদর্শী পরিকল্পনা।
তথ্যসূত্র:
রংধনু গ্রুপের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ।
রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যবসায়িক দর্শন ভবিষ্যত প্রজন্মকে ব্যবসায়ীক সফলতায় উৎসাহিত করবে এতে কোন সন্দেহ নেই ।
রংধনু গ্রুপের নাম যেমন দেশের শিল্প উন্নয়নের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তেমনই এর প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালকদের নাম বিতর্কেও বারবার উঠে এসেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষত বসুন্ধরা গ্রুপের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব এবং বিভিন্ন মামলার কারণে তারা সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে এসেছে ।
একসময় বসুন্ধরা এবং রংধনু গ্রুপের মধ্যে ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। একসময় বসুন্ধরা এবং রংধনু গ্রুপের মধ্যে ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। ২০১৯ সালে তাদের এই সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। ২০২১ সালে, বসুন্ধরার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর রংধনু গ্রুপের নতুন প্রধান কার্যালয়ের উদ্বোধন করেন। দুই গ্রুপ তখন একসঙ্গে ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি পরিচালনাসহ বেশ কিছু যৌথ উদ্যোগে অংশ নেয়।
কিন্তু এই বন্ধুত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। গোপন দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসে। বসুন্ধরার সঙ্গে জমি দখল এবং চাঁদা দাবির অভিযোগ নিয়ে রংধনুর সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে।
২০২৪ সালের মে মাসে খিলক্ষেত এলাকায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা রংধনু গ্রুপ এবং বসুন্ধরা গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্বকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। রংধনু গ্রুপের জমি দখল করার অভিযোগ তোলে বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ অনুযায়ী, বসুন্ধরার পক্ষ থেকে প্রায় ১৫০ জন লাঠি এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে রংধনু গ্রুপের জমিতে হামলা চালায়। তারা নিরাপত্তা কর্মীদের মারধর করে, বিলবোর্ড (Billboard) ভাঙচুর করে এবং ৫০ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে। এমনকি, সিকিউরিটি ইনচার্জের (Security Incharge) মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে জমি ছেড়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়।
এই ঘটনার পর রংধনু গ্রুপ খিলক্ষেত থানায় মামলা দায়ের করে। মামলায় বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর এবং আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়। তবে পুলিশ জানায়, ঘটনাটি তদন্তাধীন এবং এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
এই জমি দখল এবং চাঁদা দাবির অভিযোগ রংধনু গ্রুপের বিরুদ্ধে বসুন্ধরার শত্রুতা প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। এটি শুধু দুই প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, দেশের বৃহত্তর ব্যবসায়িক পরিবেশের জন্যও একটি গুরুতর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। মামলার বিবরণে বলা হয়, আনভীরের নির্দেশে ১০০-১৫০ জন লোক সশস্ত্র অবস্থায় রংধনু গ্রুপের জমিতে ঢুকে নিরাপত্তা কর্মীদের উপর হামলা চালায় এবং বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তদন্ত চললেও এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রফিকুল ইসলামের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে তাকে আনভীরের কাছে ক্ষমা চাইতে দেখা যায়। এরপর থেকেই দুই গ্রুপের মধ্যে শত্রুতা বাড়তে থাকে, যা গণমাধ্যমে একে অপরের বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়।
রংধনু গ্রুপের পরিচালকদের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে, গ্রুপের পরিচালক মিজানুর রহমান মিজানকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (Dhaka Metropolitan Police) গোয়েন্দা শাখা গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে অর্থপাচার, ও নানাবিধ অভিযোগসহ একাধিক মামলা রয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (Criminal Investigation Department) রংধনু গ্রুপের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের তদন্ত শুরু করেছে।
এছাড়া, রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামও বিভিন্ন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। পূর্বে কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে জমি দখল এবং স্থানীয় সন্ত্রাসীদের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তার সঙ্গে স্থানীয় সন্ত্রাসী মোশাররফের বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।
বিতর্ক এবং অভিযোগের দীর্ঘ তালিকা সত্ত্বেও, রংধনু গ্রুপ তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তবে এসব ঘটনার ফলে তাদের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। তারা যদি তাদের বিতর্কিত অধ্যায়গুলো সমাধান করতে না পারে, তবে তাদের অগ্রযাত্রায় এর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
তথ্যসূত্র:
- বিডি নিউজ২৪ (BD News24)
- কালের কণ্ঠ (Kaler Kantho)
- প্রতিদিনের বাংলাদেশ (Protidiner Bangladesh)
তবুও, প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে এবং নানাবিধ সেক্টরে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। বিশেষত, দেশীয় কৃষি ও প্রযুক্তি খাতে তাদের বিনিয়োগ এবং উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার।
তবে, ভবিষ্যতের সফলতার জন্য প্রতিষ্ঠানটির উচিত তাদের বিতর্কিত অধ্যায়গুলোর সমাধান করা। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, আইনি অভিযোগ মোকাবিলা করা, এবং ব্যবসায়িক নৈতিকতা বজায় রাখা ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।
অন্যদিকে, বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে রংধনু গ্রুপের চলমান দ্বন্দ্ব, আদালতে দায়ের করা মামলা, এবং সংবাদমাধ্যমে সংঘর্ষের প্রভাব গুলো , দেশের বৃহত্তর ব্যবসায়িক পরিবেশে একটি বার্তা দিয়ে যায়—ক্ষমতা এবং প্রভাবের অপব্যবহার কেবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাই বাড়ায় না, বরং সাধারণ মানুষের আস্থাকে দুর্বল করে তোলে।
আপনারা কী মনে করেন, রংধনু গ্রুপের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার ভাবনা কী? কমেন্ট সেকশনে আপনার মতামত শেয়ার করবেন।