বদলে যাচ্ছে কোরবানির বাজার | কোরবানির ঈদে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিস্ফোরণ। Qurbani Market is Changing
ঈদের আগমন উপলক্ষে শহরের রাস্তায় জমে ওঠে এক নতুন প্রাণ। ট্রাক থেকে নামছে গরু, শুরু হচ্ছে উৎসবের প্রস্তুতি। কোরবানির ঈদ আসছে, বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে বড় ও আবেগঘন উৎসবগুলোর একটি । খামারিদের বছরজুড়ে শ্রম, কোটি টাকার গরু, মঞ্চে আলোয় সজ্জিত পশুর হাট, আবার কোথাও চোরাই পথে আসা গরুর গল্প। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এই প্রথম কুরবানির ঈদ । তবে দেখা যাবে কি, বাজারের এক ভিন্ন চিত্র ?
বিজনেস ম্যানিয়া’র আজকের ব্লগটিতে থাকছে , কীভাবে বাংলাদেশের খামারিরা ঈদকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতি নেয়, কেন বাজারে গরুর দাম হয় আকাশছোঁয়া এবং কীভাবে প্রযুক্তি বদলে দিচ্ছে কোরবানির চেহারা। আর শুনব সেই সব কোটি টাকার গরু আর ভাইরাল কেলেঙ্কারির পিছনের বাস্তব গল্প।
কোরবানির ঈদ শুধু আচার-অনুষ্ঠান নয়, দেশের অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রতিবছর এই সময়টিতে দেশের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠে হাজার হাজার অস্থায়ী পশুর হাট, খামারগুলো পূর্ণ থাকে প্রস্তুত পশুতে, এবং কয়েক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয় সরাসরি বা পরোক্ষভাবে। ২০২৪ সালে কোরবানির জন্য প্রস্তুত পশুর সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি ৪ লাখ। এর মধ্যে শুধু গরুই ছিল প্রায় ৫০ লাখ, বাকি ছিল ছাগল, ভেড়া ও মহিষ। এসব পশুর ৯০ শতাংশের বেশি দেশেই উৎপাদিত হয়, অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন কোরবানির পশু উৎপাদনে প্রায় স্বনির্ভর।
এই স্বনির্ভরতা এসেছে গত এক দশকে গড়ে ওঠা অসংখ্য গবাদিপশু খামারের মাধ্যমে। দেশে এখন প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার নিবন্ধিত খামার আছে, যাদের বড় একটা অংশ ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা দ্বারা পরিচালিত। তারা সারা বছর ধরে গরু মোটাতাজাকরণ ও লালনপালনে যুক্ত থাকেন। একটি খামার পরিচালনায় দরকার পড়ে পরিচ্ছন্ন শেড, পর্যাপ্ত বাতাস, রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা, ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ,পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য। গরুর খাদ্য হিসেবে খড়, ভুষি, ভূট্টা গুঁড়া, খৈল এবং খনিজ মিশ্রিত ফিড ব্যবহার করা হয়। এখন অনেক খামারই রাসায়নিক না দিয়ে প্রাকৃতিক খাদ্য ব্যবহারে ঝুঁকছে, যাতে পশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও বাজারে আস্থা বাড়ে।
স্বাস্থ্যবিধি ও পশুর চিকিৎসা কোরবানির সময় বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলায় পশু চিকিৎসক নিযুক্ত রয়েছেন, যারা টিকা প্রদান, ডিওয়ার্মিং ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের কাজ করেন। কোরবানির সময় এ কার্যক্রম আরও সক্রিয় হয়, যাতে রোগাক্রান্ত পশু বাজারে প্রবেশ না করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশুর জন্য ‘কিউআর কোড পরিচিতি’ পদ্ধতি ব্যবহার শুরু হয়েছে, যার মাধ্যমে প্রতিটি পশুর স্বাস্থ্য, বয়স ও উৎস সম্পর্কে তথ্য জানা যায়।
কোরবানির পশুগুলোর বেশিরভাগই দেশীয় বা দেশি-বিদেশি সংকর জাতের। বড় আকার ও মোটা দামের কিছু গরু বিশেষ পরিচর্যায় বড় করা হয়, যারা হাটে ‘তারকা গরু’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এই গরুগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ অনেক বেশি। হাটে এলেই অনেকেই গরুর ছবি তোলেন ও ভিডিও করেন, যা অল্প সময়েই ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ নানা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে । যেমন, ‘সুলতান’, ‘বস’, ‘রাজাবাবু’, ‘ধ্রুবতারা’ বা ‘টাইগার’ নামের গরুগুলো বিভিন্ন সময় ভাইরাল হয়ে ব্যাপক আলোচনায় এসেছে। এসব গরুর দাম কখনো কখনো ১৫-২০ লাখ টাকার ওপরে উঠে যায়, যা শুধু কোরবানি নয়, একধরনের স্থানীয় উৎসব পরিবেশও তৈরি করে।
তবে দেশের প্রধান চাহিদা পূরণ করে সেই সব মাঝারি আকারের গরু, যেগুলো সুলভ মূল্যে বিক্রি হয়। কোরবানির মৌসুমে গরু পরিবহন, হাট ব্যবস্থাপনা, খাদ্য সরবরাহ, কসাই ও চামড়াশিল্প মিলিয়ে প্রায় দুই কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে এই পশু অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। পশু বাজারজাতকরণেও এসেছে বিশাল পরিবর্তন। আগে যেখানে শুধু হাট নির্ভরতা ছিল, এখন অনলাইনে গরু বিক্রি বাড়ছে দ্রুত। ২০২৩ সালে অনলাইনে বিক্রি হওয়া পশুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ, যার মোট লেনদেন ছিল প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো খামারিদের সঙ্গে ক্রেতার সরাসরি সংযোগ স্থাপন করছে, যার ফলে দূরদূরান্তের মানুষও গরু কিনতে পারছেন অনায়াসে।
সব মিলিয়ে, কোরবানির ঈদকে ঘিরে যে অর্থনীতি গড়ে উঠে, তা একদিকে যেমন ধর্মীয় ও সামাজিক তাত্পর্যপূর্ণ, অন্যদিকে তেমনি একটি শক্তিশালী কৃষি ও অর্থনৈতিক প্রবাহ। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন ঘটে এই খাতে, যা দেশের মৌসুমি অর্থনীতির সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ঘটনার একটি।
কিন্তু কথা হলো, বাংলাদেশ এখন গবাদিপশু উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবুও কোরবানির সময় গরুর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায় কেনো? ২০২৪ সালের কোরবানির ঈদের আগে দেশের চাহিদা ছিল প্রায় ১ কোটি ৭ লাখ পশু, অথচ প্রস্তুত ছিল প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি। সরবরাহ চাহিদার চেয়ে বেশি থাকলেও গরুর দাম কমেনি, বরং উল্টো বেড়েছে।
এর প্রধান কারণ হতে পারে, খাদ্য সরবরাহ ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া। গরুর খাদ্য যেমন ভূট্টা, খৈল, ভুসি, গমের ভূষি, ঘাস, এসবের দাম এক বছরে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। যেমন, ভূট্টার দাম এক কেজি ১৭ টাকা থেকে বেড়ে ৩৩ টাকায় পৌঁছেছে, আর গমের ভূষির দাম ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর ফলে খামারিদের গরু মোটাতাজা করতে খরচ বেড়েছে অনেক, যার প্রভাব সরাসরি পড়েছে গরুর বিক্রয় মূল্যে।
দাম বাড়ার পেছনে মুদ্রাস্ফীতি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়াও একটা বড় কারণ। এতে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নআয়ের মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যার ফলে বড় গরুর বদলে ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর চাহিদা বেড়ে গেছে। ঢাকার অনেক হাটে দেখা গেছে, বড় গরু পড়ে থাকছে, আর মাঝারি আকারের গরু দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
পরিবহন খরচও গরুর দামের ওপর প্রভাব ফেলেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় গরু এক জেলা থেকে অন্য জেলায় আনতে খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। এই বাড়তি খরচ বিক্রেতারা গরুর মূল্যে যুক্ত করছেন, ফলে শহরের হাটে এসে গরুর দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি দাম বাড়তি হওয়ার পেছনে থাকতে পারে আওয়ামী লীগ সরকার এর অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির ছাপ। সব মিলিয়ে বলা যায়, কোরবানির পশুর দাম শুধু চাহিদা ও সরবরাহের প্রশ্ন নয়। এর সঙ্গে জড়িত খাদ্য খরচ, পরিবহন, সীমান্তনীতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার জটিল বাস্তবতা। স্বনির্ভরতা এলেও, দাম কমাতে হলে এই প্রতিটি পর্যায়ে পরিকল্পিত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ ঘিরে পশুর হাটে প্রতি বছরই কিছু উচ্চমূল্যের গরু ও ছাগল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দেয়। সম্প্রতি এক খামারে ১ কোটি টাকার গরু ‘সুলতান’ এবং ২০ লক্ষ টাকার ছাগল ‘রাজা’র বিজ্ঞাপন ভাইরাল হলে তা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেকেই এমন দামকে অতিরঞ্জিত মনে করে ট্রল ও ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করেন। সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন মিম ও কৌতুক ছড়িয়ে পড়ে, যা ঘটনাটিকে জনসাধারণের মধ্যে হাস্যরসের একটি উপাদানে পরিণত করে।
এই ধরনের উচ্চমূল্যের পশুর প্রচারণা অনেক সময় বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পশুর ওজন বা গুণগত মানের সঙ্গে দাম সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এতে করে সাধারণ ক্রেতারা বিভ্রান্ত হন এবং বাজারে একটি কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা তৈরি হয়।
এছাড়া, কোরবানির পশু দ্রুত মোটা করার জন্য কিছু অসাধু খামারি স্টেরয়েড ও হরমোন ব্যবহার করেন। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির জানান, এই ধরনের কৃত্রিম মোটা করা গরুর মাংস মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতে কিডনি, লিভার ও হরমোনজনিত সমস্যার ঝুঁকি থাকে। এমনকি, গর্ভবতী নারীদের জন্য এটি বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
এই সমস্যা মোকাবিলায় সরকার ২০২৫ সালের ঈদুল আজহা উপলক্ষে ৩,৯৭৮টি পশুর হাটে ১৯,০৯৮টি মেডিকেল টিম মোতায়েন করেছে। তারা পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্টেরয়েড ব্যবহারের চিহ্ন শনাক্তকরণ এবং ক্রেতাদের সচেতন করতে কাজ করবেন। এছাড়া, ৮৩,৬৫৬ জন খামারিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পশু লালন-পালনের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে, কোরবানির পশুর বাজারে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আরও কঠোর নজরদারি ও সচেতনতা কার্যক্রম প্রয়োজন। ক্রেতাদেরও সচেতন হয়ে, যাচাই-বাছাই করে পশু কেনা উচিত।
বাংলাদেশে ২০২৫ সালের কোরবানির ঈদকে ঘিরে সরকার যে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা এই উৎসবকে আরও সুশৃঙ্খল, নিরাপদ এবং সবার জন্য সহজলভ্য করে তুলবে।
এ বছর দেশে মোট ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে, যার মধ্যে ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু ও মহিষ এবং ৬৮ লাখ ছাগল ও ভেড়া। এই সংখ্যা চাহিদার তুলনায় প্রায় ২০ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৫টি বেশি, যা পশুর দামে স্থিতিশীলতা আনবে এবং আমদানির প্রয়োজনীয়তা দূর করবে ।
পশুর হাটে চাঁদাবাজি ও অতিরিক্ত দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সীমান্তে পশু চোরাচালান রোধে বিজিবি, পুলিশ ও জেলা প্রশাসন সমন্বিতভাবে কাজ করবে । সবকিছুর পরেও প্রশ্ন রয়ে যায়, ঈদ এর সময় গরুর দাম এত বেড়ে যায় কেন? দায়ী আসলে কে? আপনার মতামত অবশ্যই কমেন্টে লিখে জানাবেন। গরু কিনেছেন, নাকি এখনও ভাবছেন? আজকের ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে আমাদের ওয়েবাসাইটে এ-মেইল সাবস্ক্রাইব করতে ভুলবেন না। আসসালামু আলাইকুম।