শ্রমিকের ঘামে গড়া ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা | প্রাণ আর এফ এল | PRAN RFL | Business Mania
“প্রাণ আর এফ এল (PRAN-RFL)—বাংলাদেশের একমাত্র ব্র্যান্ড (Brand), যা ১৪৫টিরও বেশি দেশে পণ্য রপ্তানি করে। রংপুরের ছোট্ট এক ব্যবসায়িক উদ্যোগ কীভাবে আজ দেশের শীর্ষ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে (Multinational Company) পরিণত হলো? তবে সাফল্যের এই গল্প কি সম্পূর্ণ নির্মল, নাকি এর আড়ালে রয়েছে শ্রমিক অধিকারের সংকট, পরিবেশ দূষণ, এবং বিতর্কিত ব্যবসায়িক কৌশল?
আপনাকে যদি বলা হয় আমাদের দেশেই এমন একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে যেটা শুরু হয়েছিল একজন ব্যক্তির শুধুমাত্র পেনশনের টাকা দিয়ে আর বর্তমানে যেটার কিনা বাৎসরিক আয় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ছাড়িয়েছে!
Business Mania R আমাদের আজকের ভিডিওটি দেশের সর্ব প্রথম মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি (Multinational Company) প্রান আর আর এল লিমিটেড কোম্পানিকে (PRAN RFL Limited Company) নিয়ে। ঠিক কীভাবে এই প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে, কীভাবে দেশের গন্ডি পেরিয়ে প্রতিষ্ঠান পৌছে যায় বিশ্ব এর আরো প্রায় ১৪৫টি দেশে।
প্রাণ আর এফ এলের প্রতিষ্ঠাতা হলেন জনাব আমজাদ খান চৌধুরী। যিনিই কিনা তার পেনশনের টাকা আর স্ত্রীর পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া কিছু জমিজমা দিয়েই প্রাণ আর এফ এলের প্রতিষ্ঠা করেন।
আমজাদ খান চৌধুরী ছিলেন একজন অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল (Major General)। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়গুলোতে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হাতে গোনা যেকজন মানুষ সবথেকে বেশী ভূমিকা পালন করেছেন আমজাদ খান চৌধুরী তাদের একজন।
আমজাদ খান চৌধুরী জন্মগ্রহন করে নাটোর জেলাতে ১৯৩৯ সালের ১০ই নভেম্বর। তার পিতার নাম ছিল আলী কাশেম খান চৌধুরী আর মাতার নাম আমাতুর রহমান। ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউট (Nabakumar Institution) থেকে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। এরপর তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (Pakistan Military Academy) আর অস্ট্রেলিয়ান স্টাফ কলেজ (Australian Staff College) থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
আমজাদ খান চৌধুরী তার কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সেনবাহিনীতে যোগদানের মধ্য দিয়ে। এরপর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীনতা লাভ করলে তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এরপর পালাক্রমে তিনি বগুড়া ক্যান্টমেন্ট (Bogura Cantonment) আর রংপুর ক্যান্টমেন্ট (Rangpur Cantonment) এ দায়িত্ব পালন করেন। মুলত এই সময়টাতেই তিনি উত্তরবঙ্গের কৃষকদের দুর্দশা নিজ চোখে দেখতে পান। খরা আর সেচের পানির অভাবে যে রংপুর সহ দেশের উত্তরবঙ্গের কৃষিখাত ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল এটা তিনি এই সময়টাতেই বুঝতে পারেন।
এরপর ১৯৮১ সালে মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি মেজর জেনারেল (Major General) হিসেবে আর্মি (Army) থেকে অবসর গ্রহন করেন। কিন্তু অবসর গ্রহনের পর নিজের পেনশনের টাকা দিয়ে তিনি আরাম আয়াশে দিন পার করতে পারলেও তা তিনি করেন নি। নিজের পেনশনের টাকা আর স্ত্রীর পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমি বিক্রি করে আর ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মার্চ এই “ আর এফ এল (RFL)’ নামের কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন।
“আর এফ এল (RFL)” পুরো নাম হলো রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (Rangpur Foundry Ltd)। রংপুর অঞ্চলের মানুষের পানির সমস্যা পুরণের জন্য কোম্পানিটি প্রাথমিক ভাবে স্বল্প মুল্যে টিউবওয়েল (Tubewell) আর কৃষি কাজের জন্য আর এফ এল পাম্প (RFL Pump) নামে সেচ পাম্প বানাতে শুরু করে। সেই সাথে শুরু করেন আবাসন ব্যবসা। যদিও পরে আর আবাসন ব্যবসাটি তিনি আর চলমান রাখেন নি। তবে আর এফ এল এই প্রাথমিক দুটি পণ্য আর এফ এল টিউবওয়েল (RFL Tubewell) এবং আর এফ এল পাম্প (RFL Pump) অল্প সময়ের মধ্যেই রংপুর ছাড়িয়ে গোটা দেশের মধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এমনকি আজ প্রায় ৪৫ বছর পরে এসেও এ দুটি পণ্যের জনপ্রিয়তা একদমই কমে নি। এখনো শহুরে বাসাবাড়িতে থেকে শুরু করে কৃষিক্ষেত্রে পণ্য দুটির ব্যাপক চাহিদা লক্ষ্য করা যায়।
কোম্পানি প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মাথাতেই এর জনপ্রিয়তা দেখে আমজাদ খান নজর দেন সরাসরি কৃষি পণ্য উতপাদনের দিকে। এরই হাত ধরে ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করে প্রাণ এগ্রো লিমিটেড (Pran Agro Limited)। প্রাথমিক ভাবে নরসিংদীতে জমি ইজারা নিয়ে তিনি শুরু করলেন কলা, পেঁপে আর রজনীগন্ধ্যার চাষ। এরপর তিনি এগুলো ঢাকায় এনে বিক্রি করা শুরু করলেন। কিন্তু এবার আমজাদ খান চৌধুরী কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হোন।
তিনি খেয়াল কৃষি পণ্যের দাম আসলে মৌসুমের উপর ব্যাপক ভাবে নির্ভর করে। সিজন শেষ হতেই এইসব পণ্যের চাহিদা আর দাম দুটোই বাজে ভাবে কমতে শুরু করে। এছাড়া ঠিক ভাবে সংরক্ষন করা না গেলে কিছু দিনের মাথাতেই এইসব পণ্য পঁচতে শুরু করে। তাই কৃষি পণ্য থেকে চোখ সরিয়ে তিনি নজর দেন কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের দিকে।
এরপর থেকে তিনি কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করা শুরু করেন। ধীরে ধীরে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা দেশের বাজার গুলোতে দেখা দেয়। এরই হাত ধরে প্রাণ আনারস প্রক্রিয়াজাত করে সেগুলো বাজারে বিক্রি করা শুরু করে। সেসময় প্রক্রিয়াজাতকৃত আনারসের ব্যাপক একটা চাহিদা ছিল ফ্রান্সে (France) । এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েই প্রাণ ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মতো ফ্রান্স (France) প্রক্রিয়াজাতকৃত আনারস রপ্তানি করা শুরু করেন।
সেই থেকেই শুরু বর্তমানে প্রান আর এফ এল (PRAN-RFL) বিশ্বের প্রায় ১৪৫টি দেশে নিজেদের পণ্য রপ্তানি করে থাকে। এমনকি বিশ্বের অনেক দেশ যেখানাকার মানুষ বাংলাদেশকেও ঠিক সেভাবে চিনে না সেসব দেশেও প্রাণ আর আফ এল (PRAN-RFL) তাদের পন্য রপ্তানি করে থাকে।
শুধুই তাই নয় শুরুতে প্রান আর এফ এল (PRAN-RFL) কেবল রংপুর আর হবিগঞ্জ কারখানা দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করলেও । বর্তমানে দেশের প্রায় ১৩টা জেলায় তাদের রয়েছে ২৫টির ও অধিক নিজস্ব কারখানা।
এছাড়াও নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর, চাপাইনবাবগঞ্জ,নওগা, হবিগঞ্জ ,সিলেটসহ আরো বেশ কিছু জেলাতে প্রানের রয়েছে এগ্রো বিজনেস কন্ট্রাক ফার্মিং (Agro Business Contract Farming)। এসব জেলাতে প্রান একদম তৃনমূল পর্যায়ের কৃষকদের সাথে সরাসরি কাজ করে থাকে। প্রাণ এসব জেলার কৃষকদের থেকে চুক্তি ভিত্তিতে তাদের কাঁচামাল ক্রয় করে থাকে। বিনিময় কৃষকদের নানারকম কৃষি রিলেটেড (Related) সহায়তা, প্রশিক্ষ্ন এসব বিনামূল্য দিয়ে থাকে।
চলুন প্রিয় দর্শক এবার জানা যাক প্রাণ আর এফ এল (PRAN-RFL) কতটা ব্যাপক হারে তাদের পন্য বাজার জাত করে থাকে। বাংলাদেশ মোট কমডেটি পণ্যের বাজারের ৬৫% ই প্রাণের দখলে। সেই সাথে বাজারে একটা কথাও প্রচলিত আছে যে এমন আসলে কোন পণ্য নেই যেটা প্রাণ তৈরী করে না।
প্রাণ আর এফ এলের অধীনে রয়েছে প্রায় ৫০টির অধিক জনপ্রিয় সব ব্রান্ড (Brand)। এর মধ্যে রয়েছে VISION, ,দুরন্ত বাইসাইকেল (Duranta Bicycle), সেরা, রয়াল ফার্নিচার (Royal Furniture), গুড লাক (Good Luck), ক্লিক (Click) আর সাইনের মধ্যে জনপ্রিয় সব ব্রান্ড।
একটি হিসেবে প্রাণ আর এফ এল (PRAN-RFL) প্রায় ৬৫০০টির মতো পন্য তৈরী করে থাকে এর মধ্যে প্রাণের ১০টা ক্যাটাগরিতে (Category) আছে প্রায় ৮৫০টি পণ্য আর আর এফ এলের ১৫টি ক্যাটাগরিতে আছে প্রায় ১ হাজার ৫০০টি পণ্য।
তবে ২০১৫ সালের জুলাই এসে প্রাণ আর এফ এল (PRAN-RFL) একটা বড় ধাক্কা খায়। কেননা ২০১৫ সালের ৮ই জুলাই প্রান আর এফ এলের প্রতিষ্ঠাতা আমজাদ খান চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ২০১৬তে এসে আমজাদ খানের ছোট ছেলে আহসান খান চৌধুরী বাবার প্রাণ আর এফ এলের চ্যায়ারম্যান (Chairman) আর সিইও (CEO) হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপরই প্রাণ তার পুরোনো গতি আবার ফিরে ফিরে প্রায়।
২০১৫ সালের আগে যেখানে প্রান আর এফ এলের কর্মী সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ হাজার এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার। এছাড়াও প্রায় ৭ লক্ষ কৃষক প্রানের সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িতে যারা তাদের কৃষি পণ্য কাচামাল হিসেবে প্রাণের কাছে বিক্রি করে থাকে। সব মিলিয়ে প্রান আর এফ এল প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। আর দেশের মধ্যে একক কোন কোম্পানি (Company) হিসেবে সর্বোচ্চ।
তবে প্রাণ আর এফ এলকে নিয়ে সেখাকার কর্মরত শ্রমিকদে্রো অভিযোগের শেষ নেই।
যেমন চলতি বছর ২০২৪ এই প্রাণ আর এফ এলের তিনটি পৃথক পৃথক কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১০ই এপ্রিল হবিগঞ্জ কারখানায়, ২৩ই আগস্ট কুমিল্লাতে আর ৩০ই আগস্ট নরসিংদীতে। এর মধ্যে কুমিল্লা আর নরসিংদীতে কোন হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও হবিগঞ্জের দুর্ঘটনাতে ৩৫ জন শ্রমিক ভাবে আহত হন এবং একজন নারী শ্রমিক নিহত হন।
এছাড়া বেতন ভাতা বৃদ্ধি, ওভারটাইম (Overtime) সহ নানা ইস্যু নিয়ে প্রায় দুমাস প্রান আর এফ এলের শ্রমিকেরা আন্দোলন করে। এসময় তারা ৩০ দফা দাবী উত্তোলন করেন। আন্দোলনরত শ্রমিকদের ভাষ্য মতে দিনে তাদের প্রায় ১২ থেকে সাড়ে ১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। এরপরো তাদের মাত্র ১২ হাজার টাকা মজুরি দেওয়া যায়। যেটা দিয়ে পরিবার নিয়ে বর্তমান সময়ে চলা সম্ভব নয়। যেখানে অন্য সব কোম্পানিগুলো মাত্র ৭ ঘন্টা কাজের বিনিময়েই ১২ হাজার টাকার মতো বেতন দিয়ে থাকে। যার ফলে প্রতিনিয়ত অনেক শ্রমিকই জীবিকার তাগিদে অন্য কারখানাগুলোতে চলে যাচ্ছে।
যার প্রভাব ও তাদের উপর এসে পরছে। আগে যেই কাজ ৫ জন শ্রমিকে করতো সেই কাজ এখন ৩ জন শ্রমিকের করা লাগে। ফলে কাজের লোড বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে নানা রকম দুর্ঘটনা। এছাড়া কাজের লোড বাড়লেও বেতন বাড়ানো হয় নি। শুধু তাই নয় ভেজাল ক্যামিকেল ব্যবহার করার কারনে তাদের সবাস্থ্য ঝুকিও বাড়ছে।
এছাড়াও প্রিয় দর্শক প্রান আর এফ এলের পণ্য আমাদের পরিবেশের উপরও বাজে প্রভাব ফেলছে। প্রান আর এফ এলের বেশির ভাগ পণ্য প্লাস্টিক জাতীয়। যেগুলো মাটিতে সহজে মিশে না। ফলে মাটির উর্বরতাও নষ্ট হয়। শুধু তাই নয় এই সমস্যা সমাধানে প্রান আর এফ এল প্রতিষ্ঠানকেও কখনো কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায় নি।
এছাড়া প্রাণ ব্যাপক হারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে তাদের কাচামাল সংগ্রহ করে থাকে। তারা নানারকম শর্তের ফাদে ফেলে প্রান্তীয় কৃষকদের তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করে। ফলে অনেক সময় কৃষকরা যেমন ন্যায্য মূল্য পায় না। তেমনি ছোট খাটো লোকাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রাণ আর এফ এলের ব্যবসায়িক প্রতিযোগীতায় পেরে উঠে না।
ফলে দেশীয় পণ্যের বাজারগুলোতে প্রানের একচ্ছত্র অধিপতি দেখা যায়। যা দেশের সাধারন ক্রেতাদের জন্য যেমন সুখকর নয় তেমনি দেশের অর্থনীতির জন্যও খারাপ।
প্রিয় দর্শক এতো গেলো প্রাণ আর এফ এলের কথা। আপনার পছন্দের প্রাণ আর এফ এলের পণ্য কোনটি? আর কোন পন্যটি আপনি ব্যবহার করতে সবথেকে বেশি পছন্দ করেন তা আমাদের জানাতে কিন্তু ভুলবেন না।
সো প্রিয় দর্শক আজকের ভিডিও এই অব্দি। । ভিডিওটি ভালো লাগলে লাইক দিন এবং কমেন্ট করুন। আর কোন কোন টপিকের উপর ভিডিও দেখতে চান তাও আমাদের জানান আর এরকম আরো ভিডিও দেখতে চাইলে, চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে বেল বাটন্টি প্রেস করে রাখুন। দেখা হবে নেক্সট কোন ভিডিওতে।