সত্যি কি বন্ধের পথে নাবিস্কো? কতদূর টিকবে গ্রাহকদের ধৈর্য? | Nabisco Buscuits
১৯৫০ সালের ঢাকা, তেজগাঁও শিল্প এলাকা তখনও ঠিক জমে ওঠেনি। চারদিকে ছোট ছোট কারখানা, কাঁচা রাস্তা, আর ভাঙা ভাঙা পাকা ভবন। ঠিক এই পরিবেশেই জন্ম নেয় এক ছোট্ট কারখানা, নবিস্কো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি লিমিটেড, যেটা সময়ের সঙ্গে হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম পরিচিত নাম।
বাংলাদেশে Nabisco দ্বিতীয় বৃহত্তম বিস্কুট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। আশ্চর্যের বিষয় হলো, নবিস্কোর কোনো সিস্টার কনসার্ন নেই, অর্থাৎ এরা এককভাবেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
Business Maniar, আজকের ব্লগে আমরা খুঁজে দেখব, নবিস্কো কীভাবে গড়ে উঠল, কেমন ছিল তাদের পথচলা, আর কিভাবে একটা বেকারি ধীরে ধীরে হয়ে উঠল দেশের অন্যতম বিস্কুট ও পাউরুটি প্রস্তুতকারক হিসেবে ।
Nabisco Biscuit and Bread Factory বাংলাদেশের বেকারি শিল্পের অন্যতম প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার আগে এটি পাকিস্তানের প্রশাসনের অধীনে ছিল । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অন্যান্য শিল্পকারখানার মতোই Nabisco-এর কার্যক্রমেও বিঘ্ন ঘটে। কাঁচামালের সংকট, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, বিদ্যুৎ ঘাটতি এবং যুদ্ধকালীন ঝুঁকির কারণে অনেক সময় উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। তবে যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনায় Nabisco আবার ঘুরে দাঁড়ায়।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ১৯৮৩ সালে, যখন Nabisco পুরোপুরি বেসরকারি মালিকানায় রূপান্তরিত হয়ে “Nabisco Biscuit & Bread Factory Limited” নামে একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। ৮০ ও ৯০-এর দশকে ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে এটি বেকারি শিল্পের একমাত্র বাজার নেতা হিসেবে পরিচিত ছিল।
১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে Nabisco Glucose বিস্কুট বাংলাদেশে একটি জনপ্রিয় টিফিন ক্লাসিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। সেই সময় নবিস্কো ছিল দেশের অন্যতম অগ্রণী বিস্কুট ও পাউরুটি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। তবে ২০০০ সালের পর থেকে বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যায় এবং নবিস্কোর একচেটিয়া অবস্থান ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বর্তমানে নবিস্কো দেশের বিস্কুট ও ব্রেড বাজারে প্রায় ৮% মার্কেট শেয়ার ধরে রেখেছে, যা বাংলাদেশের বিস্কুট ও ব্রেড শিল্পের মোট আনুমানিক ৬,০০০ কোটি টাকার বাজারের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা ২৫ টির অধিক পণ্যের লাইন নিয়ে কাজ করছে ।
তাদের পণ্যের তালিকায় রয়েছে বার্লি, এলাচি, গ্লুকোজ, মারি ও নানা স্বাদের ক্রিম বিস্কুট, যেমন মিল্ক, লেমন, পাইনঅ্যাপল ও চকলেট। পাশাপাশি নাবিস্কোর বেকারি আইটেম যেমন স্পেশাল কেক, মিল্ক ব্রেড ও সুইট টোস্ট, এবং কনফেকশনারি যেমন স্ট্রবেরি, ম্যাঙ্গো ও স্পাইসি ক্যান্ডিও ভোক্তাদের মধ্যে জনপ্রিয়। পণ্যের বৈচিত্র্য ও মানের জন্য নাবিস্কো দেশের বিস্কুট শিল্পে আজ একটি বিশ্বস্ত নাম।
বাংলাদেশের বিস্কুট ও ব্রেড শিল্প গত কয়েক বছরে প্রতি বছর গড়ে ১২ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধির হার দেখিয়েছে। দেশজুড়ে ১০০-এর অধিক স্বয়ংক্রিয় বেকারি কারখানা এবং প্রায় ৪৫০০ স্বল্প-ব্যয়ের ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট চলছে, যা দেশের বিস্কুট উৎপাদন ও বিতরণকে ব্যাপক পরিসরে সমর্থন করছে।
এই শিল্পের শীর্ষে অবস্থান করছে Olympic Industries Limited। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের বৃহত্তম বিস্কুট ও বেকারি প্রস্তুতকারক এবং তাদের Energy Plus, Tip, Nutty-এর মতো জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের মাধ্যমে তারা প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করে। Olympic Industries সর্বাধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি, ব্যাপক বিনিয়োগ ও বিস্তৃত বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বাজারে দাপট বজায় রেখেছে। অন্যদিকে Pran বিস্কুট বাজারে প্রায় ৮% শেয়ার নিয়ে রয়েছে। তারা ২০১২ সালে বিস্কুট শিল্পে প্রবেশ করলেও দ্রুত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পদার্পণ করেছে এবং তাদের পণ্য মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকা সহ প্রায় ১৪৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
তাছাড়া, Haque Group, Danish, Al‑Amin এবং Bengal Biscuit Ltd. মত প্রতিষ্ঠানও তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে, এদের প্রত্যেকের বাজার শেয়ার প্রায় ৩ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে। নতুন করে Akij, Meghna, Bashundhara এর মতো বড় ব্যবসায়ীরা এই শিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে, যা ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র করবে।
সারসংক্ষেপে, নবিস্কো এখনো দেশের বিস্কুট ও ব্রেড শিল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে, তবে আধুনিক প্রযুক্তি ও নতুন পণ্যের উদ্ভাবন ছাড়া তারা বাজারে আরও এগিয়ে যেতে পারবে না। Olympic Industries ও Pran–RFL-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়ে আধুনিকায়নের মাধ্যমে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। নবিস্কোর জন্য সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় স্বয়ংক্রিয়তা আনা, নতুন ধরনের পণ্য নিয়ে আসা এবং রপ্তানি ক্ষেত্রে প্রবেশ করানো, যাতে তারা আবার শীর্ষ স্থানে উঠে আসতে পারে। নবিস্কোর নিজস্ব ও স্বাধীকার সিস্টেমে প্রায় ১৭২‑২০০ জন ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছে , যা গ্রামীণ বাজারে তাদের উপস্থিতিকে নিশ্চিত করে। তারা ৫০টিরও বেশি পণ্যের লাইন বজায় রেখেছে, যার মধ্যে বিস্কুট, পাউরুটি, ক্যান্ডি, কেক ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত । বর্তমানে নবিস্কোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন মো. আবদুল কাদের, যিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক কার্যক্রম দেখছেন ।
এছাড়া বোর্ডে রয়েছেন আরও কয়েকজন পরিবারের সদস্য ও কয়েকজন পেশাদার, যাদের কাজ মূলত উৎপাদন, বিতরণ, এবং আর্থিক প্রশাসন তদারকি করা।
বাংলাদেশের ভোজ্যপণ্য ও বিস্কুট শিল্পে Nabisco এখনো একটি পরিচিত নাম হলেও, প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সস্তা আমদানিকৃত চীনা ও ভারতীয় বিস্কুট বাজারে ঢুকে পড়ায় স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে। Nabisco এখনো গ্রামীণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখেছে মূলত শক্তিশালী ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কের কারণে। তবে ব্র্যান্ডটি অনেকটাই পুরনো ধারার হয়ে পড়েছে, এবং পণ্য উন্নয়ন বা আধুনিক প্রচারে তেমন উদ্যোগ নেই।
নবিস্কো বিস্কুট ফ্যাক্টরিকে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এক লাখ টাকার জরিমানা করেছে। ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩‑এ পরিচালিত অভিযানে, কারখানার অভ্যন্তরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, কর্মচারীদের স্বাস্থ্য সনদ ও কীটনাশক নিয়ন্ত্রণের সনদ প্রদর্শনে ব্যর্থতা, এসব অপরাধে তাদের ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় ।
তবে, এটি নবিস্কোর প্রথম দফার জরিমানা নয়। অতীতে তাদের বেশ কিছুবার BSTI চিহ্নদিয়ে অনুমোদনহীন পণ্য বিপণনের দায়ে এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ/মেয়াদ না দেখানোর অভিযোগেও দায়ের করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে তিন কর্মকর্তা অনুমোদনহীনভাবে BSTI চিহ্নযুক্ত বিস্কুট ও চকোলেট বাজারজাত করায় প্রত্যেককে ৯৫,০০০ টাকা জরিমানা করা হয় । এছাড়া ২০০৫ সালেExpiry date উল্লেখ না করার কারণে তাদের ১ লাখ টাকা জরিমানা এবং একই অভিযানের পর অগ্রগতি হলেও অনেক প্যাকেটে মেয়াদ না থাকায় সেই রানেও জরিমানা করা হয়েছিল ।
এসব ঘটনা নির্দেশ করে যে, খাদ্য নিরাপত্তা ও প্যাকেজিং মানদণ্ডে তাদের দীর্ঘদিনের কিছু পরিপন্থিতা রয়েছে। এখানে নবিস্কোর মতো প্রতিষ্ঠান টিকে আছে মূলত স্থানীয় চাহিদা আর ডিস্ট্রিবিউশন দক্ষতার উপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশের প্রতিটি গলির মোড়ে আমরা যেসব বিস্কুট দেখি, তার পেছনে লুকিয়ে থাকে দশকের পর দশক ধরে তৈরি হওয়া একেকটা শিল্প প্রতিষ্ঠান। নবিস্কো ঠিক তেমনই এক প্রতিষ্ঠান ।
আপনার এলাকায় বর্তমানে নবিস্কোর চেয়ে কোন কোম্পানির বিস্কুট বেশি জনপ্রিয় বা বিক্রি হয় বলে মনে হয়?
নিচে কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না ।
ব্যবসায়িক জগতের সব প্রভাবশালী কোম্পানির ব্লগ পড়তে আমাদের ওয়েবসাইটে ই-মেইল সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথেই থাকবেন, ধন্যবাদ।