টানা ঋণ আর দুর্নীতির গল্প : কেয়া কসমেটিকস | Keya Group Downfall | Business Mania
৯০ দশকের দিকে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোর মধ্য সবথেকে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ইত্যাদি। মাসের দুটো শুক্রবারে রাত ৮টার বাংলা সংবাদের পর বিটিভিতে প্রচারিত হতো এই অনুষ্ঠান। আর টিভির পর্দার ইত্যাদি শুরু হলেই পরিবারের একদম শিশু থেকে বয়স্করা অব্দি টিভির সামনে বসে যেত। ইত্যাদির হাত ধরে সেসময় আরো একটি জিনিস বাংলাদেশ এ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে, সেটা হলো কেয়া কসমেটিক্স লিমিটেড এর কেয়া সাবান আর ডিজার্নেট। দারুন সব বিজিএম আর বড় পরিসরে শুটিং হওয়ায়, কেয়া কসমেটিক্স এর বিজ্ঞাপনগুলোও মানুষের মনে আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের পর থেকে কেয়ার কোন বিজ্ঞাপনই আর টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখা যায় নি।
সেই সাথে গত দুই জানুয়ারি কেয়া একটা প্রজ্ঞাপন জারি করে জানায় যে আগামী ১ মে থেকে তারা তাদের ৪টি কারখানা স্থায়ী ভাবে বন্ধ করে দিবে। সেই সাথে কেয়া গ্রুপের চ্যায়ারম্যান আব্দুল খালেক পাঠানের উপর টাকা আত্মসাৎ এবং দুদকের মামলার খবর সকলের সামনে আসে।
প্রিয় দর্শক Business Maniar আজকের ভিডিওটি আমাদের এই কেয়া গ্রুপের উপরই। ঠিক কি কারণে কেয়া গ্রুপের মতো একটা বড় প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ী ভাবে বন্ধ হতে হচ্ছে। আর কেনই বা বলা হচ্ছে কেয়া একা ডুবে নাই ডুবেছে আরো ১২টি ব্যাংককে নিয়ে।
বাংলাদেশে যতগুলো কমিডিটির মার্কেট রয়েছে তার মধ্যে কসমেটিক্স আর মার্কেট ভ্যালুয়েশন অনেক বেশী। আর এই ব্যাপারটাকেই বুঝতে পেরে কেয়া গ্রুপের চ্যায়ারম্যান আব্দুল খালেক পাঠান এই ব্যবসায় নামেন।
যদিও ১৯৮৩ সালের দিকে তিনি খালেক এন্ড কো নামের একটা কোম্পানি চালু করেন। যেটার মূল কাজ ছিল ইটের ব্যবসা করা। তবে কসমেটিক্স এর মার্কেটের গ্রোথ বুঝতে পেরে তিনি ১৯৮৬ সালে প্রায় ১২ কোটি টাকা ইনভেস্ট করে গাজিপুরে একটা কারখানা চালু করে সাবান প্রস্তুত করা শুরু করেন৷
ঠিক তার পরের বছর, কেয়া কসমেটিক্স নামের একটা সিটার কোম্পানি খুলে কমার্শিয়াল ভাবে বিউটি সোপ প্রডাকশন করা শুরু করেন। পরবর্তীতে খালেক এন্ড কো এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন কেয়া গ্রুপ ওফ ইন্ডাস্ট্রিস।
প্রাথমিক ভাবে কেয়া গ্রুপ ওফ ইন্ডাস্ট্রির অধীনে চারটি বিজনেজ শুরু করা হয়, কেয়া কসমেটিকস, নিট কম্পোজিট ডিভিশন , স্পিনিং ডিভিশন আর কোটন ডিভিশন। এর মধ্যে কেয়া কসমেটিকস এর অধীনে কেয়া সোপ ক্যামিকেলস আর কেয়া ডিটারজেন্ট নামের আলাদা দুটি সাব কোম্পানি চালু করা হয়।
এরমধ্যে ১৯৯৮ সালে কোম্পানিটি শুরু করে স্পিনিং বিজনেজ, কেয়া কটন মিলিস, কেয়া নিট কোম্পজিট, আর কেয়া ইয়ার্ন মিলস। এসব কোম্পানিতে মূলত রেডিমেট গার্মেন্টস এর জন্য কোটন তৈরী করা শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে এই সবগুলো কোম্পানিকে কেয়া কসমেটিকস এর অধীনে নিয়ে আসা হয়।
প্রথম দিকে কেয়া বাজারে শুধু কেয়া বিউটি সোপ বাজারে আনলেও ধীরে ধীরে বিভিন্ন সাইজের, আর ফ্রেগনেন্টের সোপ বাজারে আনতে শুরু করে। বিভিন্ন ক্যাটাগরির কাস্টমারদের টার্গেট করে বিভিন্ন ধাচের সোপ বাজারের আনার এই স্ট্রাটিজিটা বেশ ভালো ভাবেই কাজ করে।
যেমন ঐ সময়টাতে কেয়ার হেলথ ক্যাটাগরিতে বাজারে আনা লাইফগার্ড সাবান, ইউনিলিভার এর লাইফবয় এর সাথে বেশ ভালোই টক্কর দিচ্ছিল।
এছাড়াও দেশের গ্রামীন অঞ্চহলের মানুষদের টার্গেট করে কেয়া তাদের কেয়া বিউটি সোপ অপেক্ষাকৃত ৭ থেকে ১০% কম দামে বাজারে আনে। যার ফলে লাক্স কিংবা এই টাইপ সাবানগুলো সড়িয়ে কেয়া গ্রাম বাংলার সাধারন মানুষের কাছে বেশ ভালোই একটা জায়গা করে নেয়।
ধীরে ধীরে কেয়া আরো কিছু পণ্য যেমন কেয়া বল সাবান, কেয়া ডিটারজেন্ট, কেয়া পেট্রোলিয়াম জেলি, লিপ জেল ও বাজারে আনে।
ধীরে ধীরে ২০১০ সালের দিকে কসমেটিক মার্কেট এর প্রায় ১৬% চলে যায় কেয়া গ্রুপের অধীনে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল কেয়ার জন্য বেশ ভালোই ছিল। তেমন কোন লোকশানের মধ্যেও তাদের পরতে হয় নি। এরই মধ্যে ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের দিকে বাংলাদেশ এ গার্মেন্টস শিল্পের একটা বেশ গ্রোথ দেখা দিলে কেয়া গ্রুপ গার্মেন্টস শিল্পেও নামে।
আর এই ডিসিশনটাই কেয়া গ্রুপ ওফ ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটা কাল হয়ে দাঁড়ায়। শুরুর দিকে ভালো করলেও ২০১০ সালে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের কেয়ার একটা এক্সপোর্ট অর্ডার ক্যানসেল হয়ে যায়৷ যার ফলে বেশ বাজে রকমের একটা ধাক্কা খায় প্রতিষ্ঠানটটি। সেই সাথে পরে যায় ঋণের চক্করে।
রিপোর্ট থেকে জানায় যায় এই অর্ডারটির জন্য শুধুমাত্র সাউথ ইস্ট ব্যাংক থেকেই প্রায় ২১৬ মিলিয়ন টাকার একটা বিশাল ঋন ন্যায় প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়াও পরবর্তীতে বাজারে নতুন পণ্য না আনা, পুরাতন পণ্যের মোড়ক পরিবর্তন না করা, শুধু টিভি বিজ্ঞাপন নিয়েই পরে থাকা এসব কারণে কোম্পানিটি নতুন নতুন কাস্টমারকে আকৃষ্ট করতে তো ব্যার্থ হয়ই, পুরনো কাস্টমারদের কেও হারায়।
যার ফলে মাত্র ৫ বছরের মাথায় ২০১৫ সালে কোম্পানিটির মার্কেট শেয়ার ১০% থেকে কমে দাঁড়ায় ৫% এ। এছাড়াও ২০১২–১৩ অর্থ বছরে যেখানে তাদের মোট টার্নওভার ছিল প্রায় ২৮০ কোটি টাকা ২০১৬ সালে এসে তা কমে দাঁড়ায় অর্ধেক এ মাত্র ১৪০ কোটি টাকা।
তবে ২০১৬ এর পর থেকে কোম্পানি পুনরায় ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করে, জানা যায় ২০১৬ থেকে ২০ এই কয়েক বছর এ কোম্পানিটি নতুন ১০টি পণ্য বাজারে আনে, টয়েলট ক্লিনার, টয়েলেট টিসু, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ড ওয়াশ, টুথপেষ্ট।
এছাড়াও ২০১৯-২০ অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার Z ক্যাটাগরি থেকে B ক্যাটাগরিতেও উঠে আসে। তবে এসবই করা হয় ব্যাংক থেকে অবৈধভাবে ভাবে লোন নিয়ে।
বর্তমানে কেয়া গ্রুপের উপর রয়েছে ৩০০০ কোটি টাকার ও বেশি ঋণের বোঝা। এর মধ্যে শুধু South East ব্যাংক থেকেই প্রায় ১৬০০ কোটি টাকার বেশি লোন নেয় কেয়া গ্রুপ।
তবে ২০১২ সালে লোন ডিফ্লটডার এর লিস্টে নাম আসার পর এবং ২০১৯ সালে শীর্ষ ১০টি লোন ডিফ্লটডার প্রতিষ্ঠানের একটি হবার পর ও কীভাবে South East ব্যাংক থেকে এত লোন পেল তাই চিন্তার বিষয়।
জানা যায় South East ব্যাংক দুটি আইন অমান্য করে কেয়া গ্রুপকে অবৈধ ভাবে লোন দিয়েছে। এবং এর মধ্যে ব্যাক্তি স্বার্থ ও জড়িত ছিল। BFI এর তথ্য মতে অনুযায়ী, কোন কোম্পানি ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমান ঋন নিলে তাদের সেই লোনের বিপরীতে ইন্সুরেন্স ও নেওয়া লাগে। কেয়া গ্রুপ তাদের সব ইন্সুইরেন্স নিয়েছে এশিয়া ইন্সুরেন্স থেকে। আর এশিয়া ইন্সুরেন্স এর সাথে রয়েছে South East ব্যাংকের ভাল সম্পর্ক। কেননা এমন অনেক বোর্ড মেম্বার রয়েছে যারা এই দুই প্রতিষ্ঠানের সাথেই জড়িত। এবং নিজেদের ইন্সুইরেন্স বিজনেজকে এক্সপেন্ড করতেই তারা মূলত এই কাজ করেছে।
যার ফলে প্রায় ৫২৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কেয়া গ্রুপের চ্যায়ারম্যান আব্দুল খালেক পাঠান সহ South East ব্যাংকের আরো ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদুক মামলা দিয়েছে।
যদিও এরো আগে ১.১ বিলিয়ন টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগ এ আব্দুল খালেক পাঠানকে দুদুক গ্রেফতার করেছিল। এবং আলাদা ভাবে ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রাখার অভিযোগ এ তারা বিরুদ্ধে দুদক আরো ৫টি মামলা করেছিল। আর এসব কারণেই কেয়ার ৪টি কারখানা বর্তমানে স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রিয় দর্শক এই হলো একসময়ের জনপ্রিয় কেয়া গ্রুপের বর্তমান অবস্থা। চাইলে যেটা নেক্সট ইউনিলভার হতে পারতো। কিন্তু অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা আর সীমাহীন দুর্নীতির কারণে বন্ধ হয়ে গেলো, সেই সাথে অনিশ্চিত হয়ে গেলো কেয়া গ্রুপে কাজ করা সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান৷
আমাদের আজকের ভিডিও এই অব্দি। । ভিডিওটি ভালো লাগলে লাইক দিন এবং কমেন্ট করুন। আমাদের ইউনিলিভারকে নিয়ে করাও একটি ভিডিও আছে, সেটিও দেখে আসতে পারেন। এরকম আরো ভিডিও দেখতে চাইলে, চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে বেল বাটন্টি প্রেস করে রাখুন। দেখা হবে নেক্সট কোন ভিডিওতে।