গুজব না সত্য? কী বলছে কোম্পানি? বাটার অজানা অধ্যায় | Bata Journey | Business Mania
একসময় ‘জুতা’ মানেই ছিলো ‘বাটা’। 1894 থেকে যাত্রা শুরু করে, ১০ বছরের মধ্যে পৌঁছে যায় ব্রিটিশ ভারতে, আর ১৯৬২ সালে গড়ে তোলে বাংলাদেশে প্রথম ফ্যাক্টরি। দেশে বিক্রি হওয়া ১০টা জুতার ৯টাই ছিলো বাটা! কিন্তু আজ? সেই বাটার নাম উঠে আসছে এক ভিন্ন কারণে, ইসরায়েলের সঙ্গে যোগসূত্র? যাকে কেন্দ্র করে গুজব, লুটপাট, বয়কট, সব চলছে
কিন্তু এসব বিতর্কের আড়ালে আমরা যেন ভুলে যাচ্ছি, এক চেক ব্যবসায়ীর ছোট্ট উদ্যোগে কীভাবে হয়ে উঠেছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে আইকনিক জুতা ব্র্যান্ড, বাটা । এই গল্পটা জানতেই চলুন ফিরে যাই ১৮৯৪ সাল, চেকোস্লোভাকিয়াতে।
১৮৯৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ছোট্ট শহর জ্লিনে জন্ম নেয় ,বাটা। তখন এটি ছিল স্রেফ এক পরিবার-চালিত জুতার কারখানা। থমাস বাটা, তার ভাই অ্যান্টনিন আর বোন আনা, এই তিন ভাইবোন মিলে শুরু করলেন মাত্র ১০ জন কর্মচারী নিয়ে।
কিন্তু সেই শুরুটা সহজ ছিল না, ১৮৯৫ সালেই, T. & A. Baťa Shoe Company পড়ে যায় কঠিন এক আর্থিক সংকটে।
এই সমস্যার মূল কারণ ছিল সীমিত আর্থিক সংস্থান এবং বৃহত্তর ও প্রতিষ্ঠিত জুতা প্রস্তুতকারকদের সাথে প্রতিযোগিতায় অক্ষমতা। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে, থমাস বাটা চামড়ার পরিবর্তে ক্যানভাস দিয়ে জুতা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে উৎপাদন খরচ কমে যায় এবং সাশ্রয়ী ও হালকা জুতা সরবরাহ করা সম্ভব হয় , যা কোম্পানির বিক্রয় তো বাড়িয়ে দেয়ই পাশাপাশি কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রারম্ভিক ১০ জন থেকে হয় ৫০ জন।
ব্যস, হালকা আর সস্তা এই জুতা দারুণ জনপ্রিয় হয়ে যায়, আর সেই সাথে কোম্পানিও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে ।
এরপর শুরু হয় প্রযুক্তির ছোঁয়া। বৈশ্বিক বাজারে ও competition এর সাথে টিকে থাকলে হলে যে, প্রযুক্তিগত দিক থেকেও এগিয়ে থাকতে হবে এটি থমাস বুঝতে পেরেছিলেন শুরু থেকেই। কোম্পানি প্রতিষ্ঠার ৫-৬ বছর পরই উনিশশো সালের শুরুর দিকে আসে স্টিমচালিত মেশিন।
১৯০৪ সালে থমাস এক পত্রিকায় পড়ে জানেন আমেরিকায় নতুন ধরনের জুতা বানানোর মেশিন তৈরি হচ্ছে,বিশেষ করে Jan Ernst এর অটোমেটিক লাস্টার। তিনি সঙ্গে তিন কর্মীকে নিয়ে পাড়ি জমান আমেরিকার লিন শহরে, বস্টনের পাশে, যেটা তখন বিশ্ব shoe ইন্ডাস্ট্রির কেন্দ্র ছিল। আর ছয় মাস পর ফিরে এসে থমাস চালু করেন মেকানাইজড প্রোডাকশন, ইউরোপের অন্যতম প্রথম mass production সিস্টেম।
“বটোভকি” নামের এক ধরনের সস্তা কিন্তু স্টাইলিশ জুতা বাজারে আসে। পেশাদার মানুষদের জন্য তৈরি, কিন্তু খুব দ্রুতই সবার পছন্দের হয়ে ওঠে। যা সফলতার সহায়ক হয়, এবং ১৯০৮ সালে অ্যান্টনিনের মৃত্যুর পর থমাস তার দুই ছোট ভাই, ইয়ান এবং বোহূশকে ব্যবসায় নিয়ে আসেন। ১৯০৯ সাল নাগাদ রপ্তানি শুরু হয় জার্মানি, তারপর বালকান, মধ্যপ্রাচ্য,বাটা হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক।
আর ১৯১২ সালের মধ্যে? দেড় হাজারের বেশি ফুলটাইম কর্মচারী!
বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বৈপ্লবিক পরিবর্তন বাটাকে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যায়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মিলিটারি অর্ডারের কারণে বাটার বিকাশ ঘটে জোরেশোরে। মাত্র চার বছরের মধ্যেই, ১৯১৮ পর্যন্ত, কর্মীর সংখ্যা দশ গুণ বেড়ে যায়। প্রাগ, লিবেরেচ, ভিয়েনা সহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বাটা তাদের নিজস্ব দোকান খোলে।
কিন্তু যুদ্ধের পরে চেকোস্লোভাকিয়া ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে, মুদ্রার মান পড়ে যায় ৭৫ শতাংশ । চাহিদা কমে যায়, উৎপাদন বন্ধ হয়, এবং বেকারত্ব চরমে পৌঁছায়। এই সঙ্কটে থমাস বাটা সিদ্ধান্ত নেন, বাটার জুতার দাম অর্ধেকে নামিয়ে আনবেন । কর্মীরা ৪০% বেতন কমাতে রাজি হয়, আর বাটা তাদের খাবার, জামাকাপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিসও অর্ধেক দামে সরবরাহ করেন। এর পাশাপাশি, তিনি প্রফিট শেয়ারিং চালু করেন । সব কর্মী হয়ে ওঠে “অ্যাসোসিয়েট”, যাদের কোম্পানির লাভের সাথে সরাসরি সম্পর্ক থাকে।
এর ফলে ১৯২৩ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে যখন অন্যান্য কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন বাটা হু হু করে বাড়তে থাকে। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায়, বাটা বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করে।
বাংলাদেশে এই প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৬২ সালে, পূর্ব পাকিস্তান আমলে, টঙ্গীতে প্রথম ফ্যাক্টরি স্থাপনের মাধ্যমে। বর্তমানে বাটা শু কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড টঙ্গী ও ধামরাই, এই দুইটি ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট পরিচালনা করছে, যেখানে প্রতিদিন গড়ে ১লাখ ৬০ হাজার জোড়া জুতা উৎপাদন হয়। বছরে প্রায় ৩ কোটি জুতা বিক্রি হচ্ছে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই। বাংলাদেশ বাটার শীর্ষ ১০টি বাজারের একটি ।
বাংলাদেশের বাজারে ক্রমবর্ধমান ফ্যাশন সচেতনতার সাথে তাল মিলিয়ে বাটা চালু করে কমফিট , হাশ পাপিজ, পাওয়ার, বেন১০, বাবলগামারস সহ অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। খেলাধুলার জন্য ‘পাওয়ার’ ব্র্যান্ডটি আলাদা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কোয়ালিটি ও ডিজাইনের সমন্বয়ে বাটার ব্র্যান্ড প্রিমিয়াম ইমেজ ধরে রাখে।
রিটেইল সেগমেন্টেশনে বাটা পরিবর্তন আনে। সিটি স্টোর, ফ্যামিলি স্টোরসহ চালু হয় একাধিক থিমেটিক আউটলেট। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাটা স্টোর এখন ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে। দেশজুড়ে ২৬১টি রিটেইল আউটলেট, ১৩টি হোলসেল ডিপো, ৪৭১টি আরডব্লিউডি এবং ৬৯০টি ডিএসপি আউটলেট নিয়ে বাটার বিস্তৃত নেটওয়ার্ক কাজ করে যাচ্ছে।
কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণিল অধ্যায় শুরু হয় ১৯৭১ সালে। অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ও বাটার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর উইলিয়াম এ. এস. ওউডারল্যান্ড যখন মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ঢাকার কারফিউ পাসের সুযোগে পাকিস্তানি বাহিনীর গোপন তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করা, গোপন ক্যাম্পে খাদ্য, চিকিৎসা, অস্ত্র সরবরাহ, সব মিলিয়ে তিনিই একমাত্র বিদেশি যিনি ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন। টঙ্গীর বাটা কারখানা তখন মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানটি আবারও গুছিয়ে নেওয়া শুরু করে। সেই সময় অনেক দলিলপত্র হারিয়ে যায়, তবে নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলে বাটা। ১৯৭০-এর দশকে ‘বাটা ইন্ডাস্ট্রিয়ালস’ চালু হয়, যা দেশের একমাত্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে আছে।
১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়। ‘পেগাসাস’ ও ‘আফজাল’ এর মতো কোম্পানিরা প্রতিযোগিতায় নামলেও বাটার জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ থাকে। ২০০০-এর দশকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসে বাটা।
২০০৯ সালে চালু হয় আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল শুজ’ । একই বছর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অফিসিয়াল ক্লথিং স্পনসর হয় বাটা। এই ব্র্যান্ড-অ্যাসোসিয়েশন তাদের গ্রাহকের মনে বাড়তি জায়গা করে দেয়। ফলে ২০১৪ ও ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের ‘বেস্ট ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করে।
এখন সাম্প্রতিক ঘটনা গুলোর প্রেক্ষিতে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়।
২০২৩ সালের শেষ দিকে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষিতে সারা বিশ্বে শুরু হয় বয়কট আন্দোলন।
১৯২৭ সালেই জেরুজালেমে প্রথম স্টোর খোলে তারা, এবং ১৯৩১ সালে হাইফাতে ‘Palestine Bata Shoe Company Ltd.’ প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসা বিস্তার করে। অল্প সময়ের মধ্যেই তেল আভিভ, জাফা, নাজারেথসহ ১২টি শহরে বাটার স্টোর গড়ে উঠে ।
আর, বাটা গ্রুপ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলের রামাত গানে ২০০৭ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে ব্যবসা করছে। তবে এখনো পর্যন্ত বাটার পক্ষ থেকে ইসরায়েলি সরকার বা সামরিক বাহিনীকে সরাসরি সহায়তা করার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ইসরায়েলে বাটা স্টোর চালু থাকার কারণেই,
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #Boycott Bata ট্রেন্ড শুরু হয়।
বাংলাদেশেও এই বিষয়টি নিয়ে জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই বাটার পণ্য বর্জনের ডাক দেন।
যদিও বাটা, বাটার ইসরায়েলে ঐতিহাসিক উপস্থিতি থাকলেও, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটি স্পষ্টভাবে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে।
২০২৫ সালের ৮ এপ্রিল, বাংলাদেশে কয়েকটি বাটা আউটলেটে ভাঙচুরের ঘটনার পর প্রতিষ্ঠানটি এক বিবৃতিতে জানায়, “বাটা কোনোভাবেই ইসরায়েলি মালিকানাধীন নয়, কিংবা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে আমাদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই।”
কোম্পানিটি আরও জানায়,“আমরা সকল ধরনের সহিংসতাকে কঠোরভাবে নিন্দা জানাই,”.
পরিশেষে বলা যায়, ইসরায়েল-পেলেস্টাইন যুদ্ধ কিংবা ইসরায়েলের politics এর সাথে বাটার কোন প্রকার সংযুক্তি বাটা অস্বীকার করে।
তাহলে কি বাটার ইসরায়েলের সাথে কোন গোপন সম্পর্ক থাকতে পারে? সম্ভব তবে তা নাও হতে পারে।
গুজব বা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের উচিত নির্ভরযোগ্য সূত্র যাচাই করে নেওয়া। তথ্য যাচাই করে সচেতন সিদ্ধান্তই হোক আমাদের পছন্দের ভিত্তি।
বাটা কোম্পানি নিয়ে ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে আমাদের ওয়েবসাইটে ই-মেইল সাবস্ক্রাইব করে সাথেই থাকুন।
Comment বক্সে অবশ্যই জানাবেন,
আপনার মতে কোনো ব্র্যান্ডকে বয়কট করার আগে আমাদের কী কী বিষয় বিবেচনা করা উচিত?