গোল্ডেন হারভেস্ট কি আর্থিক ধ্বংসের পথে হাঁটছে? | Golden Harvest
নব্বই দশকের শেষ দিকে, বাংলাদেশে ফ্রোজেন খাবারের বাজার ছিল একেবারেই নতুন। ঠিক এমন সময়, ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে Golden Harvest Group। শুরুর দিকে ফ্রোজেন ফুড ব্যবসার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে পরিচিতি পেতে থাকে।
তাই Business maniar আজকের ব্লগটি গোল্ডেন হারভেস্ট গ্রুপ কে নিয়ে।
যখন বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের বিকাশের সূচনা হচ্ছিলো, তখনই এক সমৃদ্ধ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল কমোডিটি ব্রোকারেজ ও আইটি সেক্টরে। ১৯৯৭ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে রজীব সামদানি ‘স্টেমকোর’ কোম্পানিতে কমোডিটি ব্রোকার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন; দুই বছর পর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন Golden Harvest InfoTech Limited, যা সফটওয়্যার রপ্তানিতে স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয় । ২০০০ সালে মূল কোম্পানি গড়ে ওঠে ঢাকায়, আর খাটুনির মিশ্রণে শুরু হয় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসার স্বপ্নযাত্রা।
২০০৪ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো Golden Harvest বাজারে ছড়িয়ে দেয় “ফ্রোজেন ফুড” ধারণা। ২০০৬ সালে তাদের প্রথম প্রস্তুতকারক ইউনিট চালু হয়, যা স্বল্প মেয়াদেই দেশের প্রথম নিজস্ব কোল্ড চেইন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলায় উদ্যোগী হয় USAID-এর সহায়তায় । ফ্রোজেন পরাঠা, সেমাই, সসেজসহ বিভিন্ন পণ্য দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে গ্রাহকদের মাঝেও।
প্রতিষ্ঠানটি ধাপে ধাপে ২০০৯ সালে Golden Harvest Agro Industries Ltd. এবং ২০১২ সালে Golden Harvest Foods Ltd. প্রভৃতি সাবসিডিয়ারি গঠন করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, স্ন্যাক্স এবং চিপস উৎপাদনে মনোযোগ দেয় ।
২০১৪ সালে USAID-এর সহায়তায় কার্যকর রূপ নেয় তাদের কোল্ড চেইন নেটওয়ার্ক, যা শুধু ভোক্তা বাজারকেই নিরাপদ করে তোলে না, বরং রপ্তানি আমদানির অবকাঠামোকেও মজবুত করে । ২০১৯ সালে IFC, বা International Finance Corporation, এর সাথে গৃহীত যৌথ উদ্যোগ ‘ডিল অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার বিজয়ী প্রকল্পের মাধ্যমে কোল্ড চেইন সেক্টরে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় বলে জানান Rajeeb ।
২০১৮ সালে বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল খাদ্য ও ফাস্টফুড মার্কেটের সম্ভাবনা বুঝতে পেরে Golden Harvest Group একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেয়। তারা ভারতের Jubilant FoodWorks Limited-এর সঙ্গে চুক্তি করে Domino’s Pizza–কে বাংলাদেশে আনার একচ্ছত্র লাইসেন্স লাভ করে। Jubilant FoodWorks–ই ভারত, নেপাল, ও শ্রীলঙ্কায় Domino’s-এর মূল ফ্র্যাঞ্চাইজি অপারেটর।
তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ আজও Golden Harvest-এর অন্যতম মেরুদণ্ড। রজীব সামদানির নেতৃত্বে InfoTech বিভাগ তিনবার জাতীয় রপ্তানি ট্রফি জিতেছে এবং পাশাপাশি BPO ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স–মেশিন লার্নিং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও সম্প্রসারণে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে ।
বিগত দু’দশক ধরে বর্তমানে Golden Harvest Group-এ কর্মরত প্রায় ৫০০০ আরও বেশি জন কর্মীর বলিষ্ঠ অবদান সংগঠনকে দিয়েছে ক্রমবর্ধমান আয় ও বিশ্বসর্বজ্ঞ স্বীকৃতি। আজ তারা খাদ্য, আইটি, লজিস্টিক্স, রিয়েল এস্টেট, এভিয়েশন, ইনফ্রাস্ট্রাকচার, ইনসিওরেন্স সহ নানা খাতে বিচরণ করছে ।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, Golden Harvest Group শুধু একটি ফ্রোজেন ফুড কোম্পানি নয়, এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের অন্যতম বহুমুখী শিল্পগোষ্ঠী। তাদের সবচেয়ে দৃঢ় দুটি খাত হলো: খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং তথ্যপ্রযুক্তি।
খাদ্য খাতে, Golden Harvest Agro Industries Ltd. এখনো দেশের অন্যতম পরিচিত নাম। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটি বছরে প্রায় ৯৬৮ কোটি টাকা রাজস্ব অর্জন করেছে। তবে আন্তর্জাতিক কাঁচামাল বাজারে দামের ওঠানামা ও উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু আর্থিক চাপের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে, যেমন : ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ২০৮ কোটি টাকার অপারেটিং ক্ষতি দেখিয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে কোম্পানিটি স্থিতিশীলভাবে বাজারে টিকে আছে এবং তার বিভিন্ন পণ্য এখনো ভোক্তাদের মাঝে জনপ্রিয়। ২০১৩ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রবেশের পর Golden Harvest Agro Industries Ltd.–র IPO তৎকালীন বিনিয়োগকারীদের মন জয় করে। কারণ সে সময় বাংলাদেশের ফ্রোজেন ফুড শিল্প খুবই সীমিত, আর Golden Harvest তাদের আধুনিক ‘কোল্ড চেইন অবকাঠামো’ ও ‘কৃষিভিত্তিক প্রক্রিয়াজাত খাদ্য’ নিয়ে যে উদ্ভাবনী অঙ্গীকার করেছিল, তা ছিল অন্যদের থেকে বহু গুণ এগিয়ে।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শেয়ার মূল্য কিছুটা চাপের মুখে পড়েছে। একদিকে কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক ওঠানামা করছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এই সব কারণ মিলিয়ে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে অপারেটিং মার্জিনে ফাটল ধরে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের আস্থায়. তবে Golden Harvest তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও বাজার দখলের শক্তি কাজে লাগিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে মুখিয়ে আছে।
Golden Harvest Group-এর বহুমুখী ব্যবসার মধ্যে আরো তিনটি নতুন ও দ্রুতবর্ধমান শাখা রয়েছে, যা তাদের শক্তিকে আরও বৃদ্ধি করেছে। প্রথমত, Golden Harvest Ice Cream Ltd., যা ২০১৭ সালে শুরু হলেও এখন প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ধরনের আইসক্রিম তৈরি করে থাকে। এ বিভাগ থেকে বছরে আনুমানিক ৫০ থেকে ৫৫ কোটি টাকার বিক্রয় হয়।
দ্বিতীয়ত, Golden Harvest Foods Ltd., যা প্রধানত স্ন্যাকস ও চিপস বাজারে কাজ করে। এখানে জনপ্রিয় পণ্য হিসেবে রয়েছে বারবিকিউ মিক্স চানাচুর, ঝাল মিক্স ও ডাল ভাজা ইত্যাদি।
আরেকটি বড় শাখা হলো Golden Harvest Dairy Ltd., তারা লিকুইড মিল্ক, ঘি, দই, পনির, মোজারেলা চিজসহ নানা ডেইরি পণ্য উৎপাদন করে। ডেইরি বিভাগ থেকে ২০২৩-২৪ সালে প্রায় ৬.৩৮ কোটি টাকার আয় এসেছে, যা গ্রুপের খাদ্য খাতকে আরও বিস্তৃত করেছে।
তবে Golden Harvest-এর প্রকৃত শক্তি অনেকাংশেই এখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। Golden Harvest InfoTech, যা প্রায় দুই দশক আগে যাত্রা শুরু করেছিল, বর্তমানে প্রায় ২,৬০০ জন দক্ষ কর্মী নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য সফটওয়্যার ও বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং সেবা দিচ্ছে। এই বিভাগটি প্রতিবছর প্রায় ২৩৩ কোটি টাকা বা ২৩.১ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ে অবদান রাখছে। দেশের আইটি রপ্তানি খাতে InfoTech এখন শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের একটি।
এই সাফল্যের পাশাপাশি প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। ফ্রোজেন ফুড খাতে AG Agro, Aftab, Harvest Rich, এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড McCain এখন বাজারে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। যারা দ্রুত প্রসেসিং, নতুন পণ্যের বৈচিত্র্য ও ব্র্যান্ডিং-এ জোর দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করছে।
Domino’s-এর মাধ্যমে Golden Harvest, দেশের ফাস্ট ফুড মার্কেটে প্রবেশ করেছে, কিন্তু সেখানে আবার Pizza Hut, Burger King, এবং KFC-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, তাদের চলমান চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, Golden Harvest-এর পণ্যের পরিসর, উৎপাদন কাঠামো এবং কৃষক-কেন্দ্রিক সংযোগ এখনও তাদের বাংলাদেশের ফুড প্রসেসিং খাতের অন্যতম নির্ভরযোগ্য নাম করে রেখেছে।
এখন পর্যন্ত আমরা জানি, রাজীব সামদানী হচ্ছেন Golden Harvest Group‑এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আর নাদিয়া সামদানী তাঁর স্ত্রী ও সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন।
রাজীব সামদানী ও নাদিয়া সামদানী, বাংলাদেশের শিল্পজগতে এক পরিচিত ও সম্মানিত দম্পতি। সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন এবং ঢাকা আর্ট সামিটের মাধ্যমে তাঁরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন বহুবার। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু রিপোর্ট এই শিল্পপ্রীতির আড়ালে এক অস্বচ্ছ অর্থনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়। বণিক বার্তা-র “The dark sides of a bright art-loving couple” শিরোনামে প্রকাশিত অনুসন্ধানে তাদের ব্যাপারে নানা অভিযোগ উঠেছে। এই দম্পতির প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০২৪ সালের আগস্টে গুলশানে সংঘটিত আলোচিত অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে লোপাট হওয়া শিল্পকর্মগুলোর একটি বড় অংশ সরবরাহ করেছিলেন রাজীব সামদানী, এমন তথ্য উঠে আসে যুগান্তর-এর এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনেও।
প্রতিবেদনগুলো বলছে, আর্ট সংগ্রহের আড়ালে “লেয়ারিং” নামে পরিচিত একধরনের অর্থপাচারের কৌশল প্রয়োগ হত : যেখানে শিল্পকর্মের মাধ্যমে বৈধ লেনদেনের আড়ালে কালো টাকা স্থানান্তর করা সম্ভব হতো। যদিও সামদানী ফাউন্ডেশন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং বলেছে, তারা কেবল শিল্প চর্চা ও শিল্পীর উন্নয়নেই কাজ করে, তবে কোনো ধরনের স্বাধীন তদন্ত এখনো হয়নি। ফলে প্রশ্ন থেকে যায়, সবকিছু কি শুধুই কাকতালীয়, নাকি এই আর্টওয়ার্ল্ডের পর্দার আড়ালে সত্যিই কোনো ‘শৈল্পিক প্রতারণা’ চলছিল?
আজকের ব্লগটিতে আমরা দেখলাম কিভাবে Golden Harvest Group শুধুমাত্র ফ্রোজেন ফুড খাতে নয়, তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে ফাস্টফুড মার্কেটেও নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে, তবু তারা তাদের উদ্ভাবনী শক্তি আর দৃঢ় প্রত্যয়ের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি দেখলাম, Golden Harvest-এর শীর্ষ দুই মুখ, রাজীব ও নাদিয়া সামদানীর শিল্পচর্চার আড়ালে আর্থিক স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক সংযোগ নিয়ে নানা বিতর্ক ও অভিযোগ।
আপনি কি মনে করেন, Golden Harvest-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্যে, আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের কোন খাতগুলো সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যাবে এবং কেন?
ব্লগটি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য ধন্যবাদ। যদি ভালো লেগে থাকে, আমাদের ওয়েবসাইটে ই-মেইল সাবস্ক্রাইব করে রাখুন। কমেন্টে আপনার মতামত অবশ্যই জানাবেন এবং Business জগতের এমন সব ব্লগ পড়তে আমাদের সাথেই থাকবেন।