জান্নাতের স্বপ্ন দেখিয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার ফাঁদ ! এহসান গ্রুপ | Ehsan Group Scam | Business Mania
এহসান গ্রুপ। বাংলাদেশে এই অব্দী মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে যতগুলো স্ক্যাম বা প্রতারণা করা হয়েছে এর মধ্যে সবথেকে বড় আর ব্যাপক প্রতারণাটা সংঘটিত করে এই এহসান গ্রুপ। প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগ আনা হয় এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। গ্রেফতার করা হয় প্রতিষ্ঠাননির প্রতিষ্ঠাতা রাগীব আহসান সহ সব শীর্ষ সব কর্মকর্তাকে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতারানা এতই ব্যাপক ছিল যে শুধুমাত্র দেশের পিরোজপুর, ঝালকাঠি, আর বাগেরহাট জেলা থেকেই প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগ আসে। আর শুধু পিরোজপুর জেলা থেকেই আত্মসাৎ করা হয় প্রায় ৯৬ কোটি টাকা।
শরিয়ত সম্মত বিধান, সুদ বিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা এসব বলেই প্রতিষ্ঠানটি টার্গেট করতো দেশের ধর্ম প্রান মানুষদেরকে। এমনকি গ্রামে গ্রামে ওয়াজ মাহফিল এর আয়োজন করেও প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রচারণা চালাতো। এতে করে গ্রাম বাংলার ধর্ম প্রান খেটে খাওয়া মানুষেরা খুব সহজেই এই প্রতিষ্ঠানটির ফাদে পা দেয় আর প্রতারণার শিকার হয়।
Business Maniar আজকের ভিডিওটিতে আমরা জানবো দেশের ইতিহাস অন্যতম বড় প্রতারণা সংগঠিত করা এহসান গ্রুপের ব্যাপারে। সেই সাথে প্রতারণার শিকার হওয়া ধর্ম প্রান মানুষদের সাথে শেষ অব্দি কি হয়েছিল, তারা ন্যায় বিচার পেয়েছিল কিনা তাও জানবো আজকের এই ভিডিওতে।
মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে প্রতারণা করা এহসান গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা রাগীব আহসান তার শিক্ষ জীবন শুরু করে ১৯৮৬ সালে। পিরোজপুরের একটা মাদ্রাসা থেকে।
১৯৯৬ থেকে ৯৮ সাল অব্দি তিনি চট্রগ্রামের একটা মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেন। পরবর্তীতে ২০০০ সালে তিনি খুলনার একটা মাদ্রসা থেকে মুফতি হিসেবে বের হন। এরপর তিনি পিরোজপুর এ ফিরে আসেন।
সেখানেই তিনি দীর্ঘ ৬ বছর একটা মাদ্রাসায় দায়িত্ব পালন করে। এরপর উন্নত জীবনের আসায় তিনি ২০০৬ সালে ঢাকায় আসেন।
ঢাকায় এসেই তিনি (Ehsan S Multipurpose) নামের একটা (MML) প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হন। এখানে তিনি মাসিক ৯০০ টাকা বেতনে চাকরি করতেন। মূলত এই প্রতিষ্ঠান থেকেই একটা (MML) কোম্পানি কীভাবে কাজ করে৷ কীভাবে টিকে থাকে আর বিস্তার লাভ করে এসব শিক্ষা লাভ করেন।
এখানে ১ বছর চাকরি করার পর রাগীব নিজেই উদ্যোক্তা হবেন বলে ঠিক করেন। তাই তিনি নিজের একটা MML প্রতিষ্ঠান খুলার জন্য মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি এর কাছে আবেদন করেন লাইসেন্স এর জন্য। কিন্তু তার আবেদনটি খারিজ করা করা হয়।
ঠিক এর পরের বছর ২০০৮ সালে রাগীব তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে পিরোজপুর এ চলে আসে।এরপর প্রতিষ্ঠা করে Ehsan and Real Estate নামের একটা প্রতিষ্ঠান। একই বছরই পিরোজপুরের সমবায় সমিতি থেকে অনুমতি নিয়ে চালু করে (Ehsan Multipurpose and Cooperatives Society LTD.)
এই সমবায় এর নাম করেই রাগীব মানুষদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা শুরু করে।
এক্ষেত্রে রাগীব প্রথমেই টার্গেট করে তার নিজ জেলা পিরোজপুর এর মানুষদের। পিরোজপুর জেলার অনেক মানুষ প্রবাসী হিসেবে বিশ্বএর বিভিন্ন দেশে কাজ করে। যারা তাদের আয়ের বেশির ভাগ অংশই দেশে নিজের আপনজনদের কাছে পাঠায়।
তারাও এই আয়ের একটা অংশ খরচ করে বাকিটা জমা রাখতে চায়। কিন্তু ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে সুদ নিতে হবে আর সুদ নেওয়া ইসলামে হারাম বলে বেশিরভাগ ধর্ম প্রান মুসলিমরাই ব্যাংক এ টাকা জমা রাখতো না।
আর এই শ্রেনীর মানুষদেরকেই টার্গেট করে।
মূলত ১ লক্ষ টাকা জমা রাখলে তার বিপরীতে প্রতি মাসে ২ হাজার করে ব্যবসার লভ্যাংশ দিবে বলে মানুষদের আশ্বাস দিতো রাগীব। যদিও ইসলাম অনুযায়ী এটাও সুদ। তবুও মানুষদের কাছে এটাকে শরীয়ত সম্মত বলেই প্রচার করতো রাগীব। আর রাগীবের ইসলামিক ব্যাগগ্রাউন্ড আর মাদ্রাসার শিক্ষক হবার কারণে সাধারণ মানুষরাও রাগীবের কথাতে বিশ্বাস করা শুরু করে।
এসবের পাশাপাশি ২০০৯ সালে পিরোজপুরের পৌরসভার পাশে রাগীব এহসান গ্রুপ নামে একটা প্রতিষ্ঠান চালু করে। অফিসিয়াল ভাবে এর কার্যক্রম করে শুরু করে।
গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষদের সহজে টার্গেট করার জন্য। রাগীব মূলত তিনটা উপায় বেছে নেয়।
তারা আশে পাশের গ্রামগুলোতে মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক এমনকি মসজিদের ইমামদের নিজেদের কর্মী হিসেবে যুক্ত করে। কেননা মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক আর ইমামদের একটা গ্রহণযোগ্যতা গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে অনেক আগে থেকেই ছিল। ফলে এনাদের কথাতে সহজেই বিশ্বাস করে মানুষেরা এহসান গ্রুপে তাদের আমানত জমা করতে থাকে।
এছাড়াও এহসান গ্রুপ পিরোজপুর সহ আশে পাশের এলাকাগুলো ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করতো। সেসব ওয়াজ মাহফিলে আসা বক্তারাও এহসান গ্রুপে ইসলামি শরীয়ত সম্মত বলেই প্রচার করতো। এতে করে মানুষের মধ্যে এহসান গ্রুপ নিয়ে আরো বেশি ভরসা বাড়তে থাকে।
এছাড়াও গ্রাম বাংলার অল্প শিক্ষিত মানুষদের কাছে এটা বলেও প্রচার করতে থাকে যে, জান্নাতে যেতে হলে এহসান গ্রুপে টাকা আমানত হিসেবে রাখতে হবে। গ্রামের অনেক সাধারণ মানুষই এসব কথাতে এসে নিজেদের টাকা আমানত হিসেনে এহসান গ্রুপে জমা রাখতে শুরু করে।
এভাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পিরোজপুর ও তার আশে পাশের এলাকার প্রায় ১০ হাজার গ্রাহক তাদের প্রায় ১১০ কোটি টাকা আমানত হিসেবে এহসান গ্রুপে জমা রাখে। এই বিপুল পরিমান টাকার কথা যদিও পরে রিমান্ডে রাগীব এহসান নিজেও স্বীকার করে।
কিছুদিনের মধ্যেই রাগীব, এহসান গ্রুপের আন্ডারে প্রায় ১৭টির মতো প্রতিষ্ঠান চালু করে।
এগুলোর মধ্যে আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, পিরোজপুর বস্ত্রালয় ১ ও ২, এহসান পিরোজপুর গবেষণাগার, এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম , এহসান পিরোজপুর বাংলাদেশ লিমিটেড, এহসান সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতি, এহসান রিয়েল স্ট্যাট, এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, এহসান মাল্টিপারপাস সোসাইটি লিমিটেড উল্লেখযোগ্য।
তবে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষস্থানীয় পদগুলোর প্রায় সবগুলোই ছিল রাগীব ও তার পরিবারের লোকজনদের আন্ডারে। যেমন রাগীবের শশুর ছিলেন প্রতিষ্ঠানগুলো সহসভাপতি, পিতা উপদেষ্টা, ভগ্নিপতি ম্যানেজার, আর বাকি ৩ ভাই ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
এভাবে ধীরে ধীরে মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে এহসান গ্রুপ নিজেদের বিশাল সাম্রাজ্য তৈরী করতে থাকে। তবে ইসলামের ছদ্মবেশ ধারণ করায়। বেশ কয়েক বছরই এসব লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল।
তবে ২০১২ সালেই CID এর একটা শাখা এহসান গ্রুপের নামে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি এর কাছে অভিযোগ করে।
যদিও ২০১৯ সালের জুলাই অব্দি বেশ ভালো ভাবেই এহসান গ্রুপের তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে পারছিল। কিন্তু এবছর জুলাই মাসেই এসে এহসান গ্রুপ প্রথম ধাক্কাটা খায়।
পিরোজপুরের এক বাসিন্দা, এহসান গ্রুপের নামে ১০ কোটি টাকার জালিয়াতির মামলা করে। এই মামলায় রাগীবকে গ্রেফতার করা হয়। এবং কথিত আছে তাকে ৭ দিনের জেল ও খাটতে হয়।
এরকিছুদিনের মাথাতেই সেপ্টেম্বর মাসে আবার পিরোজপুরের জেলার মুলগ্রাম গ্রামের হারুন ওর রশীদ নামের এক বাসিন্দা এহসান গ্রুপের নামে আরো একটা মামলা করে। এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে এহসান গ্রুপ পিরোজপুর এলাকার ৯৭ জন গ্রাহকের ১ কোটি ১৫ লাখ ৫৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছে।
এ মামলাতে ১১ ই সেপ্টেম্বর রাগীব আর তার এক ভাইকে পুলিশ গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায়। যদিও গ্রেফতার করার সময়ে রাগীব আর তার ভাই এর কাছে মাত্র ২৫০০ টাকা ৪টা ভাউচার প্যাড আর ২টা কম দামের মোবাইল ফোন পাওয়া যায়।
রাগীবের গ্রেফতার এর পর থেকেই চারিদিকে টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগ আর মামলা আসতে থেকে। একে একে রাগীব আর তার পরিবারের লোকজনের নামে থানায় প্রায় ৭৬টার মতো মামলা জমা পরে।
শুধু তাই নয় পিরোজপুরের বাসীন্দারা একটা সাংবাদ সম্মেলন করে এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার আত্মসাৎ এর অভিযোগ তুলে।
আসলে এহসান গ্রুপের প্রতারণার জাল এতটাই বিস্তার লাভ করেছিল যে পিরোজপুরের বেশিরভাগ মানুষই তাদের টাকা ব্যাংকে না রেখে এহসান গ্রুপে আমানত রেখেছিল। ৫ লাখ, ৬ লাখ থেকে শুরু করে কেউ কেউ ৫ কোটি অব্দি টাকা এহসান গ্রুপের কাছে জমা রেখেছিল। এদের মধ্যে যেমন ছিলেন সাবেক অনেক সেনা কর্মকর্তারা তেমনি ছিলেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরা।
কিন্তু কি হয় শেষে? পিরোজপুর এর সাধারণ মানুষেরা যারা নিজেদের সব টাকা এহসান গ্রুপের কাছে আমানত হিসেবে রেখেছিল, তারা কি সেগুলো ফিরে পায়? না প্রিয় দর্শক।
এহসান গ্রুপের আত্মসাৎ করা কোন টাকায় আজ অব্দি উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কেবল যখন রাগীব ও তার ভাইদের গ্রেফতার করা হয় তখন তাদের ১০টা ব্যাংক একাউন্ট থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকা জব্দ করা হয়।
যদিও রাগীব আর তার ভাইরা পরবর্তীতে ১০১ কোটি টাকা আত্মসাৎ এর কথা স্বীকার করেন। কিন্তু এখন অব্দিও এর কোন কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।
তবে সবথেকে বেশি বিপদের পরেছে এহসান গ্রুপের ফিল্ড কর্মী হিসেবে কাজ করা মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্র আর ইমামরা। এহসান গ্রুপের রেজিস্ট্রার খাতা অনুযায়ী মোট ৪২৭ জন ফিল্ড কর্মী ছিল তাদের। কিন্তু আনঅফিসিয়ালি প্রায় ১০০০ জন কর্মী তাদের হয়ে কাজ করতো।
এনাদের কেউই আবার বেতন ভুক্ত ছিলেন না। কোন ক্লায়েন্ট এনে দিলে। সে যতটাকা আমানত রাখতো তার ২০% এক কালীন ভাতা হিসেবে পেত।
এসব ফ্লিড কর্মীদের বেশির ভাগই আজ ঘর ছাড়া। তারাও রাগীব আর এহসান গ্রুপকে সরল মনে বিশ্বাস করে প্রতারণার স্বীকার না পারছেন নিজদের সাথে ঘটা অন্যায় এর কথা বলতে না পারছেন ঘরে ফিরতে।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তথ্য মতে, রাগীব বছর এ বিভিন্ন সময়ই ধর্মীয় সফর এর নাম করে বিদেশে যেতেন। ধারণা করা হয় ওই সময় তিনি টাকাগুলো বিদেশে পাচার করতেন। আর একারণেই পাচার করা টাকা গুলো আর উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।
আর এভাবেই একটা প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস পুজি করে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। যার হদিস এখনো মিলে নি।
প্রিয় দর্শক আপনার এই ব্যাপারে মতামত কি। ঠিক কেন স্বীকার করার পর ও পাচার করা এসব টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না? তাহলে কি প্রতারিত হওয়া ওই সব মানুষদের ন্যায় বিচার পাবার কোন সম্ভাবনা নেই।
আর কেনই বা আমাদের দেশের মানুষ বার বার এসব প্রতিষ্ঠানের উপর ভরসা রেখে নিজেদের সবকিছুই হারাচ্ছে। ডেস্টিনি থেকে শুরু করে এহসান গ্রুপ হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করলেও কেন তাদের বিচার হচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনার কোন মতামত থাকলে অবশ্যই জানাবেন।
আমাদের আজকের ভিডিও এই অব্দি। । ভিডিওটি ভালো লাগলে লাইক দিন এবং কমেন্ট করুন। আর কোন কোন টপিকের উপর ভিডিও দেখতে চান তাও আমাদের জানান আর এরকম আরো ভিডিও দেখতে চাইলে, চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে বেল বাটন্টি প্রেস করে রাখুন। দেখা হবে নেক্সট কোন ভিডিওতে।