টাকা কি ফেরত পাবে E-orange ভুক্তভোগীরা ? E-orange scam with bd people | Business Mania
বাংলাদেশে এক সময় ই-কমার্স নিয়ে ছিল তুমুল উত্তেজনা। সবাই ভাবছিল, হয়তো একদিন আমাদের দেশেও দাঁড়াবে একটা নিজস্ব Amazon। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল E-orange, যার শুরুটা যতটা জাঁকজমকপূর্ণ ছিল, শেষটা হয়ে উঠে ততটাই হতাশাজনক।
“Cash on Delivery” নয়, বরং “Pree Order” এর মাধ্যমে ডিসকাউন্টে মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে সবই পাওয়া যাচ্ছিল এখানে। কিন্তু খুব বেশিদিন লাগেনি সেই স্বপ্ন ভেঙে যেতে।
হাজার হাজার মানুষের টাকা আটক, শত শত মামলা , মালিকদের পালিয়ে যাওয়া আর E-commerce নিয়ে মানুষের বিশ্বাসে চরম ধোকা।
Business mania এর আজকের ব্লগে জানবো, কীভাবে শুরু হয়েছিল E-orange-এর যাত্রা, কীভাবে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছিল একটি বিশাল প্রতারণার সাম্রাজ্য, আর শেষ পর্যন্ত কীভাবে সবকিছু ভেঙে পড়েছিল একে একে।
২০২০ সালে, যখন বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত দ্রুত বিকাশ লাভ করছিল, তখনই আত্মপ্রকাশ করে E-orange নামক একটি নতুন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম।
Daraz, Ajkerdeal, Priyoshop-এর মতো প্রতিষ্ঠিত প্ল্যাটফর্মগুলোর পাশাপাশি, E-orange তার আকর্ষণীয় ফ্ল্যাশ সেল এবং প্রি-অর্ডার অফারের মাধ্যমে দ্রুতই গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
E-orange বিভিন্ন পণ্য যেমন নতুন স্মার্টফোন, মোটরবাইক, এমনকি প্লে-স্টেশন,২০-৩০% ছাড়ে অফার করত। এই অফারগুলো এতটাই লোভনীয় ছিল যে, অনেকেই এটিকে ই-কমার্স ব্যবসার নতুন মডেল হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেন। তাদের “ডাবল টাকা ভাউচার” প্রোগ্রাম, যেখানে গ্রাহকরা অগ্রিম অর্থ প্রদান করে দ্বিগুণ মূল্যের ভাউচার পেতেন, বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে, এই দ্রুত উত্থানের পেছনে ছিল ভালোভাবে সাজানো এক প্রতারণার পরিকল্পনা।
E-orange-এর ব্যবসায়িক মডেলটি মূলত একটি পনজি স্কিমের মতো কাজ করত, এখানে নতুন গ্রাহকদের অগ্রিম অর্থ দিয়ে পুরনো গ্রাহকদের অর্ডার পূরণ করা হতো।
এই প্রক্রিয়াটি যতক্ষণ নতুন গ্রাহক আসছিল, ততক্ষণ চলতে থাকে। কিন্তু এক সময়ে, যখন নতুন অর্ডার কমে যায়, তখন কোম্পানির আর্থিক সংকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে, গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে, কারণ তারা তাদের অর্ডারকৃত পণ্য সময়মতো পাচ্ছিলেন না।
অনেকেই অভিযোগ করেন যে, তারা অগ্রিম অর্থ প্রদান করেও পণ্য পাননি। এই পরিস্থিতিতে, E-orange-এর বিরুদ্ধে গ্রাহকদের প্রতারণার অভিযোগ উঠে আসে এবং বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসে।
অবশেষে, E-orange-এর মালিক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনার ফলে, হাজার হাজার গ্রাহক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের প্রতি ভোক্তাদের আস্থা হ্রাস পায়। অবশ্য তাদের tagline ছিল, “Your Trusted Online Shop”
তখন কারও ধারণাও ছিল না, এই “trusted” শব্দটাই একদিন হয়ে উঠবে রীতিমতো কৌতুক! E-orange খুব কৌশলে তাদের মার্কেটিং প্ল্যান সাজায়। সেলিব্রিটিদের ব্যবহার করে তারা ক্রেতার মনে বিশ্বাস তৈরির চেষ্টা করে। আর এই কৌশলে অন্যতম বড় নাম ছিল, Bangladesh National Team-এর খেলোয়াড় মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা। বিশ্বাস গড়ে তুলতেই E-orange বেছে নিয়েছিল মাশরাফি বিন মুর্তজাকে । তাকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালায় বড়সড় প্রচারণা। টিভি থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া, সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে সেই একটাই বার্তা, “বিশ্বাসের অন্য নাম E-orange”।
একজন জাতীয় নায়কের মুখ থেকে এমন বার্তা শুনে অনেকেই নির্ভর করতে শুরু করে এই প্ল্যাটফর্মটির উপর। প্রচারণার এই কৌশল তাদের প্রতি জনমানুষের আস্থা বাড়িয়ে তোলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই আস্থা পরিণত হয় গভীর প্রতারণায়।
তবে প্রতারণার ঘটনার পর মাশরাফি জানিয়ে দেন, কোম্পানির সঙ্গে তার চুক্তি শেষ হয়ে গেছে, এবং তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার যথাযথ চেষ্টা করেন।
এছাড়াও, সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগার, ইউটিউবার এমনকি বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাধ্যমেও প্রচার চলছিল, e orange এর।আসলে এটি ছিল, সুপরিকল্পিত ট্রাস্ট ম্যানিপুলেশন। মূল প্রতারণার শুরু হয় এই “প্রি-অর্ডার” প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
প্রথমে বিজ্ঞাপন হতো,
“আইফোনের আসল দাম ১ লাখ টাকা, কিন্তু এখনই কিনলে মাত্র ৭০ হাজারেই পেয়ে যাবেন!”
“বাইক ২ লাখ টাকার, এখন অর্ডার করলে, পাবেন মাত্র ১ লাখ ৫০ হাজারে!”
এই লোভনীয় সব অফারে হাজার হাজার মানুষ আগেভাগেই টাকা দিয়ে পণ্য অর্ডার করে বসে। আর E-orange response হতো, পণ্যগুলো imported, তাই ডেলিভারিতে ১০-১৫ দিন সময় লাগবে।
২০২১ সালে এসে হঠাৎ করেই অর্ডার বন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ তাদের পণ্যের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করে, কিন্তু E-orange পক্ষ থেকে কোনো উত্তর আসছিল না। ফোন বন্ধ, মেইল বন্ধ, অফিস বন্ধ,সবই একে একে গায়েব হয়ে যায়।গ্রাহকদের টাকা আটকে পড়ে প্রায় ১১০০ কোটি টাকার মতো, অন্তত ৩০ হাজার গ্রাহক প্রতারিত হন।
শুধু সাধারণ মানুষ নয়, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, ছাত্র, প্রবাসী, সব শ্রেণির মানুষ এই প্রতারণার শিকার হয়। এদিকে জানা যায়, E-orange এর একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা এই টাকা বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলে। মূল অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন র্যাবের সাবেক মেজর সোহেল রানা, যিনি পরে ভারতে পালিয়ে যান। তাছাড়াও প্রতিষ্ঠানের মালিক আরাফাত রহমান ও তার স্ত্রী .
সোহেল রানা, ই-অরেঞ্জ কেলেঙ্কারির মূল অভিযুক্তদের একজন। তিনি ‘Orange Bangladesh’ নামক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন, যা ই-অরেঞ্জের ঠিকানায়ই পরিচালিত হতো। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশের সময় সীমান্ত থেকে আটক হন এবং পরে জামিন নিয়ে নিখোঁজ হন। অন্যদিকে, E-orange এর মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী আরাফাত রহমান এই প্রতারণার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পণ্য সরবরাহ না করার অভিযোগে মামলা হয়। গুলশান থানায় দায়েরকৃত মামলার তথ্যমতে, E-orange প্রায় ১,১০০ কোটি টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে নিয়ে প্রতারণা করেছে এবং প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা এই অর্থ বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলেছে।
গ্রাহকদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ হয়, মামলা দায়ের হয়। মামলার প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির মালিক এবং অন্যান্য কয়েকজন গ্রেপ্তার হন। তবে মূল হোতা মেজর সোহেল রানা ভারত সীমান্ত পার হওয়ার সময় ভারতীয় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তবে এখনো পুরো টাকা উদ্ধার হয়নি, অধিকাংশ গ্রাহক এখনো তাদের পাওনা ফেরত পাননি।
এই প্রতারণার ঘটনা চরম বিতর্ক তৈরি করে। সরকারের পক্ষ থেকে E-commerce নীতিমালা পুনর্বিন্যাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।“Trusted Payment Gateway”, “Digital Escrow Service” চালু করার প্রস্তাব আসে, যাতে গ্রাহক পণ্য না পাওয়া পর্যন্ত টাকা বিক্রেতার কাছে না যায়।
তদন্তে উঠে আসে, E-orange, সরকারের নীতিমালা মানেনি, অডিট রিপোর্ট নেই, ফাইন্যান্সিয়াল ট্রান্সপারেন্সি ছিল না। এমনকি অভিযোগ আছে, কিছু ব্যাংক, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠানও তাদেরকে সাহায্য করেছে টাকা হস্তান্তর করতে। বিভিন্ন সংস্থা, এই মামলার তদন্ত চালিয়ে যায়। তবে এখনো পুরো অর্থ উদ্ধার হয়নি।
E-orange কেলেঙ্কারির পর বাংলাদেশের ই-কমার্স সেক্টরে এক ধরনের ভয় ঢুকে পড়ে। অনেক মানুষ বিশ্বাস হারায় অনলাইন কেনাকাটার উপর। Evaly, Dhamaka-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণাও সামনে আসতে শুরু করে।
২০২৫ সালের এখন পর্যন্ত বেশ কিছু মামলার শুনানি চলছে। গ্রাহকদের একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে, “E-orange Victims Forum”,যারা টাকা ফেরতের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে।
সরকার বলেছে, প্রতিষ্ঠানটির জব্দ করা সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
তবে প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতির, এবং বাস্তবে ক’জন টাকা ফেরত পাবে তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
E-orange এর কাহিনি আসলে শুধু একটা কোম্পানির পতনের গল্প না। সঠিক নিয়ম, স্বচ্ছতা, এবং জবাবদিহিতা ছাড়া কোনো খাতই নিরাপদ নয়।তাই ভবিষ্যতে যদি কোনো কোম্পানি অস্বাভাবিক ডিসকাউন্ট, বিশাল ক্যাশব্যাক বা অবিশ্বাস্য রকমের অফার দেয়, তাহলে প্রথম প্রশ্নটা হওয়া উচিত, এটা কি আদৌ বাস্তবসম্মত?
আপনার যদি লেখাটি ভালো লেগে থাকে আমাদের ওয়েবসাইটে ই-মেইল সাবস্ক্রাইব করুন নিত্য নতুন তথ্য পেতে। কমেন্টে লিখে জানাবেন, আপনার কোনো প্রিয়জন E-orange প্রতারণার শিকার হয়েছিলো কি না?