স্বপ্ন নাকি দুঃস্বপ্ন: ৪৫ লাখ বিনিয়োগকারীর কান্না | Destiny Group 2000 Scam | Business Mania
“ডেসটিনি” গ্ৰুপ (Destiny Group) যা একসময় স্বপ্ন দেখিয়েছিল লাখো মানুষকে, আজ সেই স্বপ্ন ভাঙনের আর্তনাদে পরিণত। বিশাল বিনিয়োগ, চাকরির প্রতিশ্রুতি আর উন্নতির মোহে জড়িয়ে পড়েছিল দেশের প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষ। কিন্তু কিভাবে একটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৪,২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করল এবং লাখ লাখ মানুষের জীবনকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিল?
Business Mania r আজকের ভিডিওতে আমরা আলোচনা করব ডেসটিনির উত্থান থেকে পতনের সম্পূর্ণ গল্প। পাশাপাশি আমরা জানব এর অর্থনৈতিক প্রভাব, বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি ।
ডেসটিনি গ্রুপের (Destiny Group) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হারুন-অর-রশিদ এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর (Managing Director) মোহাম্মদ রফিকুল আমিনের নেতৃত্বে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড (Destiny-2000 Limited)। এক সময় এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং (Multi-level Marketing) কোম্পানিতে পরিণত হয়। শুরুতে এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ বেকার তরুণদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। ঢাকা শহরে অবস্থিত কর্পোরেট অফিস (Corporate Office) এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে শাখা নিয়ে ডেসটিনি (Destiny) একটি সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
প্রাথমিকভাবে MLM (Multi-level Marketing) ধারণাটি বাংলাদেশে নতুন ছিল, যা কোম্পানির জন্য নানা সমস্যার জন্ম দেয়। এই ধারণা অনেকের কাছেই অস্পষ্ট ছিল, এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এটি সম্পর্কে বিভ্রান্ত ছিল। কিন্তু রফিকুল আমিনের দূরদর্শী নেতৃত্বে ডেসটিনি (Destiny) এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে। এক দশকের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ৩৬ লাখ ডিস্ট্রিবিউটরকে তাদের নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়, যারা পণ্য বিপণন ও বিনিয়োগের মাধ্যমে কোম্পানিকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। ডেসটিনি শুধু বৃহৎ MLM (Multi-level Marketing) কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেনি, বরং অর্থনীতি, কৃষি এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখার দাবিও করে।
ডেসটিনির একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল তাদের সৃজনশীল প্রচারণা। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে ৪০তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের অন্যতম প্রধান স্পন্সর ছিল। তাছাড়া, তারা পরিবেশ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে “ডেসটিনিজ ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেড (Destiny Tree Plantation Limited)” নামে একটি প্রকল্প শুরু করেছিল। প্রতিষ্ঠানটি বছরে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপন করত, বিনামূল্যে চারা বিতরণ, সচেতনতামূলক সমাবেশ, মানববন্ধন, এবং পরিবেশ মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের পরিবেশবান্ধব পরিচয় তুলে ধরত। এমনকি গ্রামীণ দরিদ্র ও বেকার জনগোষ্ঠীকে বাণিজ্যিক বৃক্ষরোপণে সম্পৃক্ত করে তাদের আয় বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতায়, ডেসটিনির এই পরিকল্পনার বেশিরভাগ অংশই ছিল একটি ধোঁকা।
একটি আলোচিত উদাহরণ হলো তাদের ৫০ মিলিয়ন গাছ বিক্রির দাবি। বিনিয়োগকারীদের দেখানো হয়েছিল সুন্দরবনের গাছের ছবি এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে তাদের ক্রয়কৃত গাছ একটি লাভজনক সম্পদে পরিণত হবে। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে প্রকাশিত হয় যে, মাত্র ৫.৩ শতাংশ গাছ বাস্তবে বিদ্যমান। এভাবে, ১৭ লাখ বিনিয়োগকারীকে এই ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতারণা করা হয়।
কোম্পানির দ্রুত উত্থানের আরেকটি কারণ ছিল তাদের গণমাধ্যমের উপস্থিতি। ডেসটিনি (Destiny) কেবল একটি MLM (Multi-level Marketing) কোম্পানিই নয়, এটি একটি সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানাও অর্জন করেছিল। বিপণন এবং প্রচারের জন্য তারা বিপুল অর্থ ব্যয় করত, যার ফলে তাদের ব্যবসায়িক প্রভাব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ডেসটিনি গ্রুপের কার্যক্রম দেশের গ্রামীণ এলাকাগুলোর সাথে গভীরভাবে যুক্ত। দেশের অধিকাংশ কৃষক এক ফসল থেকে আরেক ফসল তোলার মাঝের সময়ে বেকার থাকেন। এই সময়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ডেসটিনি গ্রুপ (Destiny Group) বৃক্ষরোপণ, ফসল চাষ ও ভাগাভাগি, এবং কৃষি শিল্পের মতো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে। “বাংলাদেশ: বেকারত্ব মুক্ত একটি দেশ” এই স্লোগানকে কেন্দ্র করেই ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড (Destiny 2000 Limited) তাদের যাত্রাপথ তৈরি করেছিল।
ডেস্টিনি গ্রুপের পরিকল্পনা ছিল একটি ব্যবসায়িক মডেল যেখানে সদস্যরা নতুন সদস্যদের যোগ দিতে প্রলুব্ধ করত এবং তাদের থেকে অর্থ উপার্জন করত। অনেকটা পিরামিড স্কিম (Pyramid Scheme) এর মতো। সাধারণত, গ্রুপের সদস্যরা নতুন সদস্যদের প্রাথমিক যোগদান ফি দিতে উৎসাহিত করত। সেই নতুন সদস্যরা আবার অন্যদের যোগ দিতে প্ররোচিত করত, এবং তারা যখন যোগদান ফি দিত, তখন কিছু অংশ পুরানো সদস্যদের মধ্যে বিতরণ হত। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকত এবং শৃঙ্খল বৃদ্ধির সাথে সাথে উপরের স্তরের সদস্যরা অনেক বেশি উপার্জন করতে থাকত।
ডেস্টিনি গ্রুপের এই পিরামিড স্কিমে (Pyramid Scheme) মূলত, পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি না করে শুধুমাত্র নতুন সদস্য সংগ্রহ করার উপরই গুরুত্ব দেয়া হত। এতে কিছু সদস্য ‘গোল্ড (Gold)’ এবং ‘সিলভার (Silver)’ পদক অর্জন করত, যা তাদের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করত। এসব পদক সাধারণত নতুন সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কৃতিত্বের প্রতীক হিসেবে দেওয়া হত এবং এটি তাদের মধ্যে আরও প্রচেষ্টা করার আগ্রহ তৈরি করত। তবে, এই পদকগুলো মূলত প্রতারণামূলক ছিল, কারণ তারা কোন প্রকৃত পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি না করে শুধুমাত্র নতুন সদস্য সংগ্রহের জন্যই অর্জিত হতো।
এটি একটি অস্বাস্থ্যকর ব্যবসায়িক মডেল ছিল, যেহেতু স্কিমের তলানির সদস্যরা প্রায়ই কোন উপার্জন করতে পারত না ।
এটি বিভিন্ন দেশেই অবৈধ এবং আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। তবে, কিছু পিরামিড স্কিম (Pyramid Scheme) এখনও বিভিন্ন দেশে আড়ালে পরিচালিত হতষয়, যেখানে মানুষ সস্তা লাভের প্রলোভনে পড়ে সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি দ্য ডেইলি স্টার (The Daily Star)-এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ডেসটিনি গ্রুপ (Destiny Group) ৪,২০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে উঠে আসে, ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন (Destiny Tree Plantation) প্রকল্প থেকে ২,৪৩৩ কোটি টাকা এবং ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি (Destiny Multipurpose Co-operative Society) প্রকল্প থেকে ১,৮৬১ কোটি টাকা প্রতারণা করা হয়েছে।
ডেসটিনির ট্রি প্ল্যান্টেশন (Destiny Tree Plantation) প্রকল্পে ১৭.৫ লাখ বিনিয়োগকারীকে ৬.১৮ কোটি চারা বিক্রির প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও, প্রকৃতপক্ষে মাত্র ৩২ লাখ গাছ রোপণ করা হয়। গোল্ডেন (Golden) ও সিলভার (Silver) প্যাকেজের মাধ্যমে উচ্চ মুনাফার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করা হয়। অন্যদিকে, DMCSL প্রকল্পের মাধ্যমে ৮.৫ লাখ বিনিয়োগকারীকে ৪৬% মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রতারণা করা হয়।
দুদক আরও জানায়, ডেসটিনির কর্মকর্তারা বেতন ও অন্যান্য খরচের নামে অর্থ আত্মসাৎ করে এবং ১০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে।
অন্যদিকে, ২০২২ সালের ১২ মে প্রকাশিত প্রথম আলো-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড (Destiny Multipurpose Co-operative Society Limited) প্রায় ১,৯৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে সংগ্রহ করে। ২০০৫ সালে MLM (Multi-level Marketing) পদ্ধতিতে কাল্পনিক লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়। তবে বর্তমানে DMCSL-এর ব্যাংক হিসাবে বিনিয়োগকারীদের মাত্র ৫০ লাখ টাকাই রয়েছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমিন ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন ব্যবসা ব্যর্থ হওয়ার পর এমএলএম পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিনিয়োগ সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত অর্থ বিভিন্ন নামসর্বস্ব কোম্পানিতে স্থানান্তর করা হয়, যা সমবায় আইন লঙ্ঘন করেছে।
দুদকের তদন্তে উঠে আসে, রফিকুল আমিন প্রায় ৪১ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। হারুন-অর-রশীদসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের অর্থ আত্মসাতে সম্পৃক্ততার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
২০২২ সালের ১২ মে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এই মামলায় রায় দেন। রফিকুল আমিনকে ১২ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। মোহাম্মদ হোসেনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ১.৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশীদকে চার বছরের কারাদণ্ড এবং ৩.৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বাকি আসামিদেরও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এই রায় ডেসটিনি গ্রুপের আর্থিক প্রতারণার পরিণতি হিসেবে একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হয়ে থাকবে।
সাম্প্রতিক কালে ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগে চলমান আইনি লড়াইয়ের এক নতুন মোড় এসেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তার জামিনের আবেদন খারিজ করেছে, ফলে তিনি কারাগারেই থাকবেন। আদালত অভিযোগের গুরুত্ব এবং বৃহত্তর জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে জামিন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, রফিকুল আমীন উচ্চ আদালত থেকে এক বছরের জামিন পেয়েছিলেন, তবে তার বিরুদ্ধে থাকা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি (Destiny Multipurpose Co-operative Society) এবং ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেডের (Destiny Tree Plantation Limited) নামে বড় আকারের অর্থ আত্মসাৎ এবং পাচারের অভিযোগ, যার ফলে প্রায় আট লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ডেসটিনির কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের ব্যবসায়িক ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, এবং জনগণের উচিত হবে এই ধরনের কেলেঙ্কারি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে আরও সতর্ক থাকা। বিনিয়োগকারীদেরও প্রয়োজন বিনিয়োগের আগে পুরোপুরি যাচাই-বাছাই করা এবং দ্রুত লাভের লোভে না পড়া।
এটা নিশ্চিত যে, ডেসটিনির মতো কেলেঙ্কারির পরিণতি আমাদের সবাইকে সতর্ক করে দেয় যে, ব্যবসায়িক জগতে সততা ও স্বচ্ছতার গুরুত্ব অপরিসীম।
আপনার মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করুন । আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে ভুলবেন না, যাতে ভবিষ্যতে আরও Business related content পেতে পারেন।