CP Five Star: বাংলাদেশের পোল্ট্রি আর পশু খাদ্যের মুল সিন্ডিকেটর
ঘরে থাকুন বা বাইরে, হঠাৎ করেই যদি আপনার ছোট খাটো ক্ষুদা কে নিবারণ করতে মুখরোচক কিছু খেতে ইচ্ছে করে, তাও আবার সাধ্যের মধ্যে তবে সবার আগে আপনার কার কথা মাথায় আসবে? হ্যা, CP Five Star এর নাম ই কিন্তু আসবে! । ঢাকা শহর তো বটেই দেশের সব জায়গাতেই এমনকি বাসার পাশে ছোট্ট গলিতে আপনি CP Five Star এর ছোট্ট দোকানের দেখা পাবেন। কিন্তু কেনো? যেখানে KFC, BFC, এবং Kazi Farms এর মত কম্পিটিটর রয়েছে তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে CP কি করে সাধারণ মানুষের মনে এতটা জায়গা করে নিলো? কি তাদের স্ট্রেট্যেজি যা তাদের এতটা সফলতা এনে দিয়েছে? কেনই বা তাদের বলা হয় পোল্ট্রি শিল্পের ভাগ্যবিধাতা? তারাই কি পোল্ট্রি আর পশু খাদ্যের মুল সিন্ডিকেটর? কেনই বা আবার তাদের বিরুদ্ধেই আনা হয়েছে দাস প্রথার পুনরাবৃত্তির মত এমন গুরুতর অভিযোগ। এ সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই খুঁজবো আমরা আজকে। জানবো এর জন্ম ও বাংলাদেশে এর প্রসারের গল্প।
CP এর জন্ম কোথায়?
১৯২১ সালে থাইল্যান্ডে(Thailand) প্রতিষ্ঠিত Charoen Pokphand সংক্ষেপে CP গ্রুপকে সর্বদাই থাইল্যান্ডের বৃহত্তম বেসরকারি কোম্পানি এবং সেইসাথে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সংগঠন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৯২১ সালে যখন চীনের ব্যাংককের শাসনামল চলছিল তখন অভিবাসী দুই ভাই চিয়া য়েক এবং চিয়া জিন হায়াং যারা কিনা চীনের শানতোঊ থেকে এসেছিলো, তারা ব্যাংককের সোঙ্গাওয়াট রোডে চিয়া তাই চুং নামে একটি বীজের দোকান শুরু করে। তারা চীন থেকে বীজ এবং শাকসবজি আমদানি করত আর হংকং, তাইপেই, কুয়ালালামপুর এবং সিঙ্গাপুরে শূকর ও ডিম রপ্তানি করত । এভাবেই দুই ভাই, যারা বলা যায় তখন একেবারেই অর্থহীন ছিল, তারা তাদের ক্ষুদ্র বীজের দোকান শুরু করার জন্য যথেষ্ট পুঁজি একসাথে জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিল। ব্যবসার অস্তিত্বের প্রথম কয়েক বছর ধরে, দুই ভাই তাদের নিজস্ব টার্গেট বাজারের খোজে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যায়। 1950-এর দশকের মধ্যে দোকানটি পুরোপুরি দাঁড়িয়ে যায় এবং পশুখাদ্য রপ্তানি করতে শুরু করে।
বাংলাদেশে CP
সেই থেকেই , সিপি(CP) গ্রুপ বিশ্বের যেখানেই ব্যবসার কোন সম্ভাবনা দেখেছে সেখানেই তার প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘায়িত করেছে। এভাবেই বিভিন্ন দেশে তাদের ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় 1998 সালে, সিপি গ্রুপ Board of Investment নিবন্ধনের মাধ্যমে বাংলাদেশেও তার ব্যবসা শুরু করে। পরের বছর 1999 সালে, এটি C.P নামে একটি লিমিটেড কোম্পানি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় যা পরে সিপি বাংলাদেশ কোং, লিমিটেড (সিপিবি) হিসাবে আত্বপ্রকাশ করে এবং তাদের সেই সময় এর স্লোগান ছিল কিচেন অফ বাংলাদেশ(Kitchen of Bangladesh) বা “বাংলাদেশের রান্নাঘর” । প্রথম দিকে, সিপিবি(Communist Party of Bangladesh) সাভারে প্রথম ফিড মিল “সাভার ফিড মিল” এবং গাজীপুর, মৌচাকের কাছে একটি হ্যাচারি দিয়ে শুরু করে। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি সিপিবিকে। একটি ট্যালেন্ট পুল সহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কৌশলের মাধ্যমে CPB তার ব্যবসাকে ফিড থেকে ফার্ম এবং ফুডেও প্রসারিত করেছে।
কিন্তু কিভাবে হল CP এর উত্থান?
বিগত দুই দশকে CP বাংলাদেশে খাদ্য ব্যবসার পাশাপাশি কৃষি শিল্প, এবং পোল্ট্রি শিল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। পোল্ট্রি সেক্টরে এটি নানা ধরণের পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ করে আসছে। যেমন, পশু খাদ্য, মুরগীর খাদ্য, মাছের খাদ্য। আবার এটি দেশের অন্যতম বৃহৎ মুরগী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও। বয়লার, লেয়ার সহ সব ধরণের মুরগী এবং মাছের পোনা উৎপাদনে তারা ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে এটি পোল্ট্রি শিল্পে নেতৃত্ব স্থানীয় পর্যায়ে আছে।
সারাদেশে সিপি এর মোট ৫ টি ফিড মিল আছে। তবে হেড অফিসটি অবস্থিত গাজীপুরের চন্দ্রায়। পশু খাদ্য উৎপাদনে CP অত্যাধুনিক ফিড মিলটি তৈরি করা হয়েছে ক্লোজড সিস্টেম হিসেবে। বাংলাদেশ সিপির প্রেসিডেন্ট Shuchat Suntipada (শুচাত সুঁতিপদ) এর ভাষ্যমতে, তারা এদেশে মূলত পোল্ট্রি এবং ফিস সেক্টর নিয়ে কাজ করতে এসেছে। পাশাপাশি এদেশের কৃষকদের কাঁচামাল উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত করে উন্নতমানের খাদ্য তৈরি করা। এবং তারা তা সফল ভাবে করেও যাচ্ছে। বর্তমানে এটি কাজী ফার্মস(Kazi Farms) এর সাথে সমান তালে প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছে পোল্ট্রি শিল্পে নিজেদের শীর্ষ স্থানে ধরে রাখতে।
CP-এর জনপ্রিয়তার কারন কি?
সিপি নিজেকে শুধু কৃষি শিল্প, মৎস্য ও পোল্ট্রি শিল্পে আটকে না রেখে ফ্রাইড চিকেন (Fried Chicken) হিসাবে রেডি টু ইট খাবার এবং সিপি চিকেন বল(CP chicken ball) এবং সিপি চিকেন সসেজের(CP chicken sausage) মতো ঠাণ্ডা পণ্য হিসাবে রেডি টু কুক খাবার প্রস্ততকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সিপির ফাস্ট ফুড(Fast food) এবং ফ্রজেন ফুড(Frozen Food) এখন সবার কাছে বেশ জনপ্রিয় এর কম্প্রমাইজিং প্রাইসের কারণে।
সিপি তাদের ফাস্ট ফুড আইটেম গুলোর প্রাইসিং সাধারণ ভোক্তা যারা মধ্যবিত্ত বা কম বাজেটে ভালো কিছু খেতে চায় তাদের কথা মাথায় রেখে নির্ধারণ করেছে। ফলে মানুষ কম মূল্যে KFC এবং BFC-এর কাছাকাছি মানের খাবার খেতে পারছে। যা সিপি কে এতটা জনপ্রিয় করে তুলেছে।
CP Five Star মূলত তার কাস্টমারদের সাধ্যের মধ্যে সব টুকু সুখ দেয়ার পলিসি এপ্লাই করেছে। এটি দেশের ম্যাক্সিমাম কাস্টমার যারা কিনা উচ্চ মূল্যের ফাস্টফুড এফোর্ড করতে পারে না তাদের কথা মাথায় রেখে পণ্যের মান এবং দাম ঠিক করে। আর তাছাড়া সিপি তাদের Five Star ফুড সারা দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজিং-এর মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। যেহেতু তাদের খাবারের দাম তুলনামূলক অনেক কম তাই সব ধরনের ক্রেতারাই এটি কিনতে পারে। আর ঠিক এভাবেই সিপি , KFC এবং BFC র চাইতে বেশি নিজেকে সম্প্রসারণ করতে পেরেছে।
সিপি গ্রুপ তাদের Kichen of Bangladesh নামক vision নিয়েই মাঠে নেমেছে। তারা রেডি টু কুক প্রোডাক্ট তৈরি করে আপনার কিচেনে আপনার পছন্দের খাবার কোন ঝামেলা ছাড়াই তৈরি করতে সাহায্য করছে। অর্থাৎ মুরগী , মাছ উৎপাদন হতে শুরু করে তা আপনার কড়াইতে ভাজার উপযোগী করা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ধাপেই নিজেদের অবদান রাখছে। আর তাদের এই বিশাল ব্যবসায়িক কর্মযজ্ঞে এর যেকোনো পর্যায় থেকে আপনার চাহিদা অনুযায়ী যে কোন পণ্য পেয়ে যাবেন। সিপির এই বিশাল ব্যবসায়িক চেইনই এটির ব্যবসাকে এতটা জায়ান্ট রূপ দিয়েছে।
কিন্তু গল্পটি যখন শোষনের
তবে এতটা সফলতার মাঝে হঠাৎ করেই অভিযোগ ওঠে তারা নাকি তাদের ফুড ফ্যক্টেরিতে কর্মীদের দিয়ে দাস প্রথার ন্যায় কাজ করায়। অভিযোগ উঠে কর্মীদের দেড় বছর ধরে কারখানার ভেতরে আটকে রেখে কাজ করিয়েছে সিপি গ্রুপ। মূলত করনা(Covid-19) কালীন লক-ডাউনের সময় করনার দোহাই দিয়ে সিপির প্রধান ফ্যক্টেরির প্রায় ১০০ কর্মীর ফ্যাক্টরির বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু করনা পরবর্তী সময়ে এসেও কর্মীদের একি ভাবে আটকে রেখে কাজ করিয়েছে করনার দোহাই দিয়েই।
কারখানার ভেতরেই কর্মীদের জন্য বানানো হয় অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা।চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ মুখ ও খুলতে নারাজ ছিলো। যেকোনো ধরণের জরুরী অবস্থায় ও মিলত না বাইরে বের হবার অনুমতি। যেটি ছিলো পুরপুরিই শ্রম আইনের বিরুদ্ধে। বের হলেই চাকরি হারানোর ভয় ছিলো। যদিও এই অভিযোগকে সিপি গ্রুপ বরাবর অস্বীকার করে। কিন্তু শ্রম মন্ত্রণালয়ের তদন্তে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। যদিও এই অভিযোগ শুধুমাত্র সিপির একটি মাত্র ফ্যক্টরিকে নিয়েই উঠেছিলো।
এ ছাড়া ও তাদের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ উঠে যে তারা মৃত পশু ও মুরগির চামড়া ও অন্যান্য পরিত্যক্ত অংশ থেকে পশু খাদ্য ও মুরগীর খাবার প্রস্তুত করে থাকে।
আসলে কি খাচ্ছি আমরা?
আমরা ফার্মে লালিত পালিত যে মাছ ও মুরগীগুলো খাচ্ছি তা কতটা স্বাস্থ্য সম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। গবেষণা করে দেখা গেছে ব্রয়লার মুরগীর মগজ, হাড়, লিভার এ রয়েছে হেভি মেটাল সহ বিষাক্ত উপাদান যা আমাদের মারাত্বক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে যারা পোল্ট্রি-ফিশ ফিড প্রস্তুত করছে তারা মূলত ভেজাল বিষাক্ত ট্যানারির বর্জ্য, মুরগীর বিষ্ঠা, রাসায়নিক সার, পঁচা বেকারির পণ্য দিয়ে ফিড গুলো তৈরি করছে। তাই এটাও ধারণা করা হয় যে, সিপি ও তাদের ফিডে এই উপাদানগুলো ব্যবহার করে আসছে।
যদিও এই অভিযোগ ও সিপি গ্রুপ স্বীকার করতে নারাজ। এই সকল গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্যেও সিপির ব্যবসায়িক প্রসার কমেনি এতটুকু। বরং জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে সমান তালে। সিপি গ্রুপের একটি অন্যতম ভালো স্ট্রেটেজি হলো এটি সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদের আপডেট করে নেয়। ব্যবসায় যুগের পর যুগ টিকে থাকার জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্ট্র্যটেজি। যার দরুণ গত ১০০ বছর ধরে সিপি সারা বিশ্বে তাদের ব্যবসা একি ভাবে সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে।
সিন্ডিকেটের নগ্ন থাবা
এখন অনেকের ই ধারনা বিশেষ করে খামারিদের, যে, সিপি এবং কাজী ফার্মস, এই দুই কোম্পানী ই মুরগী এবং ডিম উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির পিছনের মুল হোতা । যেহেতু মুরগীর বাচ্চা উৎপাদন হতে শুরু করে এর খাবার প্রর্যন্ত প্রয়োজনীয় সবই তাদের কাছ থেকেই কিনে থাকে সবাই, তাই উৎপাদন ব্যয় টাও তাদের উপর নির্ভর করে অনেকটাই। বাংলাদেশে পোল্ট্রি বাজারের অন্যতম ধারক এবং বাহক সিপি গ্রুপ। এই খাতে বাজার নিয়ন্ত্রক ও তাদের কে বলা চলে। বলা হয়ে থাকে পোল্ট্রি শিল্পে এবং পশু খাদ্যের দাম সিন্ডিকেটে সিপি এবং কাজি ফার্মস এর হাত রয়েছে। তাই ধারনা করা হয় ডিম বা মুরগী যাই আপনি কিনুন না কেন তার দাম নিয়ন্ত্রক কিন্তু তারাই। তাদের কাছে এই খাতে সরকার মোটামুটি অসহায় ই বলা চলে।
তো কেমন লাগলো আমাদের আজকের ভিডিও টি? কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। ব্যবসা সম্পর্কিত নিত্য নতুন তথ্য পেতে চাইলে নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করে ফেলতে পারেন এখনি। আজকের জন্য এই পর্যন্তই। ধন্যবাদ।