সুস্থতা নাকি স্বাদ? প্যাকেটজাত খাবারের গেম চেঞ্জার! | Healthy or Tasty | Bombay Sweets | Business Mania
“পটেটো ক্রেকার্স” নামটা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে চিপস ভর্তি সবুজ রঙের একটা প্যাকেট। বাংলাদেশে ৯০ এর দশকে বেড়ে উঠা জেনারেশনটার শৈশবকে আপনি যদি ডিফাইন করতে চান, তাহলে যে কয়েকটা জিনিসের নাম অবশ্যই উঠে আসবে তার মধ্যে “পটেটো ক্রেকার্স” একটি।
হাল আমল থেকে শুরু করে এখন অব্দি ঢাকার একদম অভিজাত এলাকার কোন নামী দোকান থেকে শুরু করে একদম প্রান্তীয় অঞ্চলের কোন দোকান কিংবা সেন্ট মার্টিনেও যান সেখানেও আপনি পেয়ে যাবেন ” পটেটো ক্রেকার্স” চিপসটি। একারণে একে বাংলাদেশের জাতীয় চিপস বললেও তেমন একটা ভুল হবে না।
প্রিয় পাঠক business mania r আমাদের আজকের ব্লগটিতে ” পটেটো ক্রেকার্স ” এর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান “বোম্বে সুইটস” কে৷ যার ঝুলিতে রয়েছে পটেটো ক্রেকার্স এর মতোই আরো কয়েকটি ব্যাপক জনপ্রিয় পন্য। তাহলে চলুন ভিডিওটি শুরু করা যাক।
নাম শুনলেই বোঝা যায় বোম্বে সুইটস এর সাথে মিষ্টি বা সুইটস এর কোন না কোন একটা সম্পর্ক আছে। আসলেই তাই। বোম্বে সুইটস এর যাত্রা শুরু হয়ে জীভানি পরিবারের হাত ধরে ১৯৪৮ সালের দিকে। ওই সময় বোম্বে বা ভারতের মুম্বাই ছিল মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। বিশেষ করে লাড্ডু বর্ফি এর জন্য। আর আমাদের জীভানি সাহেব এর মিষ্টির প্রতি ছিল একটা অন্যরকম ভালোবাসা।
তাই তিনি নামের সাথে মিল রেখে ঢাকার নওয়াবপুরে মিষ্টির একটা দোকান দেন। যেখানে তিনি সেসময়ের জনপ্রিয় লাড্ডু, বরফি, প্যারা এবং রসগোল্লার মত মুখরোচক মিষ্টি বিক্রি করতেন। মিষ্টির পাশাপাশি আরেকটা জিনিস তার দোকানে পাওয়া যেত। যেটা হলো চানাচুর। এই দুই জিনিস এর জন্যই সেসময় জিভানি সাহেবের দোকান পুরান ঢাকায় বেশ জনপ্রিয় ছিল।
এরপর ধীরে ধীরে ঢাকার বাইতুল মোকারম ও নিউ মার্কেট এলাকাতেও গড়ে উঠে বোম্বে সুইটস এর দোকান। আর এসবই মুক্তিযুদ্ধের আগের ঘটনা।
পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে বোম্বে সুইটস মিষ্টি আর চানাচুর এর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের তৈরী খাবার যেমন কেক, বিস্কুট ও পানীয় বিক্রি করতে শুরু করে। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কমলা, লেবু ও আনারসের জুস। এই সময়টাতে এসে বোম্বে সুইট মিষ্টি তৈরীর থেকে নোনতা আর ঝাল খাবার যেমন চানাচুর, বিস্কুট এসবের দিকে বেশি নজর দেয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেসময় ঢাকার কাপ্তান বাজার, বনগ্রাম, রাকিন স্ট্রিট ও ফকিরাপুলে বোম্বে সুইট এর বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র কারখানা গড়ে উঠে। বর্তমানে ঢাকায় ও নারায়ণগঞ্জ এ বোম্বে সুইট এর দুটি বিশাল ফ্যাক্টরি আছে।
এরপর ১৯৮৫ সালে তারা প্রথম বারের মতো রিং চিপস বাজারে আনে যেটা ছিল বাংলাদেশের বাজারে প্রথম কোন প্যাকেটজাত চিপ্স। এবং বাজারে আসার পর পরই শিশু-কিশোরদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শুধু তাই নয় হলুদ প্যাকেটে রিং এর সাইজের চিপসগুলো বাংলাদেশের বাজারে এখনও বেশ জনপ্রিয়।
এরপর ১৯৮৮ সালে বাজারে আনে পটেটো ক্রেকাস। এটাকে বাংলাদেশের জাতীয় চিপ্স বললেও ভুল হবে না। তারপর ১৯৯৬ সালে মিস্টার টুইস্ট নামে আরেকটা চিপস বাজারে আনে। এটিও অল্প সময়ের মধ্যেই দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০১২ সালে বম্বে ‘আলুজ’ নামে আলুর চিপসের একটি নতুন সংস্করণ চালু করে, তিনটি ভিন্ন ফ্লেভারের আলুজ বাজারে আনা হয়। যার প্রতিটিই বর্তমান প্রজন্মের শিশুদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
এরপর ২০১৭ সালে তারা পাস্তা চিপস তৈরি ও বাজারজাতকরণ কফা শুরু করে, যা দেখতে অনেকটা পাস্তার মতো হলেও খেতে মচমচে টাইপ এর। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে তারা বাজারে এনেছে নাগা চিপস।
এছাড়াও বাংলাদেশের বাজারে জনপ্রিয় চানাচুর বোম্বে চানাচুর, ডালমুট এসব ও প্রতিষ্ঠানটি তৈরী করে থাকে৷ শুরু থেকে এখন অব্দি বাংলাদেশের প্রতিটা ঘরে ঘরে বোম্বে চানাচুর এখনো সমান জনপ্রিয়।
এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি খাবার প্রস্তুতকে সহজ করতে বাজারে নিয়ে এসেছে প্রক্রিয়াজাত রান্নার মিশ্রণ যেমন খিচুড়ি মিক্স, শাহী হালিম মিক্স, ফালুদা মিক্স ও বিরিয়ানি মিক্স, যেগুলো অল্প সময়ে রেস্তোরাঁর স্বাদের খাবার ঘরে প্রস্তুতের সুবিধা দেয়। ভোজ্যতেল বিভাগে তারা সরিষার তেল উৎপাদন করে, যা প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তৈরি বলে দাবি করা হয়। বম্বে ডালমুঠ, ঝাল মুড়ি ও অন্যান্য ট্র্যাডিশনাল নাস্তা জাতীয় পণ্যও তৈরি করে, যেগুলো দেশে প্রতিদিনকার হালকা খাবারের অংশ হয়ে উঠেছে।
পাশাপাশি তারা বাজারে এনেছে সুগন্ধি চিনিগুড়া চাল, যা মূলত পোলাও ও স্পেশাল ভাত জাতীয় খাবারের জন্য ব্যবহৃত হয়। পানীয় পণ্যের মধ্যে রয়েছে ম্যাংগো জুস (Juicy ব্র্যান্ডে), এবং আধুনিক রাঁধুনিদের জন্য রয়েছে প্যাকেটজাত পাস্তা। তাদের নতুন চিপস ভ্যারিয়েন্ট ‘চিপস্টার পটেটো স্টিকস’ আকারে ছোট ছোট স্লাইসে কাটা আলু চিপস, যা সহজে খাওয়ার উপযোগী। বেকারি লাইনেও প্রতিষ্ঠানটি বিস্কুট, ড্রাই কেকসহ বিভিন্ন হালকা খাবার তৈরি করছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা ফ্রোজেন ফুড ক্যাটাগরিতে প্রবেশ করেছে—যেমন স্প্রিং রোল প্যাস্ট্রি, হাতের পরোটা ও পুরি—যা হিমায়িত অবস্থায় সংরক্ষণ করে প্রয়োজনমতো গরম করে খাওয়া যায়। সবমিলিয়ে, বম্বে সুইটস এখন দেশের খাদ্যপণ্যের বাজারে একটি বিস্তৃত পরিসরের প্রতিষ্ঠান, যারা স্ন্যাকস, বেকারি, রান্নার উপকরণ, পানীয় এবং ফ্রোজেন খাবার পর্যন্ত নানাধরনের পণ্য সরবরাহ করে আসছে, এবং মান ও স্বাদের ক্ষেত্রে নিরবিচারে ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করে চলেছে।
স্বাভাবিক কারণেই বোম্বে সুইট তাদের পণ্য উতপাদনের জন্য ব্যাপক হারে কৃষিজ কাচামাল ও প্যাকাটিং করার দরকার পরে। এরই লক্ষ্যে বোম্বে সুইট গড়ে তুলেছে নিজস্ব প্যাকেটিং প্রতিষ্ঠান।
প্রথমে রয়েছে বম্বে এগ্রো লিমিটেড (BAGL) বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এবং এটি প্রধানত বম্বে সুইটসের কাঁচামাল সরবরাহ করে। BAGL কৃষিজাত পণ্য যেমন আলু, তেল, মসলাসহ অন্যান্য কৃষি পণ্য চাষ করে এবং তা সঞ্চয় করে, যাতে বম্বে সুইটস তাদের পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণে চাহিদা মেটাতে পারে। এর মাধ্যমে বম্বে সুইটসের কাঁচামালের সরবরাহের গতি ও স্থায়িত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়।
এছাড়াও, ট্রাইসপ্যাক লিমিটেড একটি গুরুত্বপূর্ণ সহপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানিটি বম্বে সুইটসের পণ্যগুলোর প্যাকেজিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রস্তুত করে। তারা নমনীয় প্যাকেজিং তৈরি করে, যা খাবারের সতেজতা এবং মান বজায় রাখতে সাহায্য করে। ট্রাইসপ্যাক বম্বে সুইটসের বিদেশী এবং দেশীয় বাজারের জন্য উপযুক্ত প্যাকেজিং সরবরাহ করে, যার মাধ্যমে পণ্যগুলোর শেলফ লাইফ বাড়ানো যায়।
আরেকটি সহপ্রতিষ্ঠান হলো কুলিয়াচর ডেইরি কমপ্লেক্স (KDC)। এটি ১৯৮৩ সাল থেকে কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়াচর এলাকায় অবস্থিত এবং বম্বে সুইটসের জন্য মানসম্পন্ন পনির উৎপাদন করে। কুলিয়াচর এলাকা যেহেতু ‘মিল্ক পকেট’ নামে পরিচিত, এখানে পনির উৎপাদনের জন্য আদর্শ পরিবেশ রয়েছে, যা বম্বে সুইটসের পণ্যগুলোর জন্য একটি বড় সহায়ক উপাদান। পনিরের মান উন্নত এবং সুস্বাদু হওয়ায়, এটি বম্বে সুইটসের পণ্যের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠে।
তাছাড়া, তাকধুম লিমিটেড একটি ভিডিও ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে, যা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির জন্য শিল্প নির্দেশনা প্রোগ্রাম সরবরাহ করে। এই প্রতিষ্ঠানটি শহরজুড়ে আউটলেটগুলোতে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে, যা যুব সমাজের মধ্যে ভালো মূল্যবোধ এবং শৈল্পিক দক্ষতা তৈরি করতে সাহায্য করে।
বর্তমানে বম্বে সুইটস শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও তাদের পণ্য রপ্তানি করছে। বর্তমানে তাদের প্রধান রপ্তানি বাজার হচ্ছে আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য। এছাড়া ইউকে, জার্মানি, ইতালি সহ কিছু ইউরোপীয় দেশেও তাদের পণ্যগুলো চাহিদা পাচ্ছে। তবে আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে পণ্যের চাহিদা থাকলেও, সেখানে সস্তা মূল্যে পণ্য বিক্রি করা নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে বম্বে সুইটস তার মানের ওপর কোনো ছাড় দেয়নি এবং তাদের পণ্যগুলোর গুণগত মান বজায় রেখে রপ্তানি করছে। আর একারণেই বিশ্ব এর প্রায় ৫০টির অধিক দেশে বোম্বে সুইট তাদের পণ্য রপ্তানি করে থাকে।
প্রিয় পাঠক আমাদের আজকের ব্লগটা এই অব্দি। বোম্বে সুইটসের আপনার পছন্দের চিপস কোনটি? পটেটো ক্রেকার্স,
আলুজ, মিস্টার টুইস্ট নাকি রিং চিপস? আমাদের কমেন্ট করে জানাতে কিন্তু ভুলবেন না। সেই সাথে ব্লগটি পড়ে
কেমন লাগলো আমাদের জানাবেন। কোন সংশোধন থাকলে তাও জানাবেন।
আর ব্লগটি পড়ে ভালো লাগলে লাইক দিয়ে শেয়ার করতে ভুলবেন না। এমন আরো ব্লগ পড়তে চাইলে আমাদের
ওয়েবসাইটে ই-মেইল সাবক্রাইব করতে পারেন। আর বোম্বে সুইট এর একমাত্র প্রতিদ্বন্দী প্রতিষ্ঠান প্রানকে নিয়েও
আমাদের ওয়েবসাইটে একটি ব্লগ আছে চাইলে সেটিও পড়ে আসতে পারেন।