AKTEL থেকে Robi : টেক জায়ান্ট Robi’র ডিজিটাল বিপ্লব! | Robi vs Starlink | Business Mania
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর কোম্পানি হচ্ছে রবি।
কিন্তু ভাবুন তো, শুধু মোবাইল সেবা দিয়ে যাত্রা শুরু করা কোম্পানিটি, কীভাবে সময়ের সাথে পরিণত হলো দেশের ডিজিটাল বিপ্লবের অন্যতম চালিকাশক্তিতে? ইন্টারনেট, ভয়েস কল, ডেটা, সাইবার সিকিউরিটি, এমনকি স্টার্টআপ ইনভেস্টমেন্ট, প্রযুক্তির প্রতিটি খাতেই পড়েছে তাদের ছোঁয়া। Robi এখন আর কেবল একটি মোবাইল অপারেটর নয়, বরং একেক সময়ে একেক রূপে হাজির হয়ে দেশের টেলিকম ও প্রযুক্তি খাতকে নিয়ে গেছে এক নতুন মাত্রায়।
রবির শুরু, উত্থান, প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে থাকছে Business Mania-র আজকের ব্লগটিতে।
১৯৯৭ সাল। বাংলাদেশের টেলিকম খাত তখনও অনেকটা সীমাবদ্ধতায় ঘেরা। ঠিক তখনই দেশের বাজারে আত্মপ্রকাশ করে AKTEL, একটি মালয়েশিয়ান ও বাংলাদেশি যৌথ উদ্যোগ এ চালু হয় কোম্পানিটি । Telekom Malaysia এবং দেশের বিখ্যাত শিল্পপ্রতিষ্ঠান AK Khan & Company, এই কোম্পানিটি চালু করে। AK Khan & Company একটি বহুমুখী প্রতিষ্ঠান, যারা মূলত টেক্সটাইল, টেলিকম, রিয়েল এস্টেট, লজিস্টিকস, ফাইন্যান্স ও অ্যাগ্রো খাতে কাজ করে।
এইদিকে AKTEL শুরু থেকেই গ্রাহকদের কম দামে ভালো সার্ভিস দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তবে পরিবর্তন আসে ২০০৭ সালে, যখন AK Khan তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেয় জাপানের টেলিকম জায়ান্ট Docomo-কে। সেই সময়েই কোম্পানির প্রযুক্তিগত দিক থেকে বড় রকমের পরিবর্তন শুরু হয়।
২০১০ সাল ছিল Robi’র ইতিহাসে এক বিশাল মোড়। সেবার তারা একদম নতুন রূপে, নতুন চিন্তাধারায় ‘Robi’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। নামের মধ্যেই সূর্যের মতো আলো ছড়ানোর প্রতিশ্রুতি। এই নতুন রিব্র্যান্ডিংয়ের পেছনে ছিল মালয়েশিয়াভিত্তিক টেলিকম জায়ান্ট Axiata Group, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মোবাইল নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে তারা । Robi তাদের অংশীদারিত্বে হয়ে ওঠে Axiata Group-এর, আর সেখান থেকেই শুরু হয় Robi’র এক নতুন যাত্রা।
২০১৬ সাল ছিল Robi’র জন্য আরেকটি ঐতিহাসিক বছর। দীর্ঘ আলোচনার পর Airtel Bangladesh-এর সাথে সফলভাবে একীভূত হয়ে Robi বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটরে পরিণত হয়। এই একত্রীকরণের মাধ্যমে তারা ০১৬ সিরিজের মালিকানা লাভ করে এবং গ্রাহক সংখ্যা ৩ কোটির ঘর ছাড়িয়ে যায়। এই পরিবর্তন তাদের নেটওয়ার্ক কাভারেজ, সার্ভিস কোয়ালিটি ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। Robi সবসময় প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে আগ্রহী ছিল। তারা সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে GPRS এবং পরবর্তীতে ৩.৫জি চালু করে, যা ছিল দেশের মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবস্থার এক যুগান্তকারী পরিবর্তন।
২০০০ সালের শুরুর দিকে GPRS-ই ছিল মোবাইল ইন্টারনেটের প্রথম ধাপ। সেটা ছিল এক বিশাল অর্জন, কারণ তখন ফোনে ইন্টারনেট মানেই ছিল নতুন কিছু। পরবর্তীতে তারা 4G, VoLTE বা এক কথায় 4G নেটওয়ার্কে HD ভয়েস কল সুবিধা এবং eSIM চালু করে দেশের টেলিকম ইন্ডাস্ট্রিকে একটি নতুন স্তরে নিয়ে যায়।
২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, Robi-এর ১৮,৪৭৩টি মোবাইল টাওয়ার রয়েছে, যার মাধ্যমে দেশের ৯৮.৮ শতাংশ মানুষ নেটওয়ার্ক সেবার আওতায় রয়েছে। তাদের হাতে বর্তমানে ১২৪ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম রয়েছে, যার মধ্যে ১০৪ মেগাহার্জ বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে এবং বাকি ২০ মেগাহার্জ ২০২৫ সালে যুক্ত হবে। ভাবছেন হয়তো এই স্পেকট্রাম, মেগাহার্জ এগুলো আবার কি ?? স্পেকট্রাম basically নেটওয়ার্কের জন্য প্রয়োজনীয় রেডিও তরঙ্গের পরিসর। আর মেগাহার্জ সেই তরঙ্গেরই পরিমাপ।
যাই হোক, Robi শুধু একটি সেলুলার নেটওয়ার্ক নয়, তারা নিজেদের এখন একটি পূর্ণাঙ্গ টেক কোম্পানি হিসেবে প্রমাণ করেছে । তাদের মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যতীত রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সেবা । তারা দেশের টেলিকম খাতে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন Kaspersky Premium সাইবার সিকিউরিটি সেবা চালু করে । এটি প্রযুক্তি ও নিরাপত্তার এক যুগান্তকারী সংযোজন। শুধু তাই নয়, Cyphern নামে দেশের প্রথম প্রাইভেট Tier-IV ডেটা সেন্টার চালু করেছে যশোরে, যেটি ৯৯.৯৯৫% আপটাইম গ্যারান্টি দেয় এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখে।
Robi তাদের উদ্যোগ আরও সম্প্রসারিত করে r-Ventures নামে একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করে, যা তরুণ উদ্যোক্তাদের আইডিয়া বাস্তবায়নে সহায়তা করে। এছাড়া, তারা Red.Digital এবং Axentec-এর মতো কোম্পানির মাধ্যমে আইটি ও সফটওয়্যার সার্ভিসের ক্ষেত্রে নিজেদের বিস্তারকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে ।
তাদের কর্পোরেট কালচারে তরুণদের গুরুত্ব অপরিসীম। Robi’র Graduate Trainee Program দেশের অন্যতম কাঙ্ক্ষিত কর্পোরেট প্রোগ্রাম হিসেবে পরিচিত। ২০১৭ সালে তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় GSMA Awards-এ, ‘Best Mobile Innovation for Education and Learning’ ক্যাটাগরিতে।
রবি “মাই রবি” মোবাইল অ্যাপ চালু করে প্রতি মাসে ১.৯৫ কোটি গ্রাহককে সেবা দিচ্ছে । দেশের প্রথম জাতীয় অ্যাপস্টোর “বিডিঅ্যাপস” এর উদ্যোক্তা হিসেবে রবি ৬৫ হাজারেরও বেশি তরুণ অ্যাপ ডেভেলপারকে প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে, যেখানে এখন পর্যন্ত ১ লাখের বেশি মোবাইল অ্যাপ হোস্ট করা হয়েছে। ডিজিটাল স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ ও পরামর্শের জন্য এবং ভেঞ্চার্স ফান্ড গড়ে তুলেছে রবি। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবায় বাংলাদেশের পোস্ট অফিসের “নগদ”-এর সাথে ২০২০ সালে চুক্তি করে রবি প্রায় ৫ কোটি গ্রাহককে ডিজিটাল টাকা ব্যবহারের আওতায় আনে ।
রবি আর্থিক হিসেবে সুদৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। ২০২৪ সালে কোম্পানিটির লাভ ছিল ৭০৩ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ১১৯% বৃদ্ধি। অপরদিকে ওই বছর মোট রাজস্ব প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও, গ্রাহক সংখ্যা ৩.৩% কমে গেছে। তুলনামূলকভাবে ২০২৩ সালে লাভ ছিল ৩২১ কোটি । যার ফলে, বাজারে অবস্থান আর প্রতিযোগিতায় রবি দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ গ্রাহকসংখ্যায় গ্রামীণফোন ৮৪.৯০ মিলিয়ন, রবি ৫৬.৩৯ মিলিয়ন, বাংলা লিংক ৩৮.৬৪ মিলিয়ন ব্যবহারকারী দেখিয়েছে । এই হিসেবে রবি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর হিসেবে অপরিবর্তিত।
Robi বর্তমানে Banglalink-এর সঙ্গে একটি নেটওয়ার্ক শেয়ারিং চুক্তিতে অংশ নিয়েছে,বলা যায় এটি ৪জি কাভারেজ বাড়াতে সহায়ক হবে। ভবিষ্যতে তারা ৫জি সেবা চালুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, যদিও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিদ্যমান অবকাঠামোগত বাধাগুলো সেই পথে কিছুটা জটিলতা তৈরি করতে পারে।
তবে বড় প্রশ্ন হলো, Robi-এর ভবিষ্যৎ কেমন? বিশ্ব প্রযুক্তি অঙ্গনে যখন নতুন নতুন প্রতিযোগী উঠে আসছে, তখন Robi-র সামনে চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা,দুটোই সমানভাবে বিদ্যমান। বিশেষ করে Starlink এবং SpaceX-এর মতো আন্তর্জাতিক tech জায়ান্টরা যখন বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করছে, তখন Robi-র মতো প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির জন্য প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়ে উঠবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই নতুন প্রতিযোগীরা শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত দিক থেকেই নয়, বরং সেবার মান, গতি এবং ব্যয়ের দিক থেকেও গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হতে পারে।
এছাড়া, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নতুন সরকারের নীতিগত পরিবর্তনও Robi-র জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। নীতিমালার পরিবর্তন, বিনিয়োগ পরিবেশের অনিশ্চয়তা এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা Robi-র সম্প্রসারণ পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, যেমন ৫জি প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বৃদ্ধি, এবং ক্লাউড কম্পিউটিং-এর প্রসার, তাদের জন্য নতুন বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করবে।
Robi-এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তাদের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, বাজারের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, এবং দেশের নীতিনির্ধারকদের সাথে কার্যকর সমন্বয়ের উপর। যদি তারা এই চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবেলা করতে পারে, তাহলে তারা দেশের ডিজিটাল বিপ্লবের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারবে।
তবুও, Robi Axiata Ltd. প্রমাণ করেছে যে তারা শুধু ব্যবসা করতে আসেনি, তারা এসেছে পরিবর্তন আনতে। প্রযুক্তিকে গণমানুষের নাগালে নিয়ে যেতে, তরুণদের সুযোগ তৈরি করে দিতে, এবং বাংলাদেশের ডিজিটাল স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে।
আপনাদের মতে বাংলদেশে IT sector এর ভবিষ্যত কি হতে যাচ্ছে তা কমেন্ট বক্সে এ অবশ্যই জানাবেন। ব্লগটি পড়ে ভালো লেগে থাকলে আমাদের ওয়েবসাইটে ই-মেইল subscribe করে পাশেই থাকুন, ধন্যবাদ, আসসালামু আলাইকুম।