দেশের অর্থনীতির মাস্টারপ্ল্যান ? কিভাবে দখলে নিল দেশের বাজার? | Abdul Monem Ltd | Business Mania
বাংলাদেশের শিল্প জগতে একটি পরিচিত নাম, AML Group BD। Igloo-এর মিষ্টি স্বাদ থেকে শুরু করে নির্মাণ, অবকাঠামো, বেভারেজ, প্রতিটি খাতে AML Group BD রেখেছে অগ্রগতির ছাপ।
Business Mania r আজকের ব্লগটিতে আমরা জানব AML Group BD-এর সাফল্য, অগ্রগতি, উত্থান এর গল্প, কিভাবে তারা হয়ে উঠে বাংলদেশের অন্যতম শক্তিশালী কর্পোরেট সাম্রাজ্যে। ১৯৫৬ সাল। পূর্ব-পাকিস্তানের একটি অস্থির সময়। ঠিক তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় Abdul Monem Ltd. (AML), একটি ছোট সড়ক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। শুরুটা ছিল খুব সীমিত পরিসরে, ছোটখাটো সাব-কন্ট্রাক্টের কাজ করে। কিন্তু সেই ছোট প্রতিষ্ঠানটাই ধীরে ধীরে দেশের অন্যতম বড় মাল্টি-সেক্টর কোম্পানিতে পরিণত হয়।
প্রথমদিকে AML শুধু অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করত, সড়ক, ব্রিজ ইত্যাদি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানিটি নতুন সেক্টরে প্রবেশ করে। এই প্রবেশটা র্যান্ডম ছিল না, বরং অনেক চিন্তাভাবনার ফল। তখন বাংলাদেশে ভাল মানের আইসক্রিম ছিল না বললেই চলে। আর এখানেই তারা নেয় এক সাহসী সিদ্ধান্ত।
১৯৬৪ সালে, AML শুরু করে Igloo আইসক্রিমের উৎপাদন। একটা নির্মাণ কোম্পানি হঠাৎ করে আইসক্রিম বানাচ্ছে, শুনতে তখন অদ্ভুত লাগলেও, এটা ছিল দেশের আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় মোড় ঘোরানো ঘটনা। আজ Igloo দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় আইসক্রিম ব্র্যান্ডগুলোর একটি।
এরপর আসে আরেকটা বড় পদক্ষেপ। ১৯৮২ সালে, AML অধিগ্রহণ করে Coca-Cola’র বাংলাদেশ ইউনিট, কোকা-কোলা, ফ্যান্টা, স্প্রাইটের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের বটলিং ও ডিস্ট্রিবিউশন শুরু করে তারা। এর মাধ্যমে দেশের বেভারেজ মার্কেটেও AML শক্তভাবে জায়গা করে নেয়।
এরপরের দশকে AML ধীরে ধীরে আরও কয়েকটি খাতে প্রবেশ করে। ১৯৯৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে তারা গড়ে তোলে AM Securities & Finance, AM Energy, AM Auto Bricks, যার মাধ্যমে ফাইন্যান্স, এনার্জি এবং কনস্ট্রাকশন মেটেরিয়াল খাতে নিজেদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করে।
২০০৪ সালের পর, তারা আবারও ফুড সেক্টরে র্যাম্প আপ করে। Igloo Foods, Igloo Dairy, Danish Bangla Emulsion এর মতো প্রতিষ্ঠান চালু হয়। প্রতিটি সাবসিডিয়ারি ছিল স্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কোম্পানির অবস্থান কে আরো শক্ত ও প্রভাবশালী করার উদ্দেশ্যে। এবার প্রশ্ন আসে, এই বিশাল প্রতিষ্ঠানটার পেছনে ছিলেন কে? এই বিশাল প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিলেন আব্দুল মোনেম। আবদুল মোনেম, একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, জন্ম ১৯৩৪ সালে, কুমিল্লার এক সাধারণ পরিবারে। শৈশব পার করেছেন সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে তিনি কিছু সময় চাকরি করেন, এরপর নিজের কিছু টাকা জোগাড় করে শুরু করেন ছোট একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পুঁজি ছিল মাত্র ২০,০০০ টাকা।
কিন্তু সেই ছোট পুঁজিতেই তিনি গড়ে তোলেন AML। প্রথমদিকে নিজেই সাইটে গিয়ে কাজ করতেন, ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে টেকনিক্যাল তত্ত্বাবধানও করতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার কাজের মান আর দক্ষতা তাকে সরকারি এবং বেসরকারি বড় বড় প্রকল্পে জায়গা করে দেয়। তার ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তগুলো সব সময়ই ছিল সময়োপযোগী এবং বাস্তবভিত্তিক, ব্যবসার নতুন খাত গুলোতে ঢোকার সময় ঝুঁকি ছিল, কিন্তু তার Execution ছিল শক্ত।
২০২০ সালে, ৮৬ বছর বয়সে আবদুল মোনেম মারা যান। তবে তিনি রেখে যান Igloo, Coca-Cola বাংলাদেশ ইউনিট, Igloo Foods, AM Securities, AM Beverage, Auto Bricks-এর মতো বড় বড় ব্র্যান্ড, যেগুলো এখনো তার প্রতিষ্ঠানের মূল চালিকাশক্তি হয়ে আছে। তাঁর মৃত্যুর পর কোম্পানির পরিচালনায় বড় ছেলে এ.এস.এম. মাইনুদ্দিন মোনেম এবং ছোট ছেলে এ.এস.এম. মহিউদ্দিন মোনেম দায়িত্ব নেন,তাঁরা কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন।
বর্তমানে Abdul Monem Ltd. দেশের অবকাঠামো খাতে সবচেয়ে অ্যাকটিভ কোম্পানিগুলোর একটি। তারা কাজ করেছে পদ্মা সেতুর অ্যাপ্রোচ রোড, ঢাকা ও সিলেট বিমানবন্দরের রানওয়ে, ঢাকা মেট্রোরেলের অংশ, আর নারায়ণগঞ্জের ৬-লেন মধুমতি সেতুর মতো বড় প্রকল্পে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, দেশে হওয়া বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর প্রায় ৪০ শতাংশেই তারা কোনো না কোনোভাবে যুক্ত।
এখন AML-এর অধীনে আছে ১২টি কোম্পানি, যেখানে সরাসরি কাজ করে প্রায় ৬,০০০ জন। বাইরের ইউনিট আর সাব-কন্ট্রাক্টর ধরলে এই সংখ্যা ১০,০০০-এর ওপরে যায়। তাদের বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা। আর আগামী পাঁচ বছরে সেটা ১০,০০০ কোটিতে নেওয়ার টার্গেট আছে। এজন্য তারা অ্যাগ্রো প্রসেসিং আর বড় কনস্ট্রাকশন প্রজেক্টে ইনভেস্টমেন্ট বাড়াচ্ছে।
যদিও আবদুল মোনেম লিমিটেড দেশের বড় একটি শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে, সবকিছুই শুধুমাত্র সাফল্যের গল্প না। এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে বিতর্ক আর সমালোচনাও রয়েছে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ের একটি বড় আর্থিক অভিযোগ।
২০২৩ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গ্রুপটির বিরুদ্ধে বড় আকারের শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ তোলে। তদন্ত অনুযায়ী, আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি অতিরিক্ত পরিমাণে তথা ৫,২৫,০০০ টন কাঁচা চিনি আমদানি করে, কিন্তু সেই অনুযায়ী শুল্ক প্রদান করেনি। মোট ফাঁকিকৃত শুল্কের পরিমাণ ছিল প্রায় ১২০৫ কোটি টাকা। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিছু অংশ কিস্তিতে পরিশোধ করা হয়, তবে এখনও প্রায় ৬৭৪ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে, যা মওকুফের আওতায় রয়েছে।
এর ফলে রাজস্ব বোর্ড গ্রুপটির আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থগিত করে এবং গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের, যেমন ইগলু ডেইরি, ইগলু আইসক্রিম, এএম বেভারেজ, এএমএল কনস্ট্রাকশন শিপমেন্ট আটকে দেয়। এতে প্রতিষ্ঠানটির উপর আস্থা ও ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই ইস্যুর বাইরে আরও কিছু সমালোচনাও আছে। বড় সরকারি প্রকল্পগুলোতে সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারা, কিংবা ব্যবস্থাপনার জটিলতাও একেক সময় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যদিও তারা সবসময়ই বড় প্রজেক্টে যুক্ত থেকেছে, বাস্তবতায় অনেক সময় সময়সীমা ও বাজেট ঠিক রাখা যায়নি।
আবদুল মোনেম লিমিটেড (AML)-এর গল্পটা যেন এক রোডম্যাপ, যেখানে দেখা যায় কিভাবে কম পুঁজি দিয়ে শুরু করে একটা কোম্পানি ধীরে ধীরে দেশের অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত হতে পারে। এই গল্পে রয়েছে পরিশ্রম, কৌশল, এবং সুযোগ কাজে লাগানোর কথা, আবার পাশাপাশি রয়েছে জটিলতা, বিতর্ক এবং কঠিন প্রশ্নও।
বাংলাদেশে ব্যবসা করা মানেই সোজা রাস্তা নয়, বিশেষ করে যখন আপনি কনস্ট্রাকশন, আমদানি-রপ্তানি এবং ভোক্তাপণ্য, এই ধরনের বিভিন্ন সেক্টরে একসাথে কাজ করছেন। AML তার ভেতরের চ্যালেঞ্জ, শক্তি, এবং গঠন সবকিছুই একসাথে তুলে ধরে। প্রতিষ্ঠানটি এখন নতুন খাতে বিনিয়োগ করছে, আবার পুরনো ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে চাইছে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর গল্প বুঝলে শুধু একটা কোম্পানির ওঠানামাই দেখা হয় না, বরং বাংলাদেশের ব্যবসা পরিবেশের বড় চিত্রও দেখা যায়। যদি ব্লগটি ভালো লেগে থাকে আমাদের ওয়েবসাইটে ই-মেইল সাবস্ক্রাইব করে পাশেই থাকবেন। কমেন্টে আপনার মতামত শেয়ার করতে ভুলবেন না।