হক গ্রুপ কি আর ফিরবে আগের অবস্থানে? | Crisis Inside Haque Group
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সেদিন সন্ধ্যায় হুট করে একজন ব্যাক্তি ফেইসবুক লাইভে এসে, তার নিজের বাংলাদেশের পাসপোর্টটি পুড়িয়ে দেন, শুধু তাই না নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন নেতা দাবী করে বলতে থাকেন,
“আওয়ামী লীগ আমার ১ হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়েছে। আমাকে দেশ ছাড়া করেছে। আমাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটানোর চেষ্টা করছে। যে কারণে আমি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করলাম। এ দেশের নাগরিকত্ব আর চাচ্ছি না। কারণ, এদেশের নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই।”
মুহুর্তের মাঝে সেই ঘটনার ভিডিও চারিদিকে ছড়িয়ে পরে, ভাইরাল হয়। শুরু হয় নানা রকম বিতর্ক। বিতর্কিত এই ব্যাক্তির নাম আদম তমিজী হক।
তার আরো একটি পরিচয় আছে। তিনি হক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
হক গ্রুপ। বাংলাদেশে যেসব ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান দেশের একদম শুরু থেকেই, দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখে আসছে হক গ্রুপ তাদের সবার মধ্যে এগিয়ে।
প্রিয় পাঠক আজকের ব্লগটিতে আমরা জানবো এই হক গ্রুপের ব্যাপারে সেই সাথে আদম তমিজী হককে নিয়ে যেই বিতর্কিত কর্মকান্ডগুলো হয়েছে সেদিকেও নজর রাখবো। তাহলে চলুন ব্লগটি শুরু করা যাক।
হক গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্টিজ এর প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৭ সালে। সে সময় বাংলাদেশে তেল চালিত বাতি কিংবা কেরোসিন চালিত বাতির বিকল্প হিসেবে, ব্যাটারি চালিত ফ্ল্যাশ লাইট ও রেডিও এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
এ সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে] প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগতা তমিজুল হক ব্রিটিশ বিস্কুট প্রস্ততকারক হান্টলি অ্যান্ড পামার্স এবং ব্যাটারি প্রস্ততকারক ইউনিয়ন কার্বাইডের ডিস্ট্রিবিউটর হিসাবে যাত্রা শুরু করেন।
পরে ১৯৫২ সালের দিকে হক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ নামে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কর্মকাণ্ড শুরু করে।
বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বেশ কিছু জনপ্রিয় পন্য প্রস্তুত করে থাকে হক গ্রুপ। এর মধ্যে
কেক ক্যাটাগরি:
Dry Cake, Mr. Puff, Mr. Toast
চকলেট ক্যাটাগরি:
Choco Mania, Chocolate Filled Cookies, Mr. Candy, Mr. Jelly, Jelly Cups, Minty Fresh, Chocolate Bar
বিস্কুট ক্যাটাগরি:
Mr. Cookie, Nutty Bites, Milk Marie, Digestive Biscuits, Energy Plus, Lovely, Crème Treat, Wafers, Salted Crackers, Nankhatai, Tea Time Biscuits
নুডলস ক্যাটাগরি:
Mr. Noodles, Fun Noodles, Instant Cup Noodles
স্ন্যাকস ও চিপস ক্যাটাগরি:
Mr. Chips, Hoque Chanachur, Mr. Corn, Mr. Pop
জুস ও ড্রিংকস ক্যাটাগরি:
Hoque Mango Drink, Hoque Orange Drink, Hoque Lychee Drink, Hoque Apple Juice, UHT Milk
ব্যাটারি ক্যাটাগরি:
Hoque বাত্তের্য
এগুলো বেশ জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী হক গ্রুপের অধীনে ৮৪টি পণ্য, ৫০টি ব্র্যান্ড ও ২টি কারখানা আছে।২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির ৫০ হাজারের বেশি মানবসম্পদ কর্মরত আছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হলো
হক ফুড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। ঢাকার তেজগাঁওতে ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে হক ফুড-এর প্রথম কারখানা স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি ক্রিম ক্র্যাকার্স, বারবন, সুগার গ্লেজড বিস্কুট, ওভেন ফ্রেশ কুকিজ, চকলেট ফিলড চিপস সহ বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট পণ্য উৎপাদন করে থাকে এর মধ্যে ‘মিঃ কুকি’ সবচেয়ে জনপ্রিয়।
হক এন্ড কোং লিমিটেড। হক অ্যান্ড কোং লিমিটেড মূলত একটা সাবান উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৮ সালের জুলাই মাস হতে ঢাকার টঙ্গীতে প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন শুরু করে। পুরুষের জন্য ‘ম্যান সোল’ নামের সাবান প্রস্তুতের মাধ্যমে এর উৎপাদন শুরু হয়। তাছাড়াও কারখানাটি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ডেটল, স্যাভলন, কিউট ও সন্তুরের মতো জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের সাবান তৈরীতেও সাহায্য করে থাকে।
হক এন্ড কোম্পানি (ড্রাই সেল) লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত ব্যাটারি বা ড্রাই সেল তৈরী করে থাকে। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে টঙ্গীতে চালু হয় এটি। এই প্রতিষ্ঠানটি ইউএম৩ ব্যাটারি (ডবল এ বা পেনসিল ব্যাটারি), ইউএম৪ (ট্রিপল এ বা রিমোট ব্যাটারি) এবং মেটাল জ্যাকেট ইউএম১ হেভি-ডিউটি ব্যাটারি তৈরি করে। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে, টঙ্গীতে কার্বাইড কারখানা হক কার্বাইড প্রতিষ্ঠিত হয়। হক ৭৮৬ ব্যাটারি এই প্রতিষ্ঠানের একটি প্রচলিত ব্রান্ড।
হক রিক্রিয়েশনাল প্রডাক্ট লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের আরেকটি প্রতিষ্ঠান জুনু বিচ রিসোর্টের এর জন্য বিভিন্ন বিনোদনমূলক পণ্য আমদানিকারক হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি খেলার সরঞ্জাম, যানবাহন এবং অন্যান্য বিনোদন সরঞ্জাম আমদানি, বিক্রয়, ভাড়া এবং সেবা সরবরাহ করে। এর কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে বিলাসবহুল ইয়ট, জেটস্কি, ক্যাটামারান, ওয়েকবোর্ডিং ইত্যাদি।
এছাড়াও ওয়ার্ল্ড ট্যুর এজেন্সি নামে আরেকটি ট্রাভেল এজেন্সি ও রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটির।
বর্তমান বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৪০টি দেশে হক গ্রুপ তাদের পন্য রপ্তানি করে থাকে। এগুলোর মধ্যে,মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE), ওমান, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন; আফ্রিকার নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া; দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া; ইউরোপের যুক্তরাজ্য, ইতালি, জার্মানি; উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া।
এই দেশগুলোতে হক গ্রুপের যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি, তার মধ্যে রয়েছে বিস্কুট (বিশেষ করে Mr. Cookie, Glucose, Bonoful), চিপস ও চানাচুর, ড্রাই সেল ব্যাটারি, সাবান ও ডিটারজেন্ট, এবং কিছু মিষ্টান্ন পণ্য যেমন দই ও ঘি—যেগুলোর মূল ক্রেতা হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
প্রিয় পাঠক একসময়কার বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বিস্কুটের নাম হয়ে ওঠা হক গ্রুপ আজ এক জটিল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি তার প্রোডাক্ট কোয়ালিটির মাধ্যমে বাজারে এখনো একটি অবস্থান ধরে রেখেছে, কিন্তু নেতৃত্বের সংকট ও বিতর্ক—তাদের সামগ্রিক ইমেজে ধাক্কা খেয়েছে। আর এর শুরুটা হয় ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ এর আদম তমিজীর পাসপোর্ট পুড়ানোর পর থেকে।
আদম তমিজীর কাজটা সেসময় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অপ্রত্যাশিত আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ ই ঘটনার পরদিনই আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা জরুরি সভায় বসে এবং ১৭ সেপ্টেম্বর তাকে দল থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করে। ১৮ সেপ্টেম্বর এ সুপারিশ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নিকট পাঠানো হয়।
এরপর কিছুদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও, ১৩ নভেম্বর তিনি যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে আসলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর ১৬ নভেম্বর রাতে র্যাব-১ গুলশানের তার বাসভবনে অভিযান চালায়। সে সময় আদম তমিজী হক নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে চিৎকার করেন, ছুরি হাতে নেন এবং আত্মহত্যার হুমকি দেন বলে দাবি করা হয়। তিনি এমনকি জানালার কাচ ভেঙে নিচে লাফ দেওয়ার চেষ্টাও করেন বলে অভিযানের সময়কার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।তাই তাকে সেসময় গ্রেফতার না করলেও, পুলিশ পাহারা তার বাড়ির চারপাশে বসানো হয়।
পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়, যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি, মানহানিকর বক্তব্য এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়।
পরবর্তীতে ৯ ডিসেম্বর ডিবি পুলিশ তাকে গুলশানের একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে এবং ১০ ডিসেম্বর তাকে মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য একটি রিহ্যাব সেন্টারে পাঠানো হয়। চিকিৎসকদের মতে, তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, তিনি সেই সময় স্ত্রী ও কয়েকজন কর্মচারীর তত্ত্বাবধানে ছিলেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। যদিও তিনি কয়েকটি গণমাধ্যমে দাবি করেন, তার ব্যক্তিগত ডকুমেন্ট, মোবাইল ফোন এবং গাড়ির কাগজসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হারিয়ে গেছে।
এই ঘটনার মধ্যেই ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। তবে বিতর্ক থেমে থাকেনি।
পরবর্তীতে কে বি সি এগ্রো প্রডাক্ট এর করা চেক জালিয়াতি মামলার রায় দেওয়া হয় ২০২৪ সালের ২৩ মে। সেখানে আদম তমিজী হক এর হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে প্রায় ১৯ লাখ ৪৫ হাজার দুটি চেক জালিয়াতির অভিযোগ ছিল। এবং এই ঘটনায় টাংগাইল আদালত আদম তমিজীর নামে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করে।
তবে আদম তমিজীর ভাষ্যমতে, এসবই পরিকল্পিত। তাদের প্রতিষ্ঠানটি শেষ করে দেওয়ার জন্য এসব পরিকল্পনা করে করা হচ্ছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী তার চাচা মতিউর রহমান মতি ও সে সময়কার যুব ও ক্রিয়া প্রতি মন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল হক গ্রুপ থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে, যেকারণে হক গ্রুপ আজ প্রায় ধ্বংসের পথে।
প্রিয় পাঠক তবে এত কিছুর পর ও হক গ্রুপ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কোম্পানির বাকি শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের আরো দুটি নতুন পন্য লাইনআপ এ আছে। এছাড়াও আরো কিছু প্রজেক্ট চলমান আছে।
হক গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজকে নিয়ে আমাদের ব্লগ এই অব্দি।এই ব্লগটি ভালো লাগলে লাইক কমেন্ট করতে ভুলবেন না। এরকম ব্লগ আরো পড়তে চাইলে আমাদের ওয়েবসাইটে ই-মেইল সাবস্ক্রাইব করুন।