সোয়ান গ্রুপ: ফোম ইন্ডাস্ট্রির বিতর্ক আর লুকানো ক্ষমতা ! | Swan Group
বাংলাদেশে প্রতিদিন নতুন নতুন কোম্পানি আসে, কেউ টিকে থাকে, কেউ হারিয়ে যায়। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা চুপচাপ, আলোচনার বাইরে থেকেই গড়ে তোলে একটা বিশাল সাম্রাজ্য। Swan Group ঠিক তেমনই একটা নাম।
বাংলাদেশে ফোম ও ম্যাট্রেস শিল্পের বিকাশ গত কয়েক দশকে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। শহরায়ণ, হাউজিং সেক্টরের বিস্তার এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সাথে সাথে এই খাতে পণ্যের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই শিল্পে বর্তমানে শতাধিক কোম্পানি সক্রিয়, যাদের মধ্যে আকতার ফার্নিচার, ইউরো এশিয়া, অ্যাপেক্স, বেঙ্গল এবং সোয়ান গ্রুপের নাম পাওয়া যায়।
তবে এই বাজারে প্রতিযোগিতা দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে, এবং অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধতা অনুভব করছে। তাই Swan group এর সার্বিক আলোচনে নিয়ে থাকছে Business Maniar আজকের ব্লগটি।
সোয়ান গ্রুপের শুরু ১৯৮৪ সালে, যখন খবির উদ্দিন খান ট্রেডিং ব্যবসার মাধ্যমে বাণিজ্যিক দুনিয়ায় প্রবেশ করেন। শুরুতে তিনি পলিউরেথেন ফোমের কাঁচামাল আমদানি ও বাজারজাত করতেন। তখন থেকেই তিনি স্থানীয় বাজারের চাহিদা বিশ্লেষণ করতে থাকেন। ফোমের ব্যবহার বাড়তে থাকে, বিশেষ করে আসবাবপত্র, নির্মাণ ও অন্যান্য শিল্প খাতে। এই চাহিদার ওপর ভিত্তি করে তিনি নিজস্ব ব্র্যান্ড SWAN-এর অধীনে ফোম উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেন। ধাপে ধাপে ব্যবসা প্রসারিত হয়ে সোয়ান গ্রুপ নামক একটি গ্রুপ অব কোম্পানিজে রূপান্তরিত হয়।
বর্তমানে সোয়ান গ্রুপের অধীনে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত প্রতিষ্ঠান হলো সোয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এটি মূলত ফোম ও ম্যাট্রেস প্রস্তুত করে এবং দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করে। সোয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বাংলাদেশের একটি বহুমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান, যা পলিউরেথেন ফোম, ম্যাট্রেস, কেমিক্যাল, হোমটেক্সটাইল, রিয়েল এস্টেট এবং ট্রেডিং খাতে কাজ করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের শতাধিক শোরুম ও হাজারেরও বেশি খুচরা বিক্রেতা রয়েছে।
এইদিকে সোয়ান কেমিক্যালস লিমিটেড সোয়ান গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। সোয়ান কেমিক্যালস বিশেষভাবে সিনথেটিক রাবার অ্যাডহেসিভ, ইউপিআর রেজিন এবং বিভিন্ন শিল্পপ্রয়োগযোগ্য কেমিক্যাল তৈরি করে। সোয়ান গ্রুপ এর আরেকটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সোয়ান প্রপার্টিজ লিমিটেড, রিয়েল এস্টেট খাতে কাজ করে। তারা আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রকল্পে কাজ করছে, তবে এ খাতে তাদের দৃশ্যমান উপস্থিতি অন্যান্য বড় রিয়েল এস্টেট কোম্পানির তুলনায় সীমিত। এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত, তবে এখানেও প্রতিযোগিতা অত্যন্ত বেশি।
পাশাপাশি, সোয়ান ট্রেডার্স এবং সোয়ান অ্যাসোসিয়েটস মূলত ট্রেডিং ও সাপ্লাই চেইন পরিচালনার কাজে যুক্ত। এদের ভূমিকা হলো সোয়ান গ্রুপের বিভিন্ন পণ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া। যদিও তারা B2B গ্রাহকদের নিয়ে বেশি কাজ করে, কিন্তু সরাসরি গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ বা খুচরা বাজারে তাদের সরাসরি উপস্থিতি এখনো তুলনামূলকভাবে কম।
সোয়ান গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন খবির উদ্দিন খান, যিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। তার নেতৃত্বে কোম্পানিটি পারিবারিক কাঠামোয় পরিচালিত হচ্ছে। মিসেস রোকসানা খান, তারিন খান ও তানজির খান পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে যুক্ত আছেন। এই পারিবারিক কাঠামো একদিকে যেমন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে, অন্যদিকে একটি প্রতিষ্ঠানের পেশাদার ব্যবস্থাপনার অভাবও তৈরি করতে পারে। এখন পর্যন্ত সোয়ান গ্রুপ বাইরের ইনভেস্টর বা কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট কালচারের সাথে তেমনভাবে সম্পৃক্ত হয়নি, যা ভবিষ্যতের সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।
সোয়ান গ্রুপের উৎপাদন প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি ও মান নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। তারা ফোম কাটিং, ব্লেন্ডিং ও মান পরীক্ষার জন্য আধুনিক মেশিন ব্যবহার করে।। অন্যান্য প্রতিযোগীদের মধ্যে উল্লেখোগ্য: কমফি, ইউরোএশিয়া, আকতার ইত্যাদি। এই শিল্পে বর্তমানে শতাধিক কোম্পানি সক্রিয়, এবং এই সংখ্যাটি দিনে দিনে বাড়ছে। বার্ষিক বাজার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকার কাছাকাছি এবং এটি প্রতি বছর ১০% থেকে ২৫% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফোম ও ম্যাট্রেস এখন শুধু আসবাবেই নয়, বরং গাড়ি, রেফ্রিজারেটর, প্যাকেজিং ও জুতা শিল্পেও ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সোয়ান গ্রুপ এখনো প্রবেশ করেনি, কিংবা করলেও তা অতি সীমিত পরিসরে। রপ্তানির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, এ বিষয়ে তাদের কোন প্রকাশ্য উদ্যোগ বা পরিকল্পনা চোখে পড়ে না। প্রযুক্তি, মান নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক মান অনুসরণের ক্ষেত্রে আরও উন্নতি ঘটাতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের শংসাপত্র, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমে তারা বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ করতে পারে।
Swan গ্রুপের আন্তর্জাতিক সংযোগের দিক থেকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হচ্ছে Swan International (Pvt.) Ltd তারা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড যেমন Maxxis, CST এবং Presa টায়ারের একমাত্র পরিবেশক হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করে। ১৯৯৬ সাল থেকে তারা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ টায়ার নির্মাতা Cheng Shin Rubber কোম্পানির সাথে অংশীদারিত্বে রয়েছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সোয়ান গ্রুপ একটি স্থিতিশীল ও সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান। তারা নিজেদের সুনির্দিষ্ট কিছু খাতে রেখে কাজ করছে, তবে আরও বিস্তৃত পরিকল্পনা এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন হবে প্রযুক্তিনির্ভরতা, বৈচিত্র্য, পেশাদার ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক মানের ব্র্যান্ডিং।
সোয়ান গ্রুপের দীর্ঘ যাত্রা কেবল সাফল্য বা সম্প্রসারণেই সীমাবদ্ধ নয়; তাদের ইতিহাসে কিছু বিতর্কও স্থান করে নিয়েছে, যেগুলো প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তিকে কিছুটা হলেও আঘাত করেছে। শুরুটা ছিল ২০১৫ সালে, যখন সোয়ান গার্মেন্টসের শ্রমিকরা হঠাৎ রাস্তায় নেমে আসে। দাবি :- তাদের বকেয়া বেতন ও ঈদের উৎসব ভাতা দীর্ঘদিন ধরে পরিশোধ করা হয়নি। শ্রমিকরা মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে বসে যায়, এবং বিষয়টি দেশের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে ওঠে। ঠিক সেই সময়, আন্তর্জাতিকভাবে আরেকটি খবর ছড়িয়ে পড়ে, জার্মানির জনপ্রিয় খুচরা বিক্রেতা ALDI-এর সরবরাহকারীদের একজন হিসেবে সোয়ান গ্রুপের নাম উঠে আসে, যেখানে অভিযোগ ছিল শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি পরিশোধে ব্যর্থতা। এতে শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও প্রতিষ্ঠানটি সমালোচিত হয়।
এর কয়েক বছর পর, ২০২২ সালে সোয়ান গ্রুপ আরেকটি বড় বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তাদের তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে মামলা করে। বলা হয়, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৩৬ কোটি টাকার বিক্রয় তারা গোপন রেখেছে, যার ফলে প্রায় ৩৭ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব হয়নি। এই ঘটনাগুলো সোয়ান গ্রুপের জন্য এক ধরনের শিক্ষা হিসেবেই এসেছে বলা যায়। তারা একদিকে যেমন দেশীয় শিল্পে অবদান রেখে আসছে, অন্যদিকে এই বিতর্কগুলো তাদেরকে আরও দায়িত্বশীল ও স্বচ্ছ পরিচালনার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। বাস্তবতা হলো, যে কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের পথচলায় চ্যালেঞ্জ আসেই, সোয়ান গ্রুপ কীভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করে এবং ভবিষ্যতে কীভাবে আস্থা ফিরিয়ে আনে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এই ছিল সোয়ান গ্রুপের গল্প, একটি প্রতিষ্ঠানের চার দশকের উত্তরণ, সাফল্য, চ্যালেঞ্জ, এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার খুঁটিনাটি আপনি কী মনে করেন, সোয়ান গ্রুপ আগামী দিনে নিজেদের আরও আধুনিক, স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগী করে তুলতে পারবে? আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না কমেন্ট সেকশনে। ব্লগটি আপনাদের ভালো লেগে থাকলে, বিজনেস দুনিয়ার এমন সব খবরাখবর পেতে আমাদের Business Mania সাইটে ই-মেইল Subscribe করতে ভুলবেন না।