ওয়ালটন এখন বিশ্বজয়ী ব্র্যান্ড! | WALTON GROUP | Business Mania
বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন দিনকে দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তখন একটি নাম বারবার উঠে আসে ওয়ালটন (Walton)। একটি স্থানীয় কোম্পানি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের জায়গা করে নেওয়ার গল্প, ওয়ালটনের। ইলেকট্রনিকস থেকে শুরু করে অটোমোবাইল(Automobile), এবং গৃহস্থালীর পণ্য, ওয়ালটন আজ প্রায় সবক্ষেত্রে এক পরিচিত নাম।
এত বড় একটি কোম্পানি হয়ে ওঠার পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে? কেমন তাদের গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্র, যা বিশ্বমানের বলে দাবি করা হয়? কীভাবে ৩০ হাজারের বেশি কর্মী এবং ৭০০ একরের বিশাল উৎপাদন এলাকা নিয়ে তারা বছরের পর বছর ধরে কোটি কোটি ইউনিট পণ্য উৎপাদন করে চলেছে?
কিন্তু প্রশ্ন এখানেই শেষ নয়। ওয়ালটন কি সত্যিই বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে পারবে? তাদের পণ্যের মান এবং উদ্ভাবনের ক্ষমতা কি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য যথেষ্ট? আর তাদের এই সাফল্যের আড়ালে রয়েছে কি কোনো সমালোচনা, নাকি এটি শুধুই এক অনুপ্রেরণার গল্প?
আজকের আলোচনায় আমরা জানবো ওয়ালটনের উত্থান, বর্তমান অবস্থা, এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তাদের এই যাত্রা আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা জানার চেষ্টা করবো। প্রস্তুত তো? চলুন শুরু করা যাক।
ওয়ালটনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে। প্রতিষ্ঠাতা এস.এম. নজরুল ইসলাম তখন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর, তিনি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করেন। সেই থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ওয়ালটন। কোম্পানিটির শুরু হয় Rezvi & Brothers নামে, যা এস.এম. নজরুল ইসলামের বড় ছেলের নামে নামকরণ করা হয়। ২০০৮ সালে, Rezvi & Brothers নতুন নামে Walton Group হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং দেশেই রেফ্রিজারেটর তৈরি শুরু করে।
ওয়ালটন শুধুমাত্র পণ্য উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তাদের লক্ষ্য ছিল পুরো ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করা ও সম্ভাব্য বিপ্লব ঘটানো । খুব দ্রুতই তারা ফ্রিজ (Fridge), ফ্রিজার (Freezer), এয়ার কন্ডিশনার (Air Conditioner) এবং টেলিভিশনের (Television) মতো পণ্যের উৎপাদন শুরু করে। এর পাশাপাশি শুরু হয় কম্প্রেসর (Compressor) তৈরির মতো আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর পণ্য উৎপাদন। এক যুগের মধ্যে, ওয়ালটন ও তাদের সহযোগী ব্র্যান্ড মার্সেল হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত নাম।
২০০৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে, ওয়ালটনের অগ্রগতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০১৭ সালে, তারা দেশের প্রথম কম্প্রেসর কারখানা স্থাপন করে । একই বছর ওয়ালটন প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যু হলে, তার বড় ছেলে এস.এম. নুরুল আলম রেজভী কোম্পানির নেতৃত্বে আসেন। তার নেতৃত্বে, ওয়ালটন শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে থাকে।
২০১৮ সালে, ওয়ালটন কম্পিউটার অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট চালু করে এবং একই সময়ে নাইজেরিয়ায় ল্যাপটপ রপ্তানি শুরু করে। পরবর্তী সময়ে, তারা ইউরোপের ১৪টি দেশে টেলিভিশন রপ্তানি শুরু করে তারা। এমনকি, ২০২০ সালে আমেরিকার একটি ব্র্যান্ডের জন্য হ্যান্ডসেট তৈরির মাধ্যমে ওয়ালটন বাংলাদেশের Original Equipment Manufacturer হিসেবে নতুন মাইলফলক স্থাপন করে।
২০২২ সালে, ওয়ালটন ইউরোপীয় তিনটি ব্র্যান্ড অধিগ্রহণ করে কম্প্রেসর উৎপাদনে বৈশ্বিক পরিসরে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। সেই বছরের জুনে, দক্ষিণ কোরিয়ায় গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণার মাধ্যমে ওয়ালটন তাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য আরও সুস্পষ্ট করে তোলে।
ওয়ালটনের এই এগিয়ে যাওয়ার গল্প শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক শিল্পক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রমাণ বহন করে।
২০০৭ সালে গাজীপুরে নিজেদের কারখানা স্থাপন করে ওয়ালটনের শুরু। তখন ফ্রিজ, টিভি, এসি আর মোটরসাইকেল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল তারা। তবে শুধু তৈরি করাই নয়, বদলে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নামে এই ব্র্যান্ড।
এরপর দ্রুতই একের পর এক সাফল্যের গল্প। ২০১০ সালে মোবাইল ফোন বাজারে প্রবেশ করে ওয়ালটন, আর তার পরের বছরই এসি আর টিভি রপ্তানি শুরু।
তরুণ নেতৃত্ব আর উদ্ভাবনী পরিকল্পনায় ওয়ালটন শুধু দেশেই নয়, পৌঁছে যায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ২০১৭ সালে চালু হলো দেশের প্রথম কম্প্রেসর উৎপাদন ইউনিট, যা জার্মানির মতো আন্তর্জাতিক বাজারেও জায়গা করে নেয়।
আজ ৪০টিরও বেশি দেশে ওয়ালটনের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। দেশের ফ্রিজ, টিভি আর এসি বাজারের বড় একটা অংশ তাদের হাতে। ভবিষ্যতের লক্ষ্য? ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়া।
বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার ভোক্তা ইলেকট্রনিক্স খাতে, ওয়ালটন এখন ফ্রিজ বাজারের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড। দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া প্রতিটি ১০০টি ফ্রিজের মধ্যে মাত্র ৩টি আমদানি করা হয়, বাকিগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি যার বড় একটি অংশই ওয়ালটনের দখলে।
সুপারশপ থেকে শুরু করে স্থানীয় দোকান সব জায়গায়তেই ওয়ালটনের বেভারেজ ফ্রিজ চোখে পড়ে। শুধু দেশে নয়, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ ৪০টির বেশি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে তারা।
টিভি, স্মার্টফোন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজারেও ওয়ালটনের উল্লেখযোগ্য অবস্থান তো আছেই । আর প্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে আছে সিঙ্গার, মাই ওয়ান, সিম্ফনি, এবং যমুনা ইলেকট্রনিক্স। তবে সাশ্রয়ী মূল্য ও উচ্চমানের পণ্যের সমন্বয়ে ওয়ালটন ধরে রেখেছে তাদের শীর্ষস্থান।
ওয়ালটন বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স খাতে শীর্ষস্থানীয় অবস্থান ধরে রাখলেও প্রায় সকল বড় বড় কনগ্লোমারেট গুলোর মতোই তাদেরও কিছু কিছু অর্থনৈতিক ও নৈতিক চ্যালেঞ্জের হতে হয়েছে।
যেমন, ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কোম্পানির মুনাফা প্রায় ২৬% কমে ১৫০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এই পতনের প্রধান কারণ টাকার অবমূল্যায়ন এবং বৈদেশিক ঋণের উচ্চ সুদ। ওয়ালটনের ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার সাজেদুল কবিরের মতে, ডলার এবং ইউরোর বিনিময় হারের বৃদ্ধির কারণে কোম্পানিকে প্রায় ৪৫.৮৫ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
এছাড়া কোম্পানির মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩,২৮৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে প্রায় ২,৪০০ কোটি টাকা ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য। ঋণের সুদহার বেড়ে ১৪.৫% পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২% বেশি।
অন্যদিকে, ওয়ালটনের বিজ্ঞাপন এবং স্পন্সরশিপ নীতিমালা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। একটি নাটক “রূপান্তর” প্রচারের পর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠে। ওয়ালটন কর্তৃপক্ষ নাটকটির প্রযোজক এবং স্টুডিওর বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ জারি করে এবং সমস্ত বিজ্ঞাপন চুক্তি বাতিল করে। নাটকের লেখক নীহার আহমেদ দাবি করেন, নাটকে কোনও ধর্মীয় অবমাননার বিষয় ছিল না এবং এটি সম্পূর্ণভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ‘হারমাফ্রোডিটিজম’ বিষয়ক সামাজিক চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে।
ওয়ালটনের এই পদক্ষেপ এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তাদের গ্রাহক-কেন্দ্রিক ভাবমূর্তি নিয়ে নতুন আলোচনা তৈরি করেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
আপনার মতামত কী? ওয়ালটনের এই পরিস্থিতি তাদের ভবিষ্যৎকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে?
ওয়ালটনের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি ইলেকট্রনিক্স ব্র্যান্ডের মধ্যে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করা। এ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন, নতুন মডেলের পণ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরীক্ষাগার স্থাপনে বিনিয়োগ করছে। অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরবসহ আরও বহু দেশে রপ্তানি সম্প্রসারণের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করতে ওয়ালটন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
Business Maniar আজকের ভিডিওটি ভালো লেগে থাকলে ওয়ালটন কোম্পানিকে নিয়ে এই ডকুমেন্টারিটি শেয়ার করবেন এবং আপনার মূল্যবান মতামত অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানাবেন।