১৫০ বছর ধরে রাজত্ব করছে যে তেল কোম্পানী | The EVIL Business of ExxonMobil
শিল্প বিপ্লবের পর থেকে, জীবাশ্ম জ্বালানী হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য প্রধান শক্তির উৎস। জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে জড়িত কর্পোরেশন গুলো জীবাশ্ম জ্বালানি বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার ফলে পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু, বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। এ ধরনের কর্পোরেশন গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বৃহত্তম তেল ও গ্যাস কোম্পানি এক্সনমোবিল ।
এক্সনমোবিল কর্পোরেশনের কাজ কি? কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? আর এর খারাপ দিকগুলোই বা কি? সেই সবকিছু নিয়ে আলোচনা হবে বিজনেস ম্যানিয়ার আজকের ব্লগটিতে।
এক্সনমোবিল হলো আমেরিকার একটি বহুজাতিক তেল ও গ্যাস কর্পোরেশন যা তেল ও গ্যাস শক্তি সেক্টরে কাজ করে। যার বাৎসরিক আয় প্রায় ৪১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। হিসেব মতে, মার্কিন কোম্পানিটি প্রতি ঘণ্টায় ৬৩ মিলিয়ন ডলার ঘরে তোলে। এই কোম্পানি আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া পেসিফিক, মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হতে তেল ও গ্যাস উত্তোলন, পরিশোধন এবং বিক্রি করে। ১৯৯৯ সালে লি রেমন্ড এবং লু নোটো ( Lee Raymond and Lou Noto) এই কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এক্সন মোবিল বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম তেল ও গ্যাস কোম্পানি। যার সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের একটি উপশহর স্প্রিং, টেক্সাসে অবস্থিত।
বর্তমানে এক্সনমোবিল রাজস্ব এবং বাজার মূলধন দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রে বৃহত্তম বিনিয়োগকারী মালিকানাধীন তেল এবং গ্যাস কোম্পানি। আপাত দৃষ্টিতে এই কোম্পানি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের ইতিহাস। আজকের সফল এক্সনমোবিল ছিলো এক্সন এবং মোবিল নামের সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন কর্পোরেশন। যার যাত্রা শুরু হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীতে। আবিষ্কারের পর হতেই সবসময় তেল ছিল একটি বিতর্কিত সম্পদ। তেল উত্তোলনে অনেক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এটির অপার সম্ভাবনা মানুষকে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর এসব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন জন ডেভিসন রকফেলার (John Davison Rockefeller)। তেল উত্তোলন শিল্পে তার অবদানের জন্য তাকে কিং অফ অয়েল ও বলা হয়। তিনিই প্রথম আমেরিকার অর্থনীতি দাঁড় করানো এবং শিল্প বিপ্লবে খনিজ সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য ১৮৬৬ সালে ভ্যাকিউম ওয়েল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন ।
পরবর্তিতে ১৮৭৯ সালে জন. ডেভিসন. রকফেলার এই কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করে স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল কোম্পানি রাখেন। ১৯১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট এর আদেশে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল, ৩৪ টি ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানিতে বিভক্ত হয়। অধিভুক্ত কোম্পানিগুলির মধ্যে দুটি বৃহত্তর কোম্পানি ছিলো। যার একটি নিউ জার্সির স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি, যা জার্সি স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানি নামে পরিচিত এবং অন্যটি নিউ ইয়র্কের স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি যা সোকোনি (Socony) নামে পরিচিত ছিলো।
১৯৫৫ সোকোনি, সোকোনি মোবিল হিসেবে রেজিস্ট্রার করে। এবং ১৯৬০ সোকোনি মোবিল শুধু মাত্র মোবিল ওয়েল হিসেবে পরিচিতি পায়। অন্যদিকে জার্সি স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানি ১৯৭২ সালে এক্সন অয়েল নামে পরিচিতি পায়। এরপর ১৯৯৮ সালে দুটি কোম্পানি একীভূত করার জন্য ৭৩.৭ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর, দুই কোম্পানির একত্রীকরণ সম্পন্ন হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে, এক্সনই মোবিলকে অধিগ্রহণ করেছিল। যৌথ এই কোম্পানির দুটি একীভূত হওয়ার আগেও তারা এনার্জী সেক্টরের বৃহত্তম কোম্পানিগুলোর মধ্যে ছিল, যারা কয়েক দশক ধরে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করে চলেছিল।
বর্তমানে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী, গবেষক, ইন্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ানসহ মোট ৬২,০০০ কর্মকর্তা -কর্মচারী কাজ করছে এই কোম্পানিতে। এক্সন মোবিল বিশ্বের প্রায় ৩ ভাগ তেল এবং বিশ্বের প্রায় ২ ভাগ শক্তি উৎপাদন করে। এক্সনমোবিল এর মূল ব্র্যান্ড গুলো হলো, এক্সন, মোবিল, এসসো (Esso), এক্সনমোবিল কেমিক্যাল। বর্তমানে তাদের ৩৭ টি দেশে এর ২১টি শোধনাগার রয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ২১,৪৫০ টি পেট্রোল স্টেশনের একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে এই কোম্পানির। এক্সনমোবিল কর্পোরেট ওয়েবসাইটের তথ্য মতে এই কোম্পানি প্রতিদিন প্রায় ৬০ লক্ষ ব্যারেল তেল উত্তোলন, পরিশোধন এবং বিক্রি করে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী কেন এত বিতর্কিত এই এক্সন মোবিল কোম্পানি?
প্রায় দেড়শো বছর ধরে রাজত্ব করা এই তেল এবং গ্যাস কোম্পানি বরাবরই গোপন করে রেখেছে নিজেদের খারাপ দিকগুলো। মানব সভ্যতার বিকাশে তেলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও পরবর্তী সময়ে এটি পরিবেশের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা ভেবে ১৯৭০ সালে এক্সনমোবিল সহ বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো নিয়ে গবেষণা করা হয়।
বিজ্ঞানীরা ১৯৭০-এর দশকেই এই কোম্পানির জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। কিন্তু এক্সনমোবিল এ বিষয়ে সম্পূর্ণ বিরোধীতা করে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ভয়ঙ্কর ক্ষতি সম্পর্কে তারা অনেক আগে থেকে জানলেও প্রকাশ্যে জলবায়ুর পরিবর্তন বিজ্ঞানীদের দেওয়া পূর্বাভাসকে অনুমান নির্ভর এবং জলবায়ু বিজ্ঞানকে ‘খারাপ বিজ্ঞান’ বলে প্রচারণা চালায়। এক্সনমোবিল জনসাধারণ ও সরকারকে ‘জেনে শুনে বিভ্রান্ত’ করে এসেছে।
তবুও জলবায়ু সংকটে ভূমিকা রাখায় গত কয়েক দশক ধরে তেল নিয়ে কম সমালোচনা হচ্ছে না কোম্পানিটির। পরবর্তীতে গবেষণায় জানা যায়, তেল উৎপাদনের সময় উত্তোলন করা তেল থেকে যে বাড়তি প্রাকৃতিক গ্যাস নির্গত হয় তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর এ থেকে বাতাসে নির্গত হয় কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং কালো ধোঁয়ার মারাত্মক এক মিশ্রণ, যা বায়ু দূষণ ঘটায় এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন তরান্বিত করে।
এক্সনমোবিল কোম্পানি বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিশ্রুতি মেনে অঙ্গীকার করেছিল তারা ঠিক কতটা অবাঞ্ছিত গ্যাস পোড়াচ্ছে তা ঘোষণা করবে। কিন্তু সেবারও তারা তাদের দেওয়া কথা রাখেনা। তাদের অর্থহীন প্রতিশ্রুতি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। এতে ফের তোপের মুখে পরে এক্সনমোবিল।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে এক্সন মোবিলের জলবায়ু পরিবর্তন নথি সম্পর্কে জানতে অধ্যাপক নাওমি ওরেসকেস (Naomi Oreskes) ও জিয়ফ্রে সুপ্রান (Geoffrey Supran) নতুন করে গবেষণা চালিয়েছিলেন। এই দুই গবেষক ১৯৭৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এক্সনমোবিলের ১৫০টিরও বেশি নথি বিশ্লেষণ করেছেন। মার্কিন বহুজাতিক তেল ও গ্যাস করপোরেশন এক্সনমোবিলের অভ্যন্তরীণ এক নথি সেই সময়ে ফাঁস হয়েছিল। নথিতে বলা হয়েছিল, প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানীরা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। কিন্তু কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে তারা বৈজ্ঞানিক বাস্তবতাকে গোপন রাখতে প্রতারণামূলক প্রচারণার পেছনে ব্যয় করে শত শত কোটি ডলার ।
পরবর্তীতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্ট্রি অব সায়েন্সের অধ্যাপক নাওমি ওরেসকেস বিবিসিকে বলেন, ‘ এক্সন মোবিল তাদের নিজস্ব বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত নির্ভুলভাবে তাপমাত্রা পরিবর্তনের মডেলিংয়ের কাজটি করেছিলেন। তারা এই কঠিন সত্য আগে থেকেই জানত। এটি এক্সনমোবিলের নেতৃত্বের ভণ্ডামিকে উন্মোচন করে।’
গবেষকদের এ দাবির জবাবে এক্সনমোবিলের মুখ্যপাত্ররা বরাবরের মতোই বলে আসছে ‘এক্সনমোবিল জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট সমাধানে কাজ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ হাস্যকর বিষয় হচ্ছে !! এই কোম্পানি প্রতি মুহূর্তে কার্বন নিঃসরণ করে তাদের উৎপাদন বাড়াচ্ছে, কিন্তু সামনে দেখাতে চাইছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এক্সনমোবিল কোম্পানির তেলের পাইপ লাইন ছিদ্র হয়ে শত শত ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ছড়িয়ে পড়েছে নদীতে। প্রতিদিন রেকর্ড পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট গ্যাস বিষাক্ত করছে পরিবেশ। এর ফলে, বৃদ্ধি পাচ্ছে গ্রিন হাউজ গ্যাস, বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সৃষ্টি হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
সামুদ্রিক ঝড়, দাবানল, টর্নেডো, প্রচণ্ড তুষারপাতসহ আবহাওয়া এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ২০২২ সালে প্রায় ১৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অথচ, এক্সন মোবিল কোম্পানি ২০২২ সালের সেই মন্দার বাজারেও লাভ করেছে মোট প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার, যার পুরোটাই তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে।
আর এই বিপুল লাভ আবারও তেল কোম্পানিগুলোকে সমালোচনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। অনেক দেশ জোরদার দাবি জানিয়েছে যে, এসব কোম্পানির অতিরিক্ত মুনাফার ওপর আরও বেশি কর বা ‘ উইন্ডফল ট্যাক্স’ আরোপ করা হোক। সে বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোম্পানির ওপর উইন্ডফল কর আরোপ করার ফলে ১৩০ বিলিয়ন ডলারের লোকসান হয় বলে এক্সন মোবিল কোম্পানির । তারা লাভের বেলায় ষোল আনা বুঝে নিলেও, কর দেওয়ার সময় তালবাহানা শুরু করে।কোম্পানিটি এই জন্য ইইউ (EEU) এর বিরুদ্ধে মামলাও করে। তাদের দাবি, ইইউ (EEU) এর আইনি এখতিয়ারের বাইরে এই কর আরোপ করা হয়েছে।
এছাড়া বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্য মতে, মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট জলবায়ু সংকটের কারণে গত ৫০ বছরে সারা বিশ্বে সৃষ্টি হয়েছে ১১ হাজার ৭৭৮টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ । এসব দুর্যোগে দুই মিলিয়ন এর বেশি মানুষ মারা গেছে এবং আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪.৩ ট্রিলিয়ন ডলার।
ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর রিপোর্ট অনুসারে , চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে এসব স্বাভাবিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। সব এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পৃথিবী আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখবে।
এই সংকট থেকে সুরক্ষা পেতে হলে, এক্সনমোবিলের মতো কোম্পানিগুলোর জীবাশ্ম জ্বালানির আসক্তি থেকে বের হয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর করতে হবে। পুঁজি বাদী ব্যবসায়ীদের মাথায় রাখা উচিত, মৃত পৃথিবীতে কোনো লাভজনক ব্যবসা বা মুনাফা নেই। তাই মুনাফার আগে প্রাণ-প্রকৃতি, মানুষ ও পৃথিবীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে মন্তব্য জানান কমেন্ট বক্সে, পরবর্তি ব্লগ পড়তে বিজনেস ম্যানিয়ার নিউজলেটারটি সাবসস্ক্রাইব করুন।