Xiaomi & Lei Jun Story | যেখানে শাওমি কে হারাতে পারেনি কেউ
শাওমি(Xiaomi), আজ থেকে মাত্র ৩ বছর আগেও এই ব্রান্ডটি মোবাইল ফোনের জগতে ভারত বাংলাদেশসহ এশিয়ার এই উপমহাদেশের মধ্যে এক নম্বর মোবাইল ব্রান্ড ছিল। শাওমি জনপ্রিয় ছিল বিশেষ করে তাদের কম বাজেটের মধ্যে হাই কোয়ালিটি ফোনের (high quality phone) জন্য। এরমধ্যে শাওমির রিয়েলমি(Realme) সিরিজের ফোন গুলো ছিল স্ট্যুডেন্টদের কাছে সব থেকে বেশি জনপ্রিয়। কেননা একে তো এটিতে ছিল স্ট্যুডেন্ট ফ্রেন্ডলি বাজেট তার উপর ভালো কনফিগারেশনের (configuration) জন্য হাল আমলের জনপ্রিয় মোবাইল গেম যেমন পাবজি(pubg) কিংবা ফ্রী ফায়ার(Free Fire) এটাতে খুব স্বছন্দে রান করানো যেত। যে কারনে স্ট্যুডেন্টদের কাছে শাওমির ওই ফোনগুলো ছিল প্রথম পছন্দ। আর এ কারণেই কোম্পানির শুরু মাত্র ৬ বছরের মাথায় শাওমি হয়ে যায় এশিয়ার এক নাম্বার মোবাইল ব্রান্ড। কিন্তু এই দু থেকে তিন বছরের মাথায় কি এমন হয় শাওমির সাথে যে এক সময়কার লিডিং ব্রান্ড শুধুমাত্র ২০২২ সালেই লস করেছে তার মোট ইনকামের প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার।
আজকের ব্লগে আমরা জানবো এক সময়কার জনপ্রিয় শাওমি ব্রান্ডের উত্থান আর ঠিক কি কি কারনে শাওমি পতন ও হয়েছিল।
শাওমির শুরুটা হয় আজ থেকে প্রায় ১ যুগ আগে ২০১০ সালে, লি জুন(Lee Joon)এর হাত ধরে। লি জুন তার আরো ৭ জন বন্ধুকে সাথে নিয়ে ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল একটা সফটওয়্যার এর ফার্ম দিয়ে বসে। যারা ওই বছরই ইউআই(UI) হিসেবে এমইউয়াই (MUI) লঞ্চ করে। তার এই সফটওয়্যারটি এতটাই ভালো ছিল যে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় ১০ লক্ষ এর বেশি বার এটা ডাউনলোড করা হয়। কিন্তু লি জুন এটা নিয়েই খুশি ছিল না। লি জু লক্ষ্য করে চীনের বাজারে কোন কোন বাজেট ফ্রেন্ডলি মোবাইল ফোন নেই। মার্কেটে থাকা বেশির ভাগ মোবাইল ফোনই হয় অনেক বেশি প্রাইজের নাহয় এমন সব সস্তা ফোন যেগুলো দিয়ে ডে টু ডে কাজগুলো ও ঠিকি মতো করা যায় না। এরপর লি জু সিদ্ধান্ত নেয় সফটওয়্যার না বানিয়ে তারা সরাসরি এমন একটা বাজেট ফ্রেন্ডলি (budget6-friendly)মোবাইল সেট বানাবে যেটার প্রাইস বাজেটের মধ্যে হলেও কনফিগারেশন অনেক হাই থাকবে। সোজা কথায় দামে কম মানে ভালো টাইপের একটা ফোন।
আর একারণে তারা একটা নতুন স্ট্রাটেজি হাতে নেয়। এই স্ট্রাটেজি অনুযায়ী তারা তাদের বানানো ফোনগুলো ৫% এর থেকে কম প্রফিটে সেল করবে। আর বিভিন্ন এড দেখানো সার্ভেসিং চার্জ, পেইড এপ ও ইকো সিস্টেম তৈরীর মাধ্যমে তারা তাদের কম্পিটিরদের থেকে ১০গুণ বেশি প্রফিট তুলে নিবে। এতে করে কোম্পানি যেমন প্রফিটে থাকবে তেমনি অল্প বাজেটে ফোন দেওয়ায় তারা ইজিলি মার্কেট ও ক্যাপচার করতে পারবে। যেই ভাবা সেই কাজ লি জু এর শাওমি লেগে পরে তাদের প্রথম মোবাইল ফোন তৈরীর জন্য।
এবং মাত্র এক বছরের মাথায় ২০১১ সালে শাওমি এময়াই ওয়ান(Mi A1) নামে তাদের প্রথম ফোন বাজারে আনে। বাজারের আনার মাত্র একবছরের মাথায় শাওমি এই সিরিজের টোটাল ১৪ লাখের বেশি ফোন সেল করে ফেলে। ঠিক তার পরের বছর শাওমি বাজারে আনে তাদের সেকেন্ড ফোন এময়াই টু(Mi A2)। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে শাওমি মাত্র দু মাসের মাথায় ১০ লাখেরো বেশ ফোন সেল করে ফেলে। এত অল্প সময়ের মধ্যে শাওমির এই জনপ্রিয়তার কারণ ছিল যে বাজারে থাকা অন্য যেকোন কোম্পানির থেকে তারা সবথেকে কম দামে শোব হাই কোয়ালিটির ফোন দিচ্ছিল। এরফলে মাত্র তিন বছরের মাথায় ২০১৪ সালে শাওমি স্যমসাং(Samsung), নোকিয়া(Nokia) আর সনিকে (Sony)কাটিয়ে দিয়ে চীনের মোবাইল মার্কেটকে ডমিনেট করা শুরু করে।
একই বছরই শাওমির প্রতিষ্ঠাতা লি জু এর সাথে পরিচয় ঘটে মানু জেন নামের এও ভারতীয় ব্যবসায়ীর। লি জু জানতে পারে যে ভারতের মার্কেটের অবস্থা প্রায় একই। বাজেট ফ্রেন্ডলি ফোনের হাই ডিমান্ড থাকলেও কোন ব্রান্ডই এমন ফোন বানায় না। ফলে বাজেট ফ্রেন্ডলি মোবাইলের গোটা মার্কেটই অধরা। তাই লি জু ভারতেও তাদের শাওমি ব্রান্ড লঞ্চ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর ২০১৪ সালেই ভারতে শাওমি ব্রান্ড লঞ্চ করে ফেলে। তবে ফোনের প্রাইস কম রাখার জন্য ভারতেও শাওমি অন্য রকম একটা টেকনিক ইউজ করে। সাধারনত রিটেইল শপে মোবাইল ফোন সেল করতে গেলে ব্রান্ডগুলো এক্সট্রা অনেকগুলো কস্ট হ্যান্ডেল করতে হয়। যার ফলে এক্সট্রা দাম এসে এড হয় মোবাইল ফোনের প্রাইজের সাথে। তাই শাওমি সিদ্ধান্ত নেয় শুধুমাত্র অনলাইনে শাওমি এর ফোনগুলো সেল করার। এতে করে এক্সট্রা কস্ট থেকে তারা যেমন বেচে যাবে তেমনই ফোনের প্রাইজ ও হাতের নাগালের মধ্যে থাকবে। ফলে অনলাইন থেকেই শাওমি তাদের ফোনগুলো ভারতে সেল করা শুরু করে।
শাওমি যে সময় ভারতের বাজারে আসে সে সময় ভারতের মোবাইল মার্কেটকে ডমিনেট করছিল স্যামসাং নোকিয়া আর সনির মতো মোবাইল ব্রান্ডগুলো। কিন্তু ২০১৭ সাল আসতে আসতেই শাওমি স্যামসাংকে কাটিয়ে হয়ে যায় ভারতের এক নাম্বার মোবাইল ব্রান্ড। সে সময় যেখানে স্যামসাং এর দখলে ছিল গোটা মার্কেটের ১৫% সেখানে মাত্র তিন বছরে শাওমির দখলে চলে আসে ১৭% মার্কেটে। এর পিছনে বড় কারণ ছিল শাওমির বাজেট ফ্রেন্ডলি হওয়াটা। কেননা সে সময় কিশোর আর তরুন সমাজের কাছে পাবজি ফ্রি ফায়ার এই মোবাইল গেমগুলো বেশ জনপ্রিয় হচ্ছিল। আবার অন্যদিকে তাদের বাজেটের এত বেশি ছিল না যে তারা দামী কোন মোবাইল কিনতে পারে। ফলে তারা ঝুকছিল শাওমির দিকে। কেননা শাওমি মাত্র ১৫ হাজারেই এমন ফোন দিচ্ছিল যেগুলোতে এই গেমগুলো ইজিলি রান করানো যেত। ফলে শাওমির মোবাইলের চাহিদাও দিন বাড়তে থাকে।
অবস্থা এমন এসে পৌছায় যে রিটেইল শপগুলো অনলাইন থেকে শাওমি ফোন কিনে নিজেদের শপগুলোতে বিক্রী করতো। এটা দেখে শাওমি ভারতেও তাদের শো রুম খুলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই কাজটা করে শাওমি একটু স্টাইল করে। তারা একই দিনে একই সময়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় টোটাল ৫০০টি আউটলেট খুলে বসে আর এর মাধ্যমে শাওমি একটা গিনিস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করে নেয়। সাথে ফ্রীতে মার্কেটিং তো হয়েই যায়।এই মুলত ২০১৯ সাল অব্দীই শাওমির গোল্ডেন টাইম বলা চলে, কেননা এরপর থেকেই শুরু হয় শাওমির ডাউন ফল।
শাওমির প্রথম ডাউন ফল আসে তাদের বাজেট ফ্রেন্ডলি ফোন গুলোর উপর। শাওমির একটা বড় এমাউন্ট প্রফিট আসতো কিন্তু এই বাজেট ফ্রেন্ডলি ফোনগুলো থেকে। বিশেষ করে যেগুলোর প্রাইজ ছিল ১৫ হাজারের মধ্যে। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ফোনগুলোর সেল কমতে শুরু করে। কেননা ততদিনে মানুষ ফোনকে একটা লাক্সারিয়াস প্রডাক্ট হিসেবে দেখা শুরু করে। মানুষ কম দামে ভালো ফোন না কিনে বরং আরো টাকা জমিয়ে দামী ব্রান্ডের ফোনগুলো কেনা শুরু করে শুধুমাত্র শো অফ করার জন্য। এছাড়াও ওই সময়টাতে ইএমাই দিয়ে ফোন কিনার সুযোগ ও চালু হয়। ফলে বেশির ভাগ মানুষই ইএময়াই চুক্তিতে অ্যাপেল কিংবা স্যামসাং এর ফোন কেনা শুরু করে। ফলে এক ধাক্কাতেই শাওমি ভারতের এক নাম্বার মোবাইল ব্রান্ড থেকে চলে আসে নাম্বার তিনে।
আগেই বলে রেখেছি শাওমির অন্যতম প্রধাণ মার্কেট ছিল এই ভারত। আর ঠিক করোনার পর পর থেকে যখন ভারতে বয়কট চায়না মুভমেন্ট শুরু হয় শাওমি তখন আরো বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়।কিন্তু শাওমির এই ডাউন ফল এখানেই শেষ হয়নি।
ব্যাবহারকারীদের তথ্য পাচারের দায়ে ভারত সরকার থেকে ২০২১ সালে শাওমি কে প্রায় ৫৫ মিলিয়নের বিরাট এক জরিমানা করা হয়। যার ফলে শাওমি বাধ্য হয় ভারত থেকে তাদের বাজার কমিয়ে আনতে। কিন্তু শাওমির শেষ ধাক্কাটা খাওয়া কিন্তু তখনো বাকি ছিল। ২০২২ সালে ট্যাক্স ফ্রড ওর দায়ে শাওমির ৫৫০৫ কোটির ট্রানজেকশন আটকিয়ে দেওয়া হয়।
এসবের মধ্যেই আবার নিজেদের মধ্যে কনফ্লিক্ট এর কারণে মানু জেন সহ শাওমির আরো অনেক বড় বড় কর্মকর্তা শাওমি ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে শাওমি অনেকগুলো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন কাছাকাছি প্রাইজের মধ্যে সাওমি অনেকগুলো ফোন লঞ্চ করে। যার ফলে শাওমির নিজেদের কাস্টমাররাই কনফিউজড হয়ে যেতো যে আসলে কোন ফোনটা তারা পারচেস করবে।
এছাড়াও শাওমির ইউজাররা বিভিন্ন রকম ঝামেলা ফেস করতে থাকে, যেমন ঠিক মতো আপডেট না আসা, বাগ প্রবলেম স্টোরেজ প্রবলেম এসব ফলে একবার শাওমির ফোন কিনলেও পরবর্তী বেশির ভাগ মানুষই পুনরায় শাওমি কেনার আর ভরসা করতে পারে না। বরং আরেকটু টাকা যোগ করে তারা দামী ব্রান্ডের ফোনগুলোর দিকে বেশি ঝুকতে থাকে।
শাওমি যে দামী প্রিমিয়াম কোয়ালিটির ফোন বানায় না এমন টা না। কিন্তু তারা নিজেদের বাজেট ফ্রেন্ডলি ইমেজটা এমন ভাবে তৈরী করেছে এখন সেই ইমেজেই তাদের ডাউন ফলের অন্যতম কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।
তবে তাদের এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে শাওমি আবার একে বারে অন্য একটা পন্থা বেছে নিয়েছে। তারা কিছু দিন আগেই প্রথম বারের মতো বাজারে এনেছে বিদ্যুৎ চালিত গাড়ি। আর এখানেও তারা একই স্ট্রাটেজি ইউজ করেছে। সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ চালিত এই গাড়িগুলোর বাজার মূল্য শাওমি ধরেছে প্রায় ৩০ হাজার ডলার। যা হাল আমলের টেসলার গাড়িগুলোর প্রাইজ থেকে বেশ কম। তবে ইতোমধ্যেই গাড়িটি লঞ্চ করার কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারেরো বেশি অর্ডার পেয়েছে শাওমি। এখন দেখার বিষয় এটাই যে তাদের এই গাড়ি কি আসলেই তাদের খারাপ অবস্থা থেকে বের করে আনতে সক্ষম হবে? নাকি শাওমির বোঝা আরো ভাড়ি করবে।
আজকে এই অব্দি।আজকের জন্য এই পর্যন্তই। ব্লগটি আপনাদের কাছে কেমন লাগলো তা কমেন্টে জানাবেন । সাম্প্রতিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিদিন আপডেট পেতে চাইলে নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করে ফেলুন।