Saudi Aramco : বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেল কোম্পানী | The Rise of Worlds Largest Oil Company
এই পৃথিবীতে প্রায় যতগুলো মূল্যবান খনিজ সম্পদ রয়েছে তেল এদের মধ্যে কিন্তু সবথেকে বেশি জনপ্রিয়। আর তেলের কথা শুনতেই সবার আগে আমাদের মাথায় আসে তেলের সম্রাজ্য বলে খ্যাত মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরবের নাম।
আর সৌদি আরব এরি একটি কোম্পানি হচ্ছে আরামকো। যা কিনা তেল উৎপাদন আর পরিশোধনের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম একটি কোম্পানি।
চলুন আজ আমরা জেনে নেই এই বিশ্ববিখ্যাত সৌদি কোম্পানি আরামকো (Saudi Aramco) সম্পর্কে ।
সৌদি রাজা ইবনের আমলে সৌদি আরব তখন ৪টি আলাদা আলাদা অঞ্চল বা রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এগুলো হলো হেজাজ,নাজদ, পূর্ব আরব এবং দক্ষিণ আরব। তিনি তার শাসনামলে এই রাজ্যগুলোকে একত্রিত করার সিধান্ত নেন। প্রায় টানা তিন দশকের লড়াই শেষে তিনি এই কাজ করতে সক্ষম হন।
ক্যালেন্ডারে তখনো চলছিল ১৯১৩ সাল। সৌদি আরবের তেলের খনি তখনও ছিল পুরোপুরি অনাবিষ্কৃত। সৌদি এক করার পরই রাজা ইবনে সৌদ এবার নজর দেন তেলের দিকে।
এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে, তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির সাথে তেল অনুশন্ধানের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন; বর্তমানে তেল অনুসন্ধানকারী কোম্পানীর নাম শেভরন।
কিন্তু গোটা সৌদি আরব জুড়ে অনেক অনুসন্ধান চালানোর পরো ওই অয়েল কোম্পানিটি কোন তেলের খনি খুজে পায় নি। এমনি এই প্রেজেক্টের সাথে জড়িত অনেকেই এই ব্যাপারে আশা ছেড়ে দিতে থাকে।
কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটাই একটি ইউ–টার্ন নেয় , যখন ভূতাত্ত্বিকরা সৌদি আরবের পূর্ব উপকূলের শহর দামুমের কাছে জরিপ করা শুরু করে। আর এ জরিপের পরপরই স্ট্যান্ডার্ড অয়েল থেকে ড্রিলিং শুরু করার নির্দেশ আসে।
আর এভাবেই নানা জরিপ আর ড্রিলিং চলে টানা ৫ বছর। এই ৫ বছর ধরে সৌদি আরবে প্রায় ৭টি তেলের কূপের খনন শেষ হয়ে। যদিও এর মধ্যে ৭ নাম্বার কূপটি খনন শেষে মৃত কূপ হিসেবে ঘোষনা দেয়,খননকারী কোম্পানিটি।
সে সময় যে কজন ভূতত্ত্ববিদ এই খননের কাজের সাথে নিয়োজিত ছিলেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ম্যাক্স স্টেইনকি ( Max Steineke)। তিনিই প্রথম সৌদি আরবে তেলের খনি থাকতে পারে বলে আশা ব্যাক্ত করেন।
দামাম শহরের কাছে তেলের কূপ আবিষ্কার হবার পর থেকেই সৌদি আরবের চেহারা পাল্টাতে থাকে। এক সময় কার যাযা বরদের দেশ বলে খ্যাত সৌদি আরব দিন দিন অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে এগোতে শুরু করে। আর এই ছোয়া লাগতে শুরু করে সৌদি আরবে বসবাস করা সাধারণ মানুষদের মধ্যেও।
তবুই সৌদি আরব নতুন নতুন তেলের খনির অনুসন্ধান চালাতে থাকে। এরই মধ্যে ১৯৪১ সালের দিকে আবখাই নামের আরো একটি শহরে তেলের খনির সন্ধান মিলে। আর খনিতে থাকা তেলের মজুত আগের সবগুলো রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যায়।
কিন্তু তবুও সৌদি আরব এই অনুসন্ধান বন্ধ করে না। কেননা ততদিনে সৌদি আরব এটা বুঝতে পেরেছে যে, তাদের পায়ের তলায় এমন একটা কিছু আছে যেটা তাদেরকে বিশ্ব রাজনীতির একটা বড় খেলোয়াড় এ পরিনত করবে সেই সাথে শক্তিশালী একটা স্থানেও নিয়ে আসবে।
এরই মধ্যে আবার ম্যাক্স স্টেইনক তার, অন্য দুই আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার, জে ডব্লিউ হুভার এবং জেরি হ্যারিসের সাথে নিয়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রায় ৫ বছর যাবত তেলের খনির অনুসন্ধান পরিচালনা করে।
এরই মধ্যে আবার ঘটে যায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তখন চলছিল ১৯৪৪ সাল। আর এসময় ক্যালিফোর্নিয়া অ্যারাবিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানিকে অ্যারাবিয়ান আমেরিকান অয়েল কোম্পানি বা সংক্ষেপে আরামকো হিসাবে পুনরায় ব্র্যান্ডিং করা হয়।
পুরো ১৯৪০ এর দশক জুড়ে, আরামকো কোম্পানিটি প্রতিদিন প্রায় ৫০,০০,০০০(পঞ্ছাশ লক্ষ) ব্যারেল করে তেল উত্তলন করতে থাকে। আর এই পরিমান দিন দিন বাড়ছিল । আর এই পরিসংখ্যানকে পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমামে সৌদি আরবে প্রতিদিন প্রায় ১০ মিলিয়ন ব্যারেল করে তেল উত্তলন করে।
নিজেদের এই তেল রূপান্তরিত করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ১৯৫১ সালে, উপসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে প্রায় ১২০০কিলোমিটারের বেশি প্রসারিত ট্রান্স আরাবিয়ান পাইপলাইন খোলে সৌদি আরব।এই পাইপলাইনটি ভূমধ্যসাগরে তেলের চলাচল করে আগের থেকে অনেক বেশি সহজতর এরফলে তেল পরিবহনের খরচ নেমে আসে কয়েক গুন।যদিও ১৯৫১ সালে চালু হওয়া এই পাইপ লাইনটি ৩২ বছর পর ১৯৮১ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
সৌদি আরব প্রথম থেকেই চাইতো বিশ্ব তেলের বাজারে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে। সে জন্য সৌদি আরব ১৯৬০ সালে ওপেক গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। আর এই সংস্থাটির তেল উৎপাদন নীতি সমন্বয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়াকে বাদ দিয়ে সৌদি আরাব সহ সংঘটিত করে বিশ্বের অন্যান্য প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকে।বর্তমামে ডমেস্টিক এমনি আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়বে নাকি কমবে আর বাড়লেও ঠিক কতটুকু বাড়বে এটা নিয়ন্ত্রণ করে ওপেক(opec)।
১৯৭৩ সালে শুরু হয় আরব – ইসরায়েল যুদ্ধ, যা ইয়োম কিপপুর যুদ্ধ নামেও পরিচিত। এই যুদ্ধে, সৌদি সরকার সংঘাতে জড়ানো মুসলিম দেশগুলির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে, আর ওপেক সদস্যরা পশ্চিমা দেশগুলিতে তেল রপ্তানির মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। এরপর ১৯৭৪ সালের দিকে সৌদি সরকার আরামকোতে নিজেদের অংশীদারিত্ব বাড়িয়ে ৬০% এ নিয়ে আসে আর , অবশেষে ১৯৮০ সালে পুরো কোম্পানিকেই জাতীয়করণ করে ফেলে।
এর পরবর্তী দশকগুলিতে সৌদি আরব তেল উত্তলন ও উৎপাদনের জন্য আরো নতুন নতুন কোম্পানি খুলতে শুরু করে।২০০৯ সাল নাগাদ, কোম্পানির দৈনিক তেল উৎপাদনের ক্ষমতা চলে যায় ১২ মিলিয়ন ব্যারেলে । ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এক দিকে যেমন তেলের দাম দিন দিন বাড়ছিল অন্যদিকে তেমনি আবার সৌদি আরব নতুন নতুন টেকনোলজি ব্যাবহার করে আরো বেশি পরিমানে তেল উতপাদন করছিল। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই সৌদি আরবের অর্থনীতির মধ্যে বিরাট একটা গতি চলে আসে।
কিন্তু এ সুসময় বেশি দিন থাকে না। ২০১৪ সালেই তেলের দাম আবার কমতে শুরু করে আর, অল্প সময়ের মধ্যে তেলের মূল্যে ৫০% এরও নিচে নেমে আসে। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে শেষ দিকে তেলের দামের এই ক্রমাগত পতনে , সৌদি আরবের অর্থনৈতিক দুর্বলতাগুলো সামনে আসতে শুরু করে। অতিরিক্ত তেল নির্ভর হবার কারণে দেশটি তার বাজেট এবং চলতি হিসাব উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতির সম্মুখীন হতে থাকে।তবে দেশের এই করুন অবস্থা দেখে হাত গুটিয়ে বসে থাকে না সৌদি আরবের রাজা মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি সেসময় ভিশন ২০৩০ নামে নতুন একটা পরিকল্পনা শুরু করে। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল অব্যবহৃত খনিজ মজুদের ব্যাবহার বাড়ানো, বৈশ্বিক বাণিজ্যে এর ভূমিকা বাড়ানো এবং ধর্মীয় পর্যটন থেকে রাজস্ব বৃদ্ধি করে সৌদি অর্থনীতির আধুনিকীকরণ এবং বৈচিত্র্য আনা।
কিন্তু,এসবের পরও আরামকো কোম্পানির ঘাড়ে যেন বিপদ নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। পরিবেশ দূষণ, শ্রমিকদের মানবিক অধিকার হরণসহ নানা ইস্যুকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে অনেকেই আরামকো কোম্পানিটি পুরোপুরি বন্ধের চাল চালতে থাকে। বিষয়টি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় যে খোদ সৌদি সরকার ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে। অবশেষে বেশ কয়েকটি বড় আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে চিঠি পাঠিয়ে এই বিষয়ে সৌদি আরব পরামর্শ চায়।এদের মধ্যে কেউ কেউ যুক্তি দেন যাতে করে আরামকোর তেল ও গ্যাস উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কার্বন বাজেট এক থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে ঘটতে পারে আরও মারাত্মক জলবায়ু পরিবর্তন।
অনেকেই আবার উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। কেননা বিশ্ব যখন নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকছে তখন এমন কোম্পানির ভবিষ্যৎ যে খুব একটা ভালো না সেটা সহজেই বলা যায়। তবে এটাই শেষ নয়, জামাল খাশোগি হত্যার মতো ঘটনা সহ তেল বিলিয়নেয়ারদের গ্রেপ্তার সৌদি সরকার আর আরামকোকে নিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দেয়।
যাই হোক, বর্তমানে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স এমবিএস আইপিওর মূল্য অনুমান করেছেন প্রায় $2 ট্রিলিয়ন ডলার।যদিও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতে এর মুল্য হতে পারে অনুমানিক করা মূল্য থেকে প্রায় $500 বিলিয়ন ডলার কম। আরামকো এর সূচনা থেকে শুরু করে অল্প সময়ের মধ্যে একটি বৈশ্বিক তেল জায়ান্ট হয়ে ওঠার যাত্রাটা সৌদি আরবের অর্থনীতিকে যেমন শক্তিশালী করেছে। তেমনি সৌদি আরবের রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহনযোগ্যতাও বাড়িয়েছে।
বর্তমানে সৌদি সরকার এর ভিষন ২০৩০ এর সাথে মধ্যপ্রাচের দেশগুলোতে দীর্ঘদিন চলে আসা অস্বস্তিশীলতার সাথে আরমাকো কীভাবে খাপ খাইয়ে নেয় তাই বর্তমানে দেখার বিষয়।
কেমন লাগলো আমাদের আজকের ব্লগটি? কমেন্টে অবশ্যই জানাতে ভুলবেন না। ভালো লাগলে লাইক দিন নিউজলেটার , সাবস্ক্রাইব করুন এবং শেয়ার করুন সবার সাথে।