দারাজ: ই-কমার্সে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা
কোন কোম্পানি একদিনেই ২৯ লাখ ক্রেতার দেখা পেয়েছিল? পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল এবং মায়ানমার সহ দক্ষিণ এশিয়ার এই পাঁচটি দেশে মোট ৫০০ মিলিয়ন গ্রাহকদের অ্যাক্সেস সহ পরিচালনা করছে এই কোম্পানি টি। হ্যা ,কথা বলছি বাংলাদেশের সবথেকে জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস দারাজ(Daraz) সম্পর্কে । কিন্তু কিভাবে হল দারাজ,এর জন্ম ? এত কম দামে প্রতি বছরে এত এত অফার দিয়ে যাচ্ছে দারাজ, তবে তাদের সাফল্যের কিন্তু কোন ঘাটতি হচ্ছে না। এই সাফল্যের পিছনের অজানা রহস্য কী জানতে চাচ্ছেন তো?
কেন দারাজ এর জন্য বাংলাদেশ এ আসতে পারছে না দারাজ সমতুল্য বড় বড় কোম্পানি? তাহলে কি ছিল তাদের মার্কেটিং পরিকল্পনা?
আরেকটা মজার কথা, দারাজ নিজেদের সাফল্যের জন্য পুরুষদের বাদ দিয়ে অধিক নারী নিযুক্ত করতে চায়! ব্যাপার টা খুব interesting না?
এইখানেই শেষ না কিন্তু , দারাজ সম্পর্কে রয়েছে আরও অনেক অজানা তথ্য।
জানতে হলে পুরো ব্লগটি পড়ুন শেষ পর্যন্ত।
প্রথমে আলোচনা করা যাক দারাজ(Daraz) দেশি না বিদেশি কোম্পানি?
দারাজ (Daraz)মূলত একটি বিদেশি কোম্পানি যা দক্ষিণ এশিয়ার একটি নেতৃস্থানীয় ই–কমার্স প্ল্যাটফর্ম। দারাজ প্রথমে ২০১২ সালে পাকিস্তানে ফরিস শাহ এবং মুনীব মায়ার দ্বারা একটি অনলাইন ফ্যাশন খুচরা বিক্রেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তদের থেকে ২০১২ সালে জার্মান ভিত্তিক এশিয়া প্যাসিফিক(Asia Pacific) ইন্টারনেট গ্রুপ ক্রয় করে দারাজ নামে একটি অনলাইন কেনাকাটার ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান চালু করে। তারপর ২০১৫ সালে ‘দারাজ বাংলাদেশ’ নামে বাংলাদেশে দারাজের কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘কেইমু’ দারাজের সাথে একীভূত হয়।
দারাজের প্রোডাক্ট বৈচিত্র
দারাজ(Daraz) একটি বিশাল প্রোডাক্ট বৈচিত্রের ভান্ডার। কি নেই দারাজে? সুই সুতা থেকে শুরু করে লক্ষ টাকার প্রোডাক্ট যেমন ফোন, টিভি পর্যন্ত আছে এই একটি APP-এ। দারাজ বাংলাদেশের প্ল্যাটফর্মে মোট ১৪টি স্বনামধন্য স্থানীয় ব্র্যান্ডের সাথে অংশীদারত্ব করেছে যাতে করে তারা গ্রাহকদের জন্য আরও সুবিধাজনক কেনাকাটার অভিজ্ঞতা প্রদান করতে পারে। দারাজ ইতিমধ্যেই BATA , Esctasy এবং Yellow এর মতো ব্র্যান্ডগুলোর পাশাপাশি প্রযুক্তি জায়েন্ট Walton, Samsung এবং Butterfly 5 এর সাথে সফলভাবে অংশীদারত্ব করছে৷
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় পন্য ক্রয় করার পর প্রোডাক্ট নিয়ে নানা ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছে ক্রেতারা। বেশিরভাগ প্রোডাক্টে নানা ত্রুটির কারণে প্রতিনিয়ত প্রোডাক্ট রির্টান আসছে। কিন্তু এত এত প্রোডাক্ট রিটার্ন হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে টিকে আছে দারাজ(Daraz)? কেনো এর জন্য কোনো বিরূপ প্রভাব পরছেনা দারাজের উপর?
আসলে প্রচুর পরিমাণে পণ্যের রিটার্ন হওয়া সত্ত্বেও দারাজ(Daraz) টিকে থাকার জন্য বেশ কিছু ব্যবসায়িক নীতি ও কৌশল বাস্তবায়ন করে থাকে। এই কৌশলগুলোর মধ্যে একটি হল স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর সাথে অংশীদারিত্ব করে বিভিন্ন পণ্যের জনপ্রিয়তা বাড়ানো এবং এর গ্রাহকদের জন্য আরও সুবিধাজনক কেনাকাটার অভিজ্ঞতা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা।
কিভাবে প্রোডাক্ট দিচ্ছে দারাজ(Daraz)?
দারাজ(Daraz) কম মূল্যে পণ্য অফার করার জন্য বিভিন্ন কৌশল নিযুক্ত করে, যা বিক্রেতা এবং গ্রাহক উভয়কেই উপকৃত করে। যেমন দারাজ(Daraz) বিভিন্ন প্রচারমূলক প্রচারণা চালায় যা পণ্যের উপর অবিশ্বাস্য ডিসকাউন্ট অফার করে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে এবং তাদের পণ্য তালিকায় এগিয়ে যেতে প্ররোচিত করে।
এখানে বিক্রেতারা তাদের নির্বাচিত সাব–ক্যাটাগরিতে নির্দিষ্ট লাভ রেখে সর্বনিম্ন মূল্য রাখে যা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে থাকে এবং বিক্রয় বাড়াতে সহয়তা করে। একবার পণ্যের ট্র্যাকশন লাভ করলে, বিক্রেতারা আরও বেশি লাভের মার্জিন থেকে মুনাফার জন্য দাম কম রাখতে পারে, যা বিক্রেতা এবং গ্রাহক উভয়কেই উপকৃত করে।
দারাজ(Daraz 11.11) ১১.১১
অবিশ্বাস্য অফার! মাত্র ১ টাঁকায় ১৬ লাখ টাঁকার গাড়ি – এমনই কিছু স্লোগান দিয়ে শুরু হয়েছিল দারাজ ১১.১১ ক্যাম্পেইন।
প্রতারনার অভিযোগে যখন ইভ্যালির(evaly) মতো অনলাইন শপ আইনের আওতায়, দারাজ(Daraz) ফাদ পেতে একই হারে লোক ঠকালে ও তাদের বিরুদ্ধে কারো কোন অভিযোগ নেই।
তবে আপনি কি জানেন এ ধরনের ক্যাম্পেইন এর কোন বৈধতা-ই নেই?
কেন বলছি প্রতারনা ? দেখুন ১ টাকা হয়ত তেমন কিছুই না, না তবে বিষয় টা এখন এইভাবে ভাবুন– দেশ এ ১৭ কোটি মানুষ, এখন প্রত্যেক এর থেকে যদি ১ টাকা করে নেয়া হয় তাহলে মোট টাঁকার পরিমান কত হয়?হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন ১৭ কোটি টাকা ! যা একটি বিরাট মুল্ধন।
এছাড়াও Daraz এমন একটি প্রোগ্রামও প্রতিষ্ঠা করেছে যা দারাজকে ১.৩ মিলিয়নেরও বেশি গ্রাহকের সাথে প্রায় ছয় হাজার সক্রিয় বিক্রেতাকে সংযুক্ত করতে সহয়তা করেছে। দারাজ বাংলাদেশে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এবং প্রচারণার প্রসারের জন্য প্রভাবশালী এবং সেলিব্রিটিদের সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবকে কাজে লাগায় তাদের এ সকল প্রতারনার ক্যাম্পেইন তথা বিজ্ঞাপন চালাতে। পাশাপাশি দারাজ তার পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য ইউটিউবও ব্যবহার করে নির্দিষ্ট দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য আকর্ষনীয় ভিডিও তৈরি করে থাকে। তাদের একটি বহুল পরিচিত শো–ই আছে এই ১১.১১ নামে, যা আমরা কম বেশি সবাই –ই দেখে থাকি। আর এতে করে আমার আপনার মতো সাধারণ গ্রাহক না বুঝেই তাদের ফাদে পা দিয়ে যাচ্ছি, যাতে লাভবান হচ্ছে শুধুই দারাজ!
দারাজ(Daraz) তাদের নিজস্ব সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম এবং অ্যাড এর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ক্যাম্পেইন, এবং discount-এ পণ্যের sale এর আপডেট শেয়ার করে থাকে। কিন্তুু, এত কম টাকায় এই সকল discount কিন্তু তাদের নিজস্ব লস থেকে হচ্ছে না বরং এইটা মূলত সেলার থেকেই আসে।
বাংলাদেশে দারাজের কম্পিটিটর কারা ?
দারাজ(Daraz) বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়, যার মধ্যে রয়েছে: আজকের ডিল(Ajkerdeal), পিকাবু(Pickaboo), বাগডুম(Bagdum),ইভ্যালির(Evaly) মতো সনামধন্য প্রতিষ্ঠান।
প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও,প্রতি মাসে প্রায় দুই মিলিয়ন গ্রাহককে আকর্ষণ করে দারাজ (Daraz) বাংলাদেশের ই–কমার্স শিল্পে একটি অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বজায় রেখেছে। দারাজের প্রথম দিকের বাজারে প্রবেশ, কৌশলগত অংশীদারিত্ব, ব্যাপক পণ্যের পরিসর, স্থানীয় পদ্ধতি এবং কার্যকর অনলাইন বিপণন কৌশলগুলো এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং সাফল্যে অবদান রেখেছে, যা প্রতিযোগীদের জন্য বাজারে এর প্রভাব এবং আধিপত্যের সাথে মেলানো চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে।
ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে দারাজ(Daraz) কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে
আমরা প্রায় সকলেই জানি বাংলাদেশ ই–কমার্সের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল আস্থাহীনতা এবং বিক্রেতার স্বল্প অভিজ্ঞতা। যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে একটি সাধারণ সমস্যা।
দারাজ(Daraz) গত তিন বছরে বাজার দখল করতে এবং ইকোসিস্টেম তৈরি করতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। তবে এই বিনিয়োগ থেকে তাদের মুনাফা ও উঠে এসেছে।
দারাজের সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হল গ্রাহকদের অভ্যাস পরিবর্তন করা এবং তাদের অনলাইনে কেনাকাটার প্রতি বিশ্বাস তৈরি করা। পাশাপাশি বাংলাদেশে ডেলিভারি এবং নগদ সংগ্রহের মতো চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে দারাজকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে।
এখন কথা বলা যাক গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা এবং সন্তুষ্টির উন্নতির জন্য দারাজ(Daraz) কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে।
গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা এবং সন্তুষ্টির উন্নতির জন্য দারাজ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যার মধ্যে রয়েছে, গ্রাহক পরিষেবার উন্নতি, পণ্যের অফার সম্প্রসারণ করা, অর্থপ্রদানের বিকল্প পথ গুলিকে আরো সহজ করা, ডেলিভারি পরিষেবার উন্নতি করা এবং গ্রাহকদের অভিযোগের দ্রুত সমাধান করা। এই পদক্ষেপগুলো দারাজকে তার গ্রাহকদের সন্তুষ্টি উন্নত করতে এবং এই প্ল্যাটফর্মে আরও ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে সাহায্য করেছে।
পাশাপাশি Daraz এর কঠোর ক্রেতা সুরক্ষা নীতি রয়েছে, যা ক্রেতাকে অনলাইনে কেনাকাটা করার সময় প্রতারনার ভয় থেকে আশ্বস্ত করে। এছাড়াও অর্ডার করার মুহুর্ত থেকে দারাজ ঝামেলামুক্ত ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি দেয়।
কিন্তুু সবকিছুর যেমন ইতিবাচক দিক থাকে সেই ভাবে কিছু নেতিবাচক দিকও থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
যেহেতু দারাজ সুধু মাত্র একটি প্ল্যাটফর্ম তাদের নিজস্ব কোন প্রোডাক্ট নেই তাই পণ্যের গুনগত মান বিচার করার মত কোন অবকাশ তাদের নেই। এ কারণে গ্রাহকদের অভিযোগটা ও একটু বেশি আর পণ্যের রিটার্নটাও ব্যাপক। এছাড়াও বিক্রেতারা সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করায় দারাজ এরই সুনামক্ষুণ্য হয়। দারাজের বিক্রয় কর ধার্য করে যা কম দামের পণ্য বিক্রেতাদের জন্য সুবিধার থেকে অসুবিধার কারণ বেশি হয়।
দারাজ(Daraz) ভবিষ্যতের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যেমন দারাজ অয়ারহাউস এবং বাছাই কেন্দ্র, ডেলিভারি হাব, লজিস্টিক সহ দারাজ মার্কেটপ্লেসের জন্য উদ্যোক্তা বা ই–কমার্স ব্যবসায়ীদের বিকাশ করার পরিকল্পনা করেছে। এছাড়াও দারাজের প্রধান মনোযোগ হল দুর্দান্ত গ্রাহক সেবা এবং বিক্রেতার অভিজ্ঞতার পর্যায়কে আরও বাড়ানো।
এগুলো থেকে ধারনা করা যায় এই পরিকল্পনাগুলো দারাজকে ই–কমার্স শিল্পে যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি করছে তা কাটিয়ে উঠতে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তার ব্যবসার উন্নতি অব্যাহত রাখতে সাহায্য করবে।
দারাজ (Daraz) কীভাবে আরও বেশি নারীকে মার্কেটপ্লেসে যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে?
দারাজ কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি নারী্দের সুযোগ প্রদানের পরিকল্পনা করেছে। দারাজের অন্যতম লক্ষ হল মার্কেটপ্লেসে বিক্রেতা হিসাবে আরও বেশি নারী উদ্যোগক্তাদের যুক্ত করা।
দারাজ নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ফ্লেক্সিবল কাজের সময় এবং দক্ষতা উন্নয়নের উদ্যোগ যেমন প্রাসঙ্গিক মেন্টরশিপ, প্রশিক্ষণ এবং সার্টিফিকেশন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছে।
Daraz বিভিন্ন ধরনের পণ্য,বিভাগ এবং ব্র্যান্ডের সাথে একটি অতুলনীয় কেনাকাটার অভিজ্ঞতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দারাজ বাংলাদেশে এই বছর ৬০০ কোটি টাকার টার্নওভার অর্জনের লক্ষ্য নিয়েছে। এখন শেষ পর্যন্ত দেখা যাক দারাজ এই টার্নওভারের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে কী না?
কেমন লাগলো আমাদের আজকের ব্লগটি? আপনারা চাইলে কিন্তু কমেন্ট করে জানাতে পারেন! ব্যাবসা সম্পর্কিত নিত্য নতুন তথ্য পেতে চাইলে আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করে ফেলুন এখনি। আজকের জন্য এই পর্যন্তই। ধন্যবাদ।