অক্সফোর্ড থেকে ফকিরাপুল- নিটল-নিলয়ের শক্তি কোথায়? | Nitol Niloy Empire | Business Mania
প্রিয় পাঠক, আমাদের আজকের এই গল্পটা কেবল একটা কোম্পানির না, এটা এক স্বপ্নের, একটা পথচলার, যা শুরু হয়েছিলো একদম শূন্য থেকে। আর আজ, সেটাই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য হয়ে।
যেই স্বপ্নটা দেখেছিলেন একজন সাধারন মানুষ, আব্দুল মাতলুব আহমাদ। মফস্বলের ছোট্ট এক উদ্যোক্তা থেকে যিনি হয়ে উঠলেন এমন একজন, যাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে এসেছে টাটা মোটরস, হিরো, আর অসংখ্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড।
আজকের এই লেখাটিতে আমরা জানবো কীভাবে মাত্র কয়েকটা গাড়ি বিক্রি থেকে শুরু করে আজ নিটল নিলয় হয়ে উঠেছে বিশাল একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি—যাদের ব্যবসা অটোমোবাইল, সিমেন্ট, কৃষি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রকল্প থেকে শুরু করে ইকোনমিক জোন আর আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ পর্যন্ত বিস্তৃত।
চলুন তাহলে একসাথে ঢুকে পড়ি নিটল নিলয়ের অনুপ্রেরণাদায়ক এই জার্নিতে—যেখানে প্রতিটি মোড়েই আছে বিস্ময়, পরিকল্পনা আর সাফল্যের ছাপ। নিটল-নিলয় গ্রুপ—বাংলাদেশের শিল্পজগতের এক উজ্জ্বল নাম। আর এই গ্রুপের পেছনের মানুষটি হলেন আবদুল মাতলুব আহমাদ। তার হাত ধরেই শুরু হয়েছিল এই বহুজাতিক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের পথচলা, যার শেকড় রয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে, আর শাখা ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়, যখন দেশ পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জে মুখোমুখি, তখন আবদুল মাতলুব আহমাদ বিদেশের নিরাপদ, আরামদায়ক জীবন ত্যাগ করে দেশে ফিরে এসেছিলেন। সেই সময় যারা দেশের স্বার্থে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
১৯৫২ সালে ঢাকার ফকিরাপুলে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল মাতলুব। তার বাবা ছিলেন আবু মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। যিনি ছিলেন পেশায় একজন জজ কোর্টের বিচারক। শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নেওয়া আবদুল মাতলুব তার পড়াশোনার শুরু ঢাকার নামকরা স্কুল-কলেজে, পরে নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে চলে যান যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড শহরে। সেখানে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে তিনি ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। কিন্তু দেশে ফেরার পরপরই তার বাবা মারা যান। রেখে যান ১৪ সন্তান ও একটি দায়িত্বের বোঝা। তখন পরিবারের জীবিকার কোনো নির্দিষ্ট উৎস ছিল না। তাই জীবন চালাতে পরিবারের সদস্যরা মিলে শুরু করেন পারিবারিক ব্যবসা।
এরপর ১৯৭৬ সালেই তিনি বিয়ে করেন তার বোনেরই বান্ধবী সেলিমা আহমাদকে। সে সময় সেলিমা আহমাদ এর বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। পরবর্তীতে যিনি কিনা কুম্মিলার ২ আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচত হন। পরিবারিক ব্যাবসা শুরুর কয়েক বছর পর যদিও সময়ের চাহিদা ও বাস্তবতার কারণে ভাই-বোনেরা নিজ নিজ পথ বেছে নেন, যার ফলে শুরু হয় তাদের আলাদা আলাদা উদ্যোগের যাত্রা। এই সময়ে আবদুল মাতলুব নিজে একটি স্বতন্ত্র ভিশন নিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করেন। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “নিটল মোটর্স”। তার প্রথম সন্তানের নাম ছিল ‘নিটল’—এই নাম থেকেই কোম্পানির নামকরণ। উদ্দেশ্য ছিল একটি কার্যকর এবং সংগঠিতভাবে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক গাড়ির বিস্তার ঘটানো।
তখনকার সময়ে দেশের বাজারে একটি গাড়ি কিনতে মানুষকে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হতো। এদিকে আবার গাড়ি আসার পরও অন্য কেউ অনেকে বেশি দাম দিয়ে গাড়ি কিনে নিয়ে যেত, ফলে ক্রেতারা হতাশ হতো। আবদুল মাতলুব এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে চান। তিনি ভেবেছিলেন, গাড়ির জন্য মানুষ বসে থাকবে না, বরং গাড়ি স্টকে থাকবে, শোরুমে থাকবে—মানুষ আসবে, দেখে পছন্দ করে সঙ্গে সঙ্গে কিনে নিয়ে যাবে। এই চিন্তাধারাই হয়ে উঠল নিটল মোটর্সের মূল চালিকাশক্তি।
১৯৮৬ সালে তিনি হিন্দুস্থান মোটরসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রেখে শুরু করলেন মিতসুবিশি ব্র্যান্ডের গাড়ির ব্যবসা। সেসময়টাতেই তারেক আরেক ছেলে নিলিয় জন্মগ্রুহন করে, তাই কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করে রাখেন নিটল নিলয় মোর্টস।
এরপর ১৯৮৯ সালে সুযোগ আসে ভারতের টাটা মোটরসের সঙ্গে কাজ করার। সেই সময় টাটার নেতৃত্বে ছিলেন রতন টাটা। আবদুল মাতলুব এসময় বাংলাদেশে টাটা মোর্টস ডিলারশিপ নেন। সেময়টা বাংলাদেশের বাজারে মালামাল বহনে ট্রাক এর একটা বিরাট চাহিদা দেখা দেয়। এই চাহিদাকেই কাজে লাগান তিনি। তবে আবদুল মাতলুব এখানেই থেমে থাকেন নি। তিনি চিন্তা করেন ডিলারশিপ এর চেয়ে যদি বাংলাদেশেই টাটার গাড়িগুলো অ্যাসেম্বল করার ব্যাবস্থা করা হয় তাহলে সেটা যেমন দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে তেমনি আবার দেশের বেকার মানুষের কর্ম সংস্থান এরো সুযোগ করে দিবে।
এই চিন্তা থেকেই তিনি রতন টাটাকে জানান যে বাংলাদেশে শুধু তিনি ডিলারশিপ নয়, তার পাশাপাশি বাংলাদেশে অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টও করতে চান। ফলে দীর্ঘ আলোচনার নিটল নিলয় মোটরসের ‘নিটা’ কারখানা, যা ছিল বাংলাদেশের প্রথম টাটা গাড়ির অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট।
পরবর্তীতে মহাখালীতে প্রতিষ্ঠা করেন নিটল-নিলয় সেন্টার, যা বর্তমানে গ্রুপের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুই ছেলে নিটল ও নিলয় আজ গ্রুপের নানা সেক্টরে যুক্ত আছেন। পাশাপাশি যোগ দিয়েছেন তাদের সন্তানরাও। ফলে নিটল-নিলয় গ্রুপ এখন একটি পূর্ণাঙ্গ পারিবারিক কনগ্লোমারেট।
১৯৯১ সালে তাদের প্রথম উৎপাদন ইউনিট শুরু হয়। এরপর একে একে সিমেন্ট, কাগজ, ফ্লাওয়ার প্রসেসিং, পরিবহন, ইলেকট্রিক গাড়ি, বাণিজ্যিক গাড়ি, ফুড আইটেম, রিয়েল এস্টেটসহ নানা খাতে নিটল-নিলয় গ্রুপ তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করে। বর্তমানে ছাতক, যশোর, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া, সিলেট, রংপুর, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে তাদের রয়েছে কারখানা, রিজিয়নাল হেডকোয়ার্টার এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল।
ছাতকে ৪০০ বিঘা জমির ওপর নিটল-নিলয়ের একটি বিশাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন রয়েছে, যেখানে গ্রিন ব্রিকস, খাদ্যপ্রস্তুত, পেপার মিলসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিশোরগঞ্জে তাদের পুরনো সুগার মিলটিকে রূপান্তরিত করে গড়ে তোলা হচ্ছে টায়ার প্ল্যান্ট ও স্পেশাল ইকোনমিক জোন। যশোরে তাদের রয়েছে একাধিক ইন্ডাস্ট্রি এবং প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের আরও অঞ্চলে সম্প্রসারণের। সেই হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে নিটল নিলয় গ্রুপের অধীনে রয়েছে প্রায় ২৬টির মতো অংগ প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে ৬টি জয়েন্ট ভেঞ্চার আর তিনটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি।
নিটল-নিলয় গ্রুপের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান হলেন সেলিমা আহমাদ, যিনি একজন সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আবদুল মাতলুব ও সেলিমা আহমাদ দুজনই সিআইপি সম্মাননা পেয়েছেন। এই দম্পতির যৌথ নেতৃত্বেই আজ নিটল-নিলয় দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে গ্রুপটি বৈদ্যুতিক গাড়ি, টু-হুইলার, থ্রি-হুইলার এবং বাণিজ্যিক ইভি নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নে কাজ করছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও দেশের বাইরে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন।
বিশেষ করে যেমন তারা ২০১১ সালের মে মাসে উগান্ডায় বাংলাদেশী কোম্পানিগুলির একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেয়। যার মাধ্যমে তারা উগান্ডায় ধান চাষের বিকাশের জন্য ১২.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এছাড়াও বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্প বিকাশের জন্য অমৃত গ্রুপের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
এর বাইরে নিটল নিলয় গ্রুপ ২০ এপ্রিল ২০১৪ সালে বাংলাদেশ এ একটি মোটরসাইকেল প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের জন্য হিরো মটোকর্পের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
শুধু তাই নয় নিটল নিলয় গ্রুপ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে টাটা মোটরসের সাথে একটি যৌথ উদ্যোগ, নিতা কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে টাটা পিকআপগুলিকে বাংলাদেশে অ্যাসেম্বল করার পরিকল্পনার ঘোষণা করে যার ২০২০ সালে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিডের কারণে সেটা পিছিয়ে যায়।
এছাড়াও কোম্পানিটি বাংলাদেশে টাটার ছোট গাড়ি “টাটা ন্যান” অ্যাসেম্বল করার আগ্রহও প্রকাশ করেছিল। কিন্তু কোভিডের কারণে এটিও পিছিয়ে যায়। নিটল-নিলয় গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার এখন প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার কোটি টাকা যার সাথে তৈরী করেছেন প্রায় ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান। আর এর মাধ্যমেই তারা দেশের অর্থনীতিতে এক বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে।
এছাড়াও ২০২৪ সালের ৯ জুলাই, শেখ হাসিনা যেই বেইজিং সফর করেন সেখানে বাংলাদেশ ও চীনের বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে ১৬টি সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিগুলোর মধ্যে নিটল-নিলয় গ্রুপ চীনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করে। কিন্তু ৫ আগস্টের পরবর্তী বাংলাদেশে এই চুক্তিগুলোর আর কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। হয়তো সাবেক সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে এই চুক্তিগুলো বাতিল হয়ে যেতে পারে।
প্রিয় দর্শক আমাদের আজকের আয়োজন এই অব্দি। ব্লগটি ভালো লাগলে লাইক কমেন্ট আর শেয়ার করতে ভুলবেন না। পাশাপাশি নিত্য নতুন বিজনেজ ব্লগ পড়তে আমাদের ওয়েবসাইটে ই-মেইল সাবস্ক্রাইব করে পাশেই থাকবেন। ধন্যবাদ।