Citycell কি ফিরতে পারবে ? Will CityCell Come Back | Business Mania
২০০০ পরবর্তী সময়ে অনেক মন মাতানো বিজ্ঞাপন দিয়ে সিটিসেল জয় করে নিয়েছিল লক্ষ্য মানুষের মন ” ওই সময়ে সিটিসেল এর ব্রান্ডিং ও সার্ভিস সব স্তরের মানুষের নজর কাড়ে! “সিটিসেল সবখানে” এই নামের ট্যাগ লাইন আর চটকদার সব প্রোমোশন সব মিলিয়ে সিটিসেল এর জনপ্রিয়তা ও ছিলো দারুন! বিশেষ করে সিটিসেল দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে ছিলো তুমুল জনপ্রিয়!শুধু তাই নয়, প্রিটি ওমেন’ সিনেমায় রিচার্ড গিয়ারের হাতে লম্বা একটি মোবাইল সেটের কথা আপনাদের হয়তো মনে আছে, সেটা ১৯৯০ সালের কথা। সারা পৃথিবীতেই সে ফোন দামি। শুধু ধনী ব্যক্তিদের হাতেই ফোনগুলো দেখা যেত।বাংলাদেশেও ছিল সেরকম দেখতে মোবাইল সেট। সে সময়কার বেশি দামের সেই মোবাইল সেট শুধু অতিধনী ব্যক্তিরাই কিনতে পারতেন, নাম ছিল ‘সিটিসেল’। জুম আল্ট্রা এর মতো ইন্টারনেট মডেম ও ছিলো সমসাময়িক সময়ের অন্যতম ফাস্টেস্ট মাধ্যম ও! ধারনা করা হয়, বন্ধ হওয়ার আগে আগে ২০১১ সালের দিকে ও সিটিসেল এর গ্রাহক ছিলো প্রায় ১২ লক্ষের ও বেশি! তবে এত জনপ্রিয়তার মাঝে হঠাৎ করে সিটিসেল হারিয়ে গেলো ক্যানো! এমন কি ই বা হলো যার জন্য পুরো কোম্পানি তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে ব্যাবসা বন্ধ করতে হয়েছিল! চলুন সে গল্প ই বলবো আপনাদেরকে বিজনেস ম্যানিয়ার আজকের ব্লগ পোস্টে।
সিটিসেলের উত্থান পর্ব
গোটা দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন তম মোবাইল অপারেটর দের একটি, সিটিসেল (Citycell), বাংলাদেশে সিটিসেল (Citycell) তার যাত্রা শুরু করে ১৯৮৯ সালে! এটি ছিলো তখন দেশের প্রথম সিডিএমএ (CDMA) মোবাইল অপারেটর! লাইসেন্স ও দিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ! তবে সিটিসেল (Citycell) এর ব্যাবহার ছিলো সেই সময়ে অত্যন্ত ব্যায়বহুল ও! ১৯৮৯ সালে সিটিসেল (Citycell) বিটিআরসি (BTRC) থেকে মোবাইল ফোন প্রবর্তনার জন্য বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (Bangladesh Telecom Limited) (বিটিএল) তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বরাদ্দ লাভ করে! লাইসেন্স নেওয়ার পরের বছর হংকং (Hong Kong) হাচিসন টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড (Hutchison Telecommunications Limited) উক্ত কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ও এর নাম বদলে হয় হাচসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড! তবে সেখানেই শেষ নয়! ১৯৯৩ সালে সিটিসেলের (Citycell) বর্তমান মালিক প্যাসিফিক মোটরস (Pacific Motors) ও ফার ইস্ট টেলিকম (Far East Telecom) ৫৫% শেয়ার কিনে নেয়। এর মধ্যে প্যাসিফিক মোটরসের (Pacific Motors) শেয়ারের পরিমাণ ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ আর ফারইস্ট টেলিকমের (Far East Telecom) ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ। বাকি ৪৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক সিঙ্গাপুরভিত্তিক টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সিংটেল (Singtel)! ততৎকালীন বিএনপি নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম. মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মটরস (Pacific Motors) ও ফারইস্ট টেলিকম (Far East Telecom) মিলে এইচবিটিএল-এর (HBTL) শেয়ার কিনে নেয়! কোম্পানির নাম বদলে হয় প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (Pacific Bangladesh Telecom Limited)! এবং সিমের ব্রান্ড নেম হিসাবে দেশব্যাপি পরিচিতি লাভ করে সিটিসেল (Citycell)! ২০০৪ সালে এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে সিঙ্গাপুরের সিংটেল (Singtel)! এভাবেই পথ চলা শুরু হয় সিটিসেল (Citycell) এর! চটকদার বিজ্ঞাপন, অফার সুবিধা এত কিছুর পরেও শুরুটা দারুন করলেও, সিটিসেল (Citycell) কিছুটা খেই হারায়! ২০০৭ সালের শেষের দিকে সিটিসেল (Citycell) নতুন লোগো উন্মোচন করে, এই লোগোই তাদের সর্বশেষ লোগো হিসাবে রক্ষিত ও ছিলো…
পতনের শুরু
২০০৮ নিবার্চন পরবর্তী সময়ে আওয়ামীলীগ (Awami League) ক্ষমতায় এসেই বিএনপি (BNP) নেতাদের দুনীতির অভিযোগে ধরপাকড় শুরু করে! সেই সাথে সাথে প্রভাব ও পড়ে ব্যাবসায়ীক প্রতিষ্ঠান গুলোতে! ২০১০ সালে সিটিসেল (Citycell) এর উর্ধতন পরিচালনা পর্ষদ এ আসে ব্যাপক রদবদল! সি ই ও (CEO) হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় মেহবুব চৌধুরী কে! ড্যাভিড লি (David Lee) কে করা হয়, সিওও (COO)! তবুও শেষ রক্ষা হয় নি! ২০১৬ সালে সরকার সিটিসেল (Citycell) বন্ধ করে দেয়! ২০১৬ সালের তিন নভেম্বর বিচারিক বিভাগ সিটিসেল (Citycell) এর কার্যক্রম খোলার অনুমতি দিলেও, ৬ নভেম্বর আবার বন্ধ করে দেয়! ২০২৩ সালে সিটিসেলের (Citycell) লাইসেন্স চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হয়! এভাবেই বন্ধ হয়ে যায় সিটিসেল (Citycell)!
তবে, এটা কি শুধুই রাজনৈতিক বলী, নাকি রয়েছে এর চাইতে ও বেশি কিছু! চলুন সেই রহস্য জানার চেস্টা করি! তুলে ধরি আরো কিছু তথ্য…
১১ ই সেপ্টেম্বর ২০২৪! দেশের প্রায় সব গুলো জাতীয় দৈনিক (national dailies) এর শিরোনাম, ব্যাবসায় ফিরতে চায় সিটিসেল (Citycell)…!
এটা দেখে নতুন করে এই প্রজন্মের কাছে কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়েছে সিটিসেল (Citycell)! তাই রহস্যের গভীরতা জানতে উৎসুক জনতা চোখ রাখছে নানা পোর্টালে, তো চলুন সহজ করি আপনাদের জন্য বিষয় টা..! সিটিসেলের (Citycell) মালিক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম (Pacific Bangladesh Telecom) গত ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) (BTRC) চিঠি পাঠিয়ে অপারেটিং ও রেডিও ইকুইপমেন্ট লাইসেন্স দুটি ফেরত চেয়েছে।
চিঠিতে কোম্পানিটি দাবি করেছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে প্রথমে তাদের তরঙ্গ স্থগিত করা হয়। এ জন্য সাবেক টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমকে দায়ী করেছেন তারা।
বিটিআরসিকে (BTRC) পাঠানো চিঠিতে প্যাসিফিক টেলিকম (Pacific Telecom) জানায়, তরঙ্গ বন্ধ করায় গত ৮ বছরে ব্যাংক ঋণ, কর্মচারীদের বকেয়া, অবকাঠামোর ক্ষতি– সবমিলিয়ে তাদের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ৮ বছর কার্যক্রম বন্ধ থাকায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় সম্ভব হয়নি। এতে সরকার প্রায় ৪৩০ কোটি টাকা কর ও ফি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তারা এখন লাইসেন্স বাতিলের জন্য জারি করা পত্রের প্রত্যাহার চায়। পাশাপাশি প্রযুক্তি নিরপেক্ষ লাইসেন্স চায়, যাতে ফাইভজি (5G) ও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তারা এজন্য অর্থ পরিশোধ করবে, তবে তা রাজস্ব আদায়ের পর!
তবে আসলেই কি রাজনৈতিক চক্রান্তে দেউলিয়া হয়েছিলো সিটিসেল (Citycell), না, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একটা ইস্যু হতে পারে, তবে ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে দেশের বর্তমান শীর্ষ অপারেটর গ্রামীণফোন (Grameenphone) লাইসেন্স নেওয়ার আগে সিটিসেল (Citycell) একচেটিয়া ব্যবসাই করছিল। সে সময়ে একটেল (Aktel, বর্তমানে রবি) ও সেবা (Sheba, বর্তমানে বাংলালিংক) লাইসেন্স নেয়। প্রতিযোগী আসার আগে সিটিসেল (Citycell) শুধু ঢাকা মহানগরীকেন্দ্রিক সেবা দিত। গুটি কয়েক মানুষের হাতেই ছিল মোবাইলের ব্যবহার। ২০১৩ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) (ADB) করা ‘গ্রামীণফোনের পারদর্শিতা মূল্যায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৬ সালে টেলিযোগাযোগ সেবার দিক দিয়ে বিশ্বে পিছিয়ে থাকায় বাংলাদেশ ছিল ১৩ নম্বরে। এশিয়ায় বাংলাদেশ ছিল পেছনের দিক দিয়ে ৩ নম্বর। তখন প্রতি ১০০ জন মানুষের বিপরীতে বাংলাদেশে টেলিফোন লাইন ছিল শূন্য দশমিক ৩টি। ৭০ শতাংশ টেলিফোন লাইন ছিল চট্টগ্রাম, ঢাকা ও খুলনায়। দেশের অন্য অঞ্চলে প্রতি এক হাজার মানুষের বিপরীতে ছিল মাত্র একটি ফোন। সে সময় সরকারি সংস্থা টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন বোর্ডের (টিঅ্যান্ডটি) (T&T) গ্রাহক ছিল সাড়ে তিন লাখের মতো। একমাত্র মোবাইল অপারেটর সিটিসেলের (Citycell) গ্রাহক ছিল প্রায় ২০ হাজার।
সবার আগে ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ গ্রামীণফোন (Grameenphone) তাদের সেবা চালু করে। বিশেষ করে তাদের পল্লীফোন (Polli Phone) সেবা দেশের মোবাইল জগতে আমূল পরিবর্তন আনে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের দ্বারে পৌঁছে যায় মোবাইল–সেবা। বাজারের অন্য প্রতিযোগীরা নিজেদের নেটওয়ার্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। দেখাদেখি সিটিসেলও (Citycell) সে পথে হাঁটে। দেশে ইন্টারনেট–সেবা মানুষের নাগালে আসার সময়ে সিটিসেলের (Citycell) জুম ইন্টারনেট (Zoom Internet)–সেবা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সিটিসেল (Citycell) ছিল অ্যানালগ এবং অন্যরা ডিজিটাল প্রযুক্তির। তাই সিটিসেলের সেবার মান ভালো ছিল না। তাই তারা সিডিএমএ (CDMA: Code Division Multiple Access) প্রযুক্তি নিয়ে আসে। এই প্রযুক্তি আবার যেকোনো মুঠোফোনে ব্যবহার করা যায় না। অর্থাৎ সিটিসেল (Citycell) গ্রাহকদের মোবাইলসহ সিম কিনতে হতো। কিন্তু পুরো বিশ্ব তখন সিডিএমএ (CDMA) থেকে জিএসএম (GSM: Global System for Mobiles) প্রযুক্তিতে ধাবিত হতে থাকে। এ ধরনের প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে যেকোনো মুঠোফোনেই ব্যবহার করা যায়। বিশ্বের মুঠোফোনসেবা এখন জিএসএম (GSM) প্রযুক্তিতেই চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে সিটিসেল (Citycell) সেই সিডিএমএতেই পড়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে সিটিসেল (Citycell) আসলে টিকে থাকতে পারেনি তাদের মার্কেটে!
মূলত ব্যবসায়িক অদূরদর্শিতা, রাজনৈতিক হাত বদল, এবং বৈরী মনোভাব—সব কিছুই সিটিসেল (Citycell) কে বিলুপ্ত হতে বাধ্য করে! এনালগ (Analog) থেকে ডিজিটাল (Digital) যুগের প্রতিযোগিতায় গ্রামীণফোন (GP), রবি (Robi), কিংবা বাংলালিংক (Banglalink) এর কাছে হার মেনে নেয় সিটিসেল (Citycell)। তাই যতই রাজনৈতিক বা অন্যান্য বিষয় সামনে আসুক, কোটি কোটি টাকা ঋণ বা দেউলিয়া হওয়ার পেছনে মূলত অবহেলা ও চিন্তার অভাবই সিটিসেলের বিলুপ্তির প্রধান কারণ!
তবে, এই সিটিসেলের (Citycell) সাথে ছোটবেলার এক ধরনের আবেগ জড়িয়ে আছে আমাদের প্রজন্মের! তাই সিটিসেলের (Citycell) প্রত্যাবর্তন হলে আমাদের ছোটবেলার স্মৃতিগুলোও যেন আবার ফিরে আসবে…!
জন সচেতনতার জন্য ব্লগটি শেয়ার করুন আপনার পরিজনের সাথে। ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে মন্তব্য জানান কমেন্ট বক্সে, পরবর্তি ব্লগ পড়তে বিজনেস ম্যানিয়ার নিউজলেটারটি সাবসস্ক্রাইব করুন।