Huawei কে কেন নিষিদ্ধ করেছে Google? Is Huawei Controlled BY China Government ?
সাল ১৯৮৭। সে সময়কার চীন(China) কেবলমাত্র একটা অর্থনৈত্যিক মন্দা(Economic recession) কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। সে সময় চীনের প্রায় ১ বিলিয়ন মানুষের জন্য দরকার ছিল প্রায় ২ লক্ষ মোবাইল নেটওয়ার্কের। কিন্তু সে সময় চীনের বাজারে বাইরের অল্প কিছু কোম্পানি ছাড়া আর কোন কোম্পানিই ছিল না। আর এই সুযোগটিকেই কাজে লাগায় রেন জেনফির নামের এক ব্যাক্তি।
তিনি ১৯৮৭ সালের দিকে চীনের ছোট একটা গ্রাম সেনজেনে মাত্র ৫ হাজার ডলার দিয়ে একটি কোম্পানি খুলে বসেন। যদিও প্রথম দিকে কোম্পানি তাদের সব কাচামাল হংকং থেকে নিয়ে আসতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এসে তারা তাদের কাচামাল নিজেরাই বানাতে শুরু করে।
কথা বলছি চীনের সর্ব বৃহৎ মোবাইল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে(Huawei) এর । হুয়াওয়ে এর নাম শুনলেই কিন্তু সবার মাথায় প্রথমে আসে একটা স্মার্টফোন তৈরী কারি প্রতিষ্ঠানের নাম। এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে প্রস্তুত করে ফেলে প্রায় ১১৮ মিলিয়ন এরো বেশি স্মার্টফোন। যা সে সময় ছিল একটি বিশ্ব রেকর্ড(world record)। কিন্তু একই বছরের শেষের দিকে এসে আমেরিকা ও ভারত সহ বেশ কিছু দেশ হুয়াওয়েকে ব্যান করে ।
কিন্তু কি এমন অভিযোগ ছিল যার জন্য চীনের এই কোম্পানিটির বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল? যার পুরোটাই আমরা জানবো আজকের ব্লগে।
রেন জেনফির যখন তার বিজনেস শুরু করে সে সময়টাতে চীন কেবল মাত্র নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা শুরু করেছে। ফলে কোম্পানিটি একদম শুরু থেকেই চীনের সরকারের সুনজরে পরে। এর ফলে কোম্পানিটি বেশ বড় বড় কিছু সুবিধা পায়। এর মধ্যে ছিল সরকার থেকে পাওয়া বিশাল অংকের ভুর্তকি, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে ট্যাক্স এও ছাড় পায় এই প্রতিষ্ঠানটি।
এতে করে একদম শুরু থেকে হুয়াওয়ে তাদের বিজনেস প্রসার এর দিকে বেশ ভালোভাবে নজর দিতে পেরেছিল। এ কারণে যেই প্রতিষ্ঠানটি শুরুর দিকে হংকং থেকে কাচামাল আমদানি করতো। তারাই ১৯৯৬ সালের মধ্যেই হংকং(Hong Kong)এ ওই পণ্যের কাচামালগুলো রপ্তানি করা শুরু করে।
প্রিয় দর্শক ৯০ এর দশকের শেষের দিকে এসে যখন সারা বিশ্বে জিএসএম(GSM) সিমের প্রচলন শুরু হয় ঠিক তখনই ১৯৯৬ সালে হুয়াওয়ে তাদের প্রথম জিএসএম সিম বাজারে আনে।
এরপর ২০০৪ সালে হুয়াওয়ে তাদের প্রথম হেন্ডসেটটি বাজারে আনে। একই সাথে এই হেন্ডসেটটি যেমন ছিল বাজারে অন্যান্য হেন্ডসেটটি গুলোর থেকে প্রজুক্তিগত ভাবে ঊন্নত তেমনি মানেও ছিল বেশ ভালো। ফলে বাজারে আসার কিছু দিনের মধ্যেই এই হেন্ডসেটটি চীনের মোবাইল বাজারের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে নেয় । সেই সাথে তো চীনের সরকারের সহায়তা তো ছিলই।
ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হুয়াওয়ে ইউরোপে(Europe) ও তাদের হেন্ডসেটটি লঞ্চ করে , আর বর্তমানে স্মার্টফোন প্রস্তুত ও সেলের দিকে দিয়ে হুয়াওয়ে রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে । আর এক নাম্বার পজিশনে রয়েছে স্যামসাং(Samsung)।
বর্তমানে চীনের মোবাইল মার্কেটের ৪৮ শতাংশ রয়েছে হুয়াওয়ে এর দখলে। ২০২০ এর একটি পরিসংখ্যান মতে চীনের হুয়াওয়ে মোট মোবাইল ফোন মার্কেটের দখল করে আছে প্রায় ১৯ শতাংশ,যেখানে আমাদের পরিচিত অ্যাপেল(Apple) ১১ শতাংশ ও স্যামসাং ২৩ শতাংশ দখল করে রয়েছে প্রথম অবস্থানে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশে রয়েছে হুয়াওয়ে এর কাস্টমার(customer)। এর মধ্যে শুধু চীনেই রয়েছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন।
শুধু তাই নয় বর্তমানে টেলিকমিউনিকেশনের(telecommunication) যন্ত্রাংশ তৈরীতেও হুয়াওয়ে রয়েছে এক নাম্বারে। এই মার্কেট এর তিন ভাগের এক ভাগ বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটির দখলে।
এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফাইভ জি(5G) নেটওয়ার্কে স্থাপনের কাজ ও করে থাকে হুয়াওয়ে। এর মধ্যে কেবল ২০১৯ সালেই ৫০টির বেশি দেশে হুয়াওয়ে ফাইভ জি স্থাপনের কাজ পায়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও(Bangladesh) ফাইভ জি স্থাপনের কাজ পেয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
সবকিছু মিলিয়ে ২০২৩ সালের হিসেবে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির মোট আয় প্রায় ৭০৪ বিলিয়ন ডলার। এছাড়াও কেবল চীনের অন্যতম ব্যাস্ত শহর গুয়াংডং(Guangdon) এই হুয়াওয়ে এর রয়েছে প্রায় ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন স্কয়ার ব্যাপী বিস্তত বিশাল এক ক্যাম্পাস। যাতে কাজ করে প্রায় ২৫ হাজার জন কর্মী। এই ক্যাম্পাসটির সাইজ এতই বিশাল যে কর্মীদের চলাচলের জন্য ক্যাম্পাসের ভিতরেই রয়েছে আলাদা একটা রেল যোগাযোগ ব্যাবস্থা।
তবে এত কিছুর পরো ২০১৯ সালে হুয়াওয়েকে আমেরিকাসহ(America) বিশ্বের বেশ কিছু দেশ ব্যান(Ban) করে দেয়। কিন্তু কেন? এখানেই আসে হুয়াওয়ে এর অন্ধকার দিক।
সাল ২০১৮ হুয়াওয়ে এর সে সময়কার সিএফও মেঞ্জ ওয়ামজুকে কানাডা থেকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগ আনা হয় ডলার পাচারের। আর তার কিছুদিনের মাথায় আমেরিকার সে সময়কার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তথ্য পাচারসহ আরো বেশ কিছু অভিযোগ এনে হুয়াওয়ে্র সকল কার্যক্রম আমেরিকা থেকে স্তগিত করে দেন।
প্রিয় দর্শক আমেরিকা হুয়াওয়ে এর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে এসে অভিযোগ জানালেও সব কিছুর শুরু হয় কিন্তু আরো বেশ আগে। আমাদের দেশে একটি কথা বেশ প্রচলিত আছে আর সেটা হলো চায়নারা যেকোন জিনিসের নকল খুব সহজেই তৈরী করতে পারে। চায়নাদের এই নকল জিনিস বানানোর যাত্রা কিন্তু শুরু হয় মূলত এই হুয়াওয়ে এর হাত ধরেই।
তখন চলছিল ২০০৩ সাল। সে সময় গোটা বিশ্বে cisco এর ইলেক্ট্রনিক প্রডাক্টগুলো বেশ জনপ্রিয় ছিল। সেই সাথে তার চিপগুলো ও ছিল বেশ এডভান্স। ওই সময় অন্যান্য দেশের মতো চীনেও cisco এর ঐ সব প্রডাক্টগুলো আমদানি করা হতো। এরই সুযোগ নেয় হুয়াওয়ে। তারা cisco থেকে প্রডাক্ট নিয়ে সেগুলোর রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারং(reverse engineering) করে সেগুলোর সস্তা কপি(copy) বানাতে থাকে।
cisco এ ব্যাপারে চীনের সরকারের অভিযোগ করলেও চীনা সরকার এই অভিযোগকে ইচ্ছা করেই কোন আমলে নেয় নি। কারন এই পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছিল খোদ চীনা সরকারের পরক্ষ মদদে। ফলে ১৯৯৭ থেকে ২০১২ মাত্র এই কয়েক বছরে হুয়াওয়ে তাদের প্রডাক্ট দিয়ে গোটা চীনের বাজারকে দখল করে নেয়।
আর তাই চীনা সরকার cisco এর কোন অভিযোগ তো কোন আমলে নেয় নি! উলটো নেগেটিভ মার্কেটিং(negative marketing) করে সিস্কোকেই চীনের বাজার থেকে ব্যান করে দেয়।
প্রিয় দর্শক, আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো চীনের ডিজিটাল সিল্ক রোড (Digital Silk Road) প্রজেক্টের ব্যাপারে জানি। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে চীন আসলে চায় ২০৪৫ সালের মধ্যে নিজেদের ডিজিটাল দুনিয়ার গ্লোবাল পাওয়ার হিসেবে তৈরী করতে। আর ডিজিটাল দুনিয়াতে সবথেকে মূল্যবান জিনিসটি হলো তথ্য(Information)। যেই দেশের কাছে যতবেশি তথ্য সেই দেশে ততবেশি এগিয়ে। আর সেটা যদি হয় প্রতিপক্ষ কোন দেশের ব্যাপারে তাহলে তো কথায় নেই। আর তাই চীন এই তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার করেছে হুয়াওয়ে কে ।
আমরা সকলেই জানি যে হুয়াওয়ে তূলনামূলক কম দামে বেশ ভালো মানের স্মার্টফোন(smartphone) সরবরাহ করে থাকে। আর এই পুরোটাই হুয়াওয়ে করে কাস্টমারদের অ্যাট্রাক করার জন্য। কেননা একজন মানুষ যতই ধনী হোক না কেন প্রায় সবাই ই অফার(offer) বা ডিসকাউন্টে(discount) প্রডাক্ট কিনতে পছন্দ করি।
আর স্মার্টফোনের বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে কিন্তু খুব সহজেই মানুষের ব্যাপারে খুটি নাটি সব তথ্যই হাতিয়ে নেওয়া যায়। আর এই কাজটিই করে আসছিল হুয়াওয়ে। যেকারণে হুয়াওয়ে সহ বেশ কিছু চাইনিজ অ্যাপ(App) ব্যান করে দেয় আমেরিকা ভারত সহ বেশ কিছু দেশ। এর মধ্যে যেমন ছিল জনপ্রিয় গেম পাবজি(PUBG) তেমনি ছিল বর্তমানের বেশ সমালোচিত অ্যাপ টিকিটক(Tik Tok) ও।
আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে এত বড় কোম্পানি হওয়া সত্বেও হুয়াওয়ে এর সিইও কেনই বা চীনা সরকারকে এত বেশি সাহায্য করে থাকে। এখানেই রয়েছে মজার একটা বিষয় । হুয়াওয়ে এর মোট শেয়ার এর মাত্র ১ .১৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক হলো হুয়াওয়ে এর সিইও(CEO)। আর বাকিটা পুরোটার মালিক হলো সেখানে কাজ করা কর্মীরা।
মূলত কাজে আগ্রহ বাড়ানোর জন্য বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদের বেশ কিছু শেয়ার দিয়ে থাকে। হুয়াওয়ে ও অন্য সকল বড় বড় কোম্পানির মতো তাদের কর্মীদের শেয়ার দিয়ে থাকে। কিন্তু সেই সাথে দিয়ে থাকে বেশ কিছু শর্ত। সেই শর্ত অনুযায়ি কর্মীরা চাইলেই তাদের ভাগের শেয়ারটুকু বিক্রি করতে পারবে না। একাজে তাদের অনুমতি লাগবে কর্মী ইউনিয়নের। আর চীনের সকল কর্মী ইউনিয়নকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে চীনের সেন্ট্রাল ওয়ার্কার ইউনিয়ন। যা মূলত চীনের সরকারেরই(Govt.) প্রতিষ্টান।
এভাবে চীনের সরকার শুধু হুয়াওয়ে কেই না, চীনের অন্য সকল বড় বড় কোম্পানিকেও নিয়ন্ত্রন করে থাকে। আর একারণে না চাইতেও হুয়াওয়েকে চীনের সরকারের সাথে মিলে কাজ করতে হয়। যা বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ইমেজে বেশ ক্ষতি করেছে। যা কাটিয়ে ঊঠতে কি ভবিষ্যৎ এ পদক্ষেপ নেয় তা দেখার অপেক্ষা করতে হবে আমাদের ।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। সত্য আর ন্যায়ের পথে থাকুন । পরবর্তি ব্লগ পড়ার আমন্ত্রন রইল।।