তেল থেকে স্টিল – বাজার ধ্বংস, না ব্যবসার দক্ষতা ? | TK Group | Business Mania
বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্য, স্টিল, সিমেন্ট, ও ভোজ্যতেল মার্কেটে কিছু নাম সর্বদাই আলোচনায় থাকে, যেমন সিটি গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, এফএমসিজি জায়ান্ট ACI ইত্যাদি কিন্তু মার্কেটে আরেকটি নাম চুপচাপ তার দাপট দেখিয়ে যাচ্ছে, হয়তো অনেকের চোখের আড়ালেই। TK Group of Industries, একটি ব্যবসায়ী সাম্রাজ্য, ১৯৭০ সালের পর থেকে বাংলাদেশি বাজারের এক বিশাল শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
তেল থেকে শুরু করে প্লাস্টিক, স্টিল থেকে ফুড প্রোডাক্ট, TK Group-এর বিস্তৃতি এতটাই বড় যে, আমরা প্রতিদিন এদের কোনো না কোনো পণ্য ব্যবহার করছি, অথচ অনেকেই তা জানি না! কিন্তু কীভাবে এই গ্রুপ এত বিশাল হলো? কী ছিল তাদের শুরুর গল্প? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কৌশলই বা আসলে কেমন?
অনেকেই বলে, TK Group শুধু দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্যই বড় হয়নি, বরং কিছু স্ট্র্যাটেজিক (Strategic) সিদ্ধান্ত, সরকারি সংযোগ ও নির্দিষ্ট মার্কেটে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করেছে। তাহলে, এটা কি নিছকই এক সফল ব্যবসার গল্প, নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে কিছু অজানা দিক?
তাই business Maniar আজকের আলোচনায় থাকছে TK Group-এর উত্থান, ব্যবসায়িক প্রভাব, ভবিষ্যত ইত্যাদি বিষয়গুলো। তাহলে, চলুন শুরু করা যাক!
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই চট্টগ্রামের দুই ভাই, মোহাম্মদ আবু তৈয়ব এবং মোহাম্মদ আবুল কালাম, তাদের পিতা মীর আহমেদ সওদাগরের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু করেন। তাদের পিতার মৃত্যুর পরও তারা তার প্রতিষ্ঠিত ট্রেডিং ব্যবসা চালিয়ে যান এবং নতুন ব্যবসায়িক সুযোগের সন্ধানে ছিলেন। এই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ, তারা প্রতিষ্ঠা করেন টি.কে. গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, যা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ কনগ্লোমারেট (Conglomerate)।
প্রথমদিকে, টি.কে. গ্রুপ পণ্য বাণিজ্যের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। সময়ের সাথে সাথে, তাদের উদ্যোক্তামূলক মানসিকতা এবং ব্যবসায়িক দক্ষতার মাধ্যমে তারা ভোজ্য তেল, স্টিল, বোর্ড, কাগজ, টেক্সটাইল, প্যাকেজিং, চা চাষ, জাহাজ নির্মাণ, ভোক্তা পণ্য, ট্রেডিং (Trading), শেয়ার (Share) এবং সিকিউরিটিজসহ বিভিন্ন খাতে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করে।
টি.কে. গ্রুপের ভোজ্য তেল ব্যবসা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের বিভিন্ন ব্র্যান্ড, যেমন “পুষ্টি”, “হিলশা”, “রান্না” ইত্যাদি, বাংলাদেশের বাজারে সুপরিচিত এবং জনপ্রিয়। এছাড়া, তারা স্টিল এবং বোর্ড উৎপাদনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
সময়ের সাথে সাথে, টি.কে. গ্রুপ তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রবেশ করেছে। তাদের পণ্যসমূহ এখন বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বর্তমানে, টি.কে. গ্রুপের অধীনে প্রায় ৫০,০০০ কর্মী কাজ করছে, যা দেশের কর্মসংস্থানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
টি.কে. গ্রুপের এই সফলতার পেছনে তাদের নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, কর্মীদের কঠোর পরিশ্রম এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা মূল ভূমিকা পালন করেছে। তাদের এই যাত্রা বাংলাদেশের ব্যবসায়িক ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এই শিল্পগোষ্ঠী টি.কে. গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ তাদের বহুমুখী ব্যবসায়িক কার্যক্রম এবং দৃঢ় নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
টি.কে. গ্রুপের সাফল্যের পেছনে তাদের দক্ষ এবং অভিজ্ঞ পরিচালনা পর্ষদের ভূমিকা অপরিসীম। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের নেতৃত্বে রয়েছেন চেয়ারম্যান মিসেস লায়লা বিলকিস এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম। মিসেস লায়লা বিলকিস একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তা, যিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শিল্পায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। অন্যদিকে, মোহাম্মদ আবুল কালাম একজন খ্যাতিমান শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং সমাজসেবক, যিনি চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং দেশের শিল্প খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
পরিচালনা পর্ষদের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন গ্রুপ পরিচালক মোহাম্মদ মুস্তাফা হায়দার, পরিচালক হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা, খালেদা বেগম, ফারজানা আফরোজ, তালহা বিন তায়েব এবং আবু সাদাত মোহাম্মদ ফয়সাল। তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সেক্টরে নেতৃত্ব প্রদান করছেন।
এই দক্ষ পরিচালনা পর্ষদের নেতৃত্বে, টি.কে. গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ দেশের শিল্প খাতে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে ।
সম্প্রতি, প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ এবং ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
টি.কে. গ্রুপ তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে, প্রতিষ্ঠানটি শিপিং খাতে বিনিয়োগ করে তাদের নিজস্ব ভোজ্য তেল আমদানির জন্য জাহাজ ক্রয় করে। ২০২৪ সালে, তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সামুদা শিপিং লিমিটেডের মাধ্যমে এমটি সামুদা নামক একটি জাহাজ ক্রয় করা হয়, যার ধারণক্ষমতা ২৪,০২৫ টন তেল পরিবহনের। এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি বার্ষিক প্রায় ৩২ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তাদের লক্ষ্য ২০২৬ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বাজারমূল্য ৫ বিলিয়ন হংকং ডলার এবং গ্রুপ বিক্রয় ৫ বিলিয়ন হংকং ডলারে উন্নীত করা। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যমান ইনজেকশন মোল্ডিং এবং মোল্ড ব্যবসায় বার্ষিক ১৫% জৈবিক বৃদ্ধি বজায় রাখতে চায়। তারা মেডিকেল ডিভাইস, ব্যক্তিগত যত্ন পণ্য এবং প্যাকেজিং পণ্যসহ বিভিন্ন খাতে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে।
টি.কে. গ্রুপের এই উদ্যোগগুলো দেশের অর্থনীতিতে বহুমুখী প্রভাব ফেলবে। শিপিং খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব পণ্য পরিবহনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে, যা বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় এবং আমদানি খরচ হ্রাসে সহায়তা করবে। এছাড়া, নতুন শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং দেশের শিল্প খাতের উন্নয়নে অবদান রাখবে।
সার্বিকভাবে, টি.কে. গ্রুপের এই উদ্যোগগুলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
টি.কে. গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী, যা কয়েক দশকের পরিশ্রম আর কৌশলগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে। ভোজ্য তেল থেকে ইস্পাত, কাগজ, টেক্সটাইল, প্যাকেজিং প্রায় সবখানেই তাদের আধিপত্য। তবে এই সফলতার পাশাপাশি ছিল কিছু বিতর্ক এবং সমালোচনাও।
TK Group-এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
২০২৬ সালের মধ্যে TK Group-এর লক্ষ্য তাদের বাজারমূল্য ৫ বিলিয়ন হংকং ডলার-এ উন্নীত করা এবং বছরে ৫ বিলিয়ন হংকং ডলার পর্যন্ত বিক্রি করা।
তারা পরিকল্পনা করছে—
🚢 শিপিং খাতে আরও বড় বিনিয়োগ – সম্প্রতি তারা MT Samuda নামের ২৪,০২৫ টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ কিনেছে, যা বছরে ৩২ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে।
🏭 নতুন শিল্প স্থাপন – প্যাকেজিং, মেডিকেল ডিভাইস, এবং ব্যাক্তিগত যত্ন পণ্যসহ আরও নতুন খাতে প্রবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
📈 বাজার সম্প্রসারণ – দেশীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানির পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।
এক নজরে যদি বলি,
ভবিষ্যত পরিকল্পনায়, হ্যাঁ বিশাল ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, এবং শিল্প খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান।
সাফল্য গুলো হবে, ৫০,০০০+ কর্মী, বার্ষিক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা, এবং দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
আর চ্যালেঞ্জ গুলো ছিল পরিবেশগত বিতর্ক, বাজারে অনিয়মের অভিযোগ, এবং কিছু ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব।
আর এর প্রেক্ষিতে, টি.কে. গ্রুপের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের কৌশলগত পরিকল্পনা, বাজার পরিস্থিতি, এবং নৈতিক ব্যবসা পরিচালনার ওপর। যদি তারা আন্তর্জাতিকভাবে সফলভাবে বিস্তৃত হতে পারে এবং বিতর্ক এড়িয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালিত হয়, তবে ভবিষ্যতে আরও বড় উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবে।
আপনার মতে, টি.কে. গ্রুপ বাংলাদেশের শিল্প খাতে ইতিবাচক অবদান রাখছে, নাকি তাদের আরও স্বচ্ছতা দরকার? কমেন্টে জানাবেন আপনার মতামত!