অপমানের জবাবে Lamborghini সৃষ্টি হল যেভাবে | Lamborghini Story Bangla
একটা সময় ছিল যখন সমাজে কে বেশী ধনী এটা দেখা হতো কার কতগুলো হাতি আছে কিংবা কার কতগুলো ঘোড়া আছে তার মাধ্যমে। কিন্তু এখন সেই যুগ পাল্টিয়েছে। এখন কোন ব্যাক্তি কতটা ধনী তার মাপ কাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কার কাছে আসলে ঠিক কত দামী আর কত নতুন ডিজাইনের গাড়ি(car) রয়েছে সেটা। এই যেমন বর্তমানে আভিজাত্য আর সৌখিনতার অন্যতম মাপ কাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে ল্যাম্বরগিনি(Lamborghini) ব্রান্ডের বিভিন্ন সিরিজের গাড়িগুলো।
ল্যাম্বরগিনি সম্পর্কে একটি বেশ মজার কথা প্রচলিত আছে, তা হলো আপনি কখনোই টিভিতে ল্যাম্বরগিনি এর কোন গাড়ির বিজ্ঞাপন দেখেননি আর দেখবেন ও না। এর কারণ হিসেবে বলা হয় যে, যেই মানুষগুলো ল্যাম্বরগিনি ব্রান্ডের বিভিন্ন সিরিজের গাড়িগুলো কেনার সামর্থ্য আছে বা কিনবে তাদের টেলিভিশন দেখার সময় নেই ।
যেখানে নামি দামি অনেক ব্রান্ডের স্পোর্টস কারের দাম শুরু হয়ে ১ কিংবা ২ মিলিয়ন ডলার থেকে সেখানে ল্যাম্বরগিনি এর স্পোর্টসকারগুলোর প্রাইস শু্রুই হয় ৪ মিলিয়ন ডলারের উপর থেকে। শুধু তাই নয় এসইউভি সিরিজের ল্যাম্বরগিনি উরুসের(Urus) প্রাইস ই ধরা হয় প্রায় ২ লক্ষ ডলার থেকে। তবে এখন অব্দি ল্যাম্বরগিনি তাদের সবথেকে বেশি দামে যেই গাড়িটি বিক্রি করেছে সেটা হলো ল্যাম্বরগিনি এভেন্টাডোর সিরিজের একটা গাড়ি। সুইজারল্যান্ডের একটি নিলাম অনুষ্ঠানে এই গাড়িটি বিক্রি করা হয় প্রায় সাড়ে আট মিলিয়ন ডলার দিয়ে!
চলুন , আজকের বিজনেস ম্যানিয়ার নতুন ব্লগে আমরা জানবো যে এই বিলাসবহুল ল্যাম্বরগিনি ব্রান্ডের ইতিহাস , সেই সাথে জানব ল্যাম্বরগিনি ব্রান্ডের এই গাড়িগুলো কেন এত বেশি দামী হয়ে থাকে সেটাও।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ যখন শুরু হলে হাজারো মানুষের সাথে ফেরুসে(Ferruccio) ল্যাম্বরগিনি নামের এক সাধারন গাড়ি মেকানিককে ও পাঠানো হয় রোডস নামের একটা নির্জন দ্বীপে। রোডস দ্বীপটা ছিল মোটামুটি শান্ত একটি দ্বীপ আর যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। সেখানে ফেরুসের কাজ ছিল যুদ্ধে ধবংসপ্রাপ্ত হয়ে আসা বিভিন্ন গাড়ি ,সাজোয়ান ট্যাংক মেরামত করা এবং পার্টসগুলো খুলে নতুন পার্টস এসবে যুক্ত করা। এগুলোতে ফেরুসে আগে থেকেই বেশ দক্ষ হয়ে থাকলেও যুদ্ধের পুরো সময়টাতে পুরাতন গাড়ির যন্ত্রাংশ নিয়ে কাজ করতে করতে সে আরো বেশি দক্ষ হয়ে ওঠে। এমনকি কিছু দিনের মধ্যে সে সেখানকার সেরা মেকানিক ও হয়ে উঠে। আর গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নিয়ে ফেরুসি এর জানাশোনাও বেশ বেড়ে যায়। তখনো যুদ্ধ শেষ হয় নি এরই মধ্যে ফেরুসি একটা ট্রাক্টর বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু যুদ্ধের ও নানা জটিলতায় সেটা ফেরুসির পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠে না।
এরপর যুদ্ধ শেষ হলে ফেরুসি তার দেশ ইতালিতে চলে আসে। আর নিজের নামের শেষাংশ ল্যাম্বরগিনি নাম দিয়ে একটি কোম্পানি খুলে বসে। এই কোম্পানির কাজ ছিল বিভিন্ন ধরনের ট্রাক্টর তৈরী করে সেগুলো বাজারে ছাড়া। জি আপনার শুনতে অবাক লাগলেও আমাদের সকলের বেশ পরিচিত ল্যাম্বরগিনি এর যাত্রা কিন্তু শুরু হয়েছিল কিন্তু এই ট্রাক্টর তৈরি এর হাত দিয়ে।
এভাবে চলে যায় বেশ কয়েকটি বছর, ফেরুসি এর ট্রাক্টরগুলোর বাজারে বেশ ভালো করতে থাকে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই কোম্পানিটি বেশ উন্নতি করে। এদিকে ফেরুসি ও ছিল বেশ সৌখিন একজন মানুষ। নিজের সখ পুরন করার জন্য সেই সময়ে সে নিজের জন্য একটি স্পোর্টস কার কিনে ফেলে। কারটি ছিল তখনকার দিনে সব থেকে জনপ্রিয় স্পোর্টস কার ব্রান্ড ফেরারি(Ferrari) এর ২৫০ জিটি সিরিজের একটা গাড়ি। বলে রাখা ভালো এই ফেরারির সবথেকে বড় প্রতিপক্ষএখন কিন্তু এই ফেরুসির এর তৈরি করা ল্যাম্বরগিনিই। অথচ সে সময়টাতে ফেরুসি এর স্পোর্টস কার এর জগতে আসার কোন ইচ্ছেই ছিল না।
নিজের পায়ে কুড়াল মারা বলে একটা কথা আছে ,আর ফেরারির সাথে ঠিক সেটি ঘটেছিল । তাদের একটা ভুলের জন্য তারা নিজেরাই নিজেদের শক্ত প্রতিপক্ষ তৈরী করে ফেলে। কিন্তু কীভাবে আর এমন কিই বা ঘটলো যার জন্য একটা ট্রাক্টর তৈরী কারী প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠলো অন্যতম সেরা একটা স্পোর্টস কার ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠান।
আগেই আমরা যেনেছি যে ফেরুসি ফেরারি এর স্পোর্টস কার ব্যবহার করতো। কিন্তু একদিন তার এই শখের গাড়িটি নষ্ট হয়ে গেলে তা ঠিক করার জন্য ফেরারীর এর সার্ভিস সেন্টারে নিয়ে আসে। কিছু দিন পর গাড়িটি ঠিকঠাক করে ফেরুসির কাছে পাঠিয়েও দেওয়া হয়। কিন্তু ফেরুসি খেয়াল করে যে, গাড়িগুলোর যেই যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করা হয়েছে তার থেকে ভালো মানের যন্ত্রাংশ সে নিজ ফ্যাক্টোরিতে বানাতে পারবে। এমনকি আরো কম খরচে! এই ব্যাপারটা নিয়ে ফেরুসি যায় ফেরারি এর অফিসে সেখানকার কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলতে। কিন্তু এখানেই ফেরারি একটা বেশ বড় ভুল করে বসে। তারা ফেরুসির কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা না শুনে উলটো তাকে এটা বলে অপমান করে বসে যে, একটা ট্রাক্টর মেকানিক একটা স্পোর্টস কার এর কি বুঝবে।
ব্যাস এই অপমানটা বেশ গায়ে লাগে ফেরুসির। তিনি বাসার ফিরে স্পোর্টস কার(sports car) বানানোর জেদ নিয়ে নেন। যেহেতু আগে থেকেই ফেরুসির গাড়ি আর গাড়ির যন্ত্রাংশ নিয়ে বেশ ভালো একটা আইডিয়া ছিল। যার ফলে স্পোর্টস কার তৈরী করতে ফেরুসিকে অতটা বেগ পেতে হয়নি।
এই ঘটনার মাত্র ৫ মাসের মাথায় ১৯৬৩ সালের ৩০ অক্টোবর ফেরুসি তাদের ল্যাম্বরগিনি এর প্রথম স্পোর্টস কার ল্যাম্বরগিনি ৩৫০ জিটি এই মডেলের গাড়িটি বাজারে আনে । তবে এই গাড়িটি নিয়ে ফেরুসি অতোটাও সন্তুষ্ট ছিল না। তাই সে পরের বছর ১৯৬৪ সালে ল্যাম্বরগিনি ৫৫০ জিটি মডেলের গাড়িটি লঞ্চ করে। এই মডেলের গাড়িটি কাস্টোমাররা বেশ পছন্দ করে। ফলে কয়েকদিনের মাথায় ল্যাম্বরগিনি এই মডেলের গাড়ির প্রায় ১৩টি অর্ডার পায়।
এরপর থেকে ল্যাম্বরগিনিকে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয় নি। এরপর থেকে প্রতি বছরই ল্যাম্বরগিনি কোন না কোন মডেলের গাড়ি মার্কেটে আনতে থাকে। তবে ল্যাম্বরগিনি এর ভাগ্যের চাকা সম্পূর্ন ঘুরে যায় এই বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে। জার্মানির ভোক্সওয়াগন (Volkswagen) গ্রুপ তাদের অডি ব্রান্ডের অধীনে ল্যাম্বরগিনি ব্রান্ডকে একুইজেশন করে নেয়। তারপর থেকেই ল্যাম্বরগিনির এর চাকা ঘুরছে পুরো দমে।
কিন্তু অন্যান্য স্পোর্টস কারের প্রাইস যেখানে বেশ কম সেখানে ল্যাম্বরগিনি এর স্পোর্টস কারগুলোর প্রাইস এত বেশী কেন?
এর পেছনেও কিন্তু রয়েছে বেশ কয়েকটি কারন।
ল্যাম্বরগিনি অন্যান্য স্পোর্টস কার কোম্পানিগুলোর মতো কিন্তু কখনই ম্যাস প্রডাকশন করে না । এইতো, ২০২২ সালেও এসেও পুরো বছর জুড়ে ল্যাম্বরগিনি তৈরী করেছে প্রায় ৯ হাজার ২৩৩টির মতো গাড়ি, এরমধ্যে আবার স্পোর্টস কারের সংখ্যা আরো কম , মাত্র সাড়ে তিন হাজারটি গাড়ি।
অন্যদিকে যেখানে আরেক স্পোর্টস কার কোম্পানি পর্শে(Porsche) একই বছরে বাজারে ছেড়েছে প্রায় ৩ লক্ষ ১০ হাজার ইউনিট গাড়ি এরমধ্যে আবার পর্শের সবথেকে জনপ্রিয় মডেল পর্শে ৯১১ এরই গাড়ির সংখ্যা ছিল প্রায় আশি হাজার। আর ফেরারি যেখানে বাজারে এনেছে প্রায় ১১ হাজার গাড়ি।
এত অল্প পরিমানে গাড়ি বাজারে ছাড়ায় স্বাভাবিক ভাবেই ল্যাম্বরগিনির এই প্রাইস তূলনামুলকভাবে অন্য ব্রান্ডের গাড়িগুলোর থেকে এত বেশি, শুধু তাই নয় ল্যাম্বরগিনি তাদের মাত্র ২টি কারখানা এই গাড়িগুলো ম্যানুফেকচার করে থাকে।
এছাড়াও প্রায় প্রতি দু থেকে তিন বছর পর পর ল্যাম্বরগিনি লিমিটেড এডিশনের বেশ কিছু গাড়ি বাজারে আনে। এগুলোই এত লিমিটেড এডিশনের হয়ে থাকে যে একই মডেলের ৫০টিরও কম ইউনিট গাড়ি তৈরী করে থাকে ল্যাম্বরগিনি। যেমন এই অব্দি ল্যাম্বরগিনি রেভেন্তো(Revuelto) মডেলের মাত্র ২১টি গাড়ি বাজারে এনেছে আর রোডস্টার(Roadster) মডেলের মাত্র ১৫টি ইউনিট গাড়ি।
লিমিটেড এডিশনের এই সব বেশির ভাগ গাড়ি আবার ল্যাম্বরগিনি ম্যা্নুফেকচার করা শুরু করে অর্ডার আসার পর থেকে। কাস্টমাররা চাইলে একদম শুরু থেকে শেষ অব্দি গাড়ির পুরোটাই নিজেদের মতো করে কাস্টমাইজ(customize) করে নিতে পারবে যেমন, গাড়ির সীটে ঠিক কোন প্রানীর চামড়া ব্যবহার করা হবে তা থেকে শুরু করে একদম সবকিছু। একারণে কাস্টমাইজ এসব গাড়ি তৈরী করতে ল্যাম্বরগিনির সময় লাগে প্রায় ছয় মাস থেকে এক বছরের মতো যেখানে অন্য গাড়ি কোম্পানি যেমন টোয়োটা দৈনিক ২১ হাজার ইউনিট গাড়ি তৈরী করে থাকে। আর এসব কারনেই ল্যাম্বরগিনি এর প্রাইজ এত বেশি হয়ে থাকে।
এছাড়াও ল্যাম্বরগিনি তাদের মার্কেটিং সাধারনত একটু ভিন্য ভাবে করে থাকে। তারা বেশির ভাগ মার্কেটিং করে থাকে ট্রান্সফরমারস(transformers) কিংবা ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস(Fast & Furious) এর মতো জনপ্রিয় মুভি সিরিজগুলোতে নিজেদের নতুন নতুন মডেলের গাড়িগুলো দেখিয়ে। এসব কারণে তাদের মার্কেটিং কস্ট ও বেশী পরে থাকে।
আর এসব কারণে ল্যাম্বরগিনির প্রাইস যেমন বেশি তেমনই ল্যাম্বরগিনিকে এখন দেখা হয় আভিজাত্যের সিম্বল হিসেবে। এমনকি এও বলা হয়ে থাকে যে একজন মিলিয়নার আসলে মিলিয়নার না যতক্ষন না তার গ্যারেজে একটা ল্যাম্বরগিনি আছে।
ল্যাম্বরগিনিতে ওঠার স্বপ্ন দেখার মাধ্যমে আমাদের আজকের ব্লগ এখানেই শেষ করছি ।পরবর্তী ব্লগ দেখার আমন্ত্রন রইল। ব্লগ পেজ এ লাইক দিয়ে সাথে থাকুন।