অডি(AUDI)
আপনি কি জানেন পর্দার আয়রন ম্যান কিংবা জেনিফার লরেন্স(Jennifer Lawrence) অথবা অস্কার বিজয়ী অভিনেতা লিওনার্দো ক্যাপ্রিও(Leonardo DiCaprio) ..তাদের প্রত্যেকেরই নিত্য ব্যবহারের সঙ্গী কোন গাড়িটি? এই তো মাত্র কদিন আগেও বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্লগার এই গাড়ি কিনে কি বিপদেই না পড়ল? এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন কোন গাড়ির(car) ব্র্যান্ড(brand) নিয়ে আজকের ব্লগে।
আজকাল মানুষের বিলাসবহুল জীবনমানের সবচেয়ে বড় পরিচয় হয়ে উঠেছে নামি-দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি। তেমনই এক বিলাসবহুল কার কোম্পানির নাম অডি(AUDI)। যদি আপনি চান অডি ব্র্যান্ডের একটি গাড়ি আপনার হোক? সেক্ষেত্রে সর্বনিম্ম গুনতে হবে ৩০ লক্ষ টাকা! আর সর্বোচ্চ দামের গাড়ির কিনতে হলে গুনতে হবে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার মতো! কিন্তু অডি যাত্রা ঠিক কত সালে আর কিভাবে? প্রতিটি গাড়ি কোম্পানির নামের পিছনেই একটি নতুন গল্প থাকে। অডির ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি।
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের যেতে হবে ২০ শতকের গোড়ার দিকে! জার্মানে তখন অটোমেশন(Automation) কোম্পানিগুলি একটু একটু করে নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে।
জার্মানের এই টালমাটাল সময়টাতেই জার্মান এক ভদ্রলোক কার ব্র্যান্ড নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আর এই ভদ্রলোকের হাত ধরেই অডির গল্প শুরু হয়।
বলছিলাম কোম্পানি প্রতিষ্ঠাতা অগাস্ট হর্চের(August Horch) কথা। যার জন্ম জার্মানিতে ১৮৬৮ সালে। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার হলেও মনেপ্রাণে তিনি একজন উদ্ভাবক ছিলেন। যার কারণে মিটওয়েডায় টেকনিক্যাল একাডেমিতে পড়াশোনা করে তিনি যোগ দেন জাহাজ তৈরির কারখানায়। আর সেই জাহাজ তৈরির কোম্পানিটি ছিলো আর একটি বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা কার্ল বেঞ্জ(Karl Benz) এর কারখানা থেকে ধারণা নিতে নিতেই একসময় তিনি তার প্রথম কোম্পানি, এ হর্চ এন্ড সাই (A. Horch &Cie) প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন।কোম্পানিটি তিনি মূলত পার্টনারশিপে বিজনেস শুরু করেছিলেন।
একটা সময় অগাস্ট হর্চের সাথে এসব কোম্পানি নিয়ে তার পার্টনার দের মাঝে ঝামেলা বেধে যায়। ঝামেলা এতোটাই তিক্ত হয়ে উঠে যে অগাস্ট তার প্রতিষ্ঠিত অন্য কার কোম্পানি Horch &Cie ত্যাগ করেন।
এদিকে পরপর ৩/৪ টি কোম্পানিতে একই নাম ব্যবহার করার কারণে অগাস্টের নামে টুকে দেওয়া হয় মামলা।
ঠিক এমন পরিস্থিতিতে অদম্য উদ্যোক্তা হর্চ তার কোম্পানির জন্য একটি নতুন নাম ঠিক করে। আর এই নামটিই ছিলো আজকের অডি ।
মূলত ল্যাটিন ভাষায় হর্চ শব্দের অর্থ হলো অডি। অডির বাংলা অর্থ আবার ‘শোনা‘। সবমিলিয়ে এইভাবেই অগাস্টের কোম্পানি অডি এবং এর নামের অভিষেক ঘটে।
নামসহ ১৯১০ সালে অডি অটোমোবাইলওয়ার্ক জিএমবিএইচ জুইকাও আনুষ্ঠানিকভাবে তার যাত্রা করে। নাম এবং কোম্পানির অন্যান্য বিষয়াদি একেবারে পরিপাটি করে গুছিয়ে নেয় অগাস্ট। এরপরই শুরু হয় গাড়ি তৈরির পালা।
১৯১০ সারে অগাস্টের কোম্পানি অডি অডি টাইপ এ স্পোর্ট-ফেটন নামের একটি কার বাজারে আনে । ঠিক একই বছর অডি টাইপ এ স্পোর্ট-ফেটনের আদলে আরো একটি গাড়ি বের করে কোম্পানিটি এবং এই গাড়িটির নাম ছিলো টাইপ বিও স্পোর্ট-ফেটন!
বাজারে বের করার সাথে সাথে দু’টো গাড়ি তুমুল সাড়া ফেলে। বিশেষ করে বিভিন্ন ক্রীড়া ইভেন্টে দু’টো গাড়িই সকলের নজর কেড়ে নেয়।
১৯৩২ সালে এসে অডি কোম্পানি হর্চ, ডিকেডব্লিউ এবং ওয়ান্ডারারের সম্মিলিত বিজনেসে পরিণত হয়। গঠন করা হয় অটো ইউনিয়ন এজি। যারা অডি কার বা কোম্পানির লোগো দেখেছেন তারা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন এই লোগোতে ৪ টি রিং রাখা হয়েছে। মূলত অডি লোগোর এই ৪ টি রিং অডি, ডিকেডব্লিউ, হর্চ এবং ওয়ান্ডারার ব্র্যান্ডের(Audi, DKW, Horch,Wanderer) প্রতীককে ইঙ্গিত করে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে অগাস্ট তার শুরুর পার্টনারশিপ বিজনেসে খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও ১৯৩২ সালে করা পার্টনারশিপে ভালোই বাজিমাত দেখাতে সক্ষম হয়েছে। যার কারণে এই সময়টা কাজ করেছে অডির টার্নিং পয়েন্ট(turning point) হিসাবে।
এই পার্টনারশিপের কারণে অডির ইঞ্জিনিয়ারিং উদ্ভাবনের পরিমাণ বেড়ে যায়। ছোট গাড়ি এবং মোটরসাইকেলে(motor-cycle) ডিকেডব্লিউ-এর স্কিল বাড়ে। হর্চের বিলাসবহুল যান এবং ওয়ান্ডারারের মাঝারি আকারের উন্নতমানের ফিচারের সব গাড়ি তৈরি হতে শুরু করে।
যদিও এই সুখ অডির কপালে বেশিদিন টেকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অডির পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হতে থাকে।
এই সময় অটো ইউনিয়নের নাজি বাহিনীর অনুরোধে ফোকাস নাটকীয়ভাবে সরে নিয়ে যায় সামরিক যানের দিকে। অর্থ্যাৎ তারা গতানুগতিক যান তৈরি না করে সামরিক খাতে কাজ লাগতে পারে এমন যান তৈরিতে অনেক বেশি পরিমাণ ফোকাস করতে থাকে।
এমনকি অডি এই সময় গাড়ির পরিবর্তে ট্যাঙ্ক(Tank), বিমানের ইঞ্জিন(Aircraft engine)এবং অন্যান্য যুদ্ধ যন্ত্রপাতি সহ সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করতে থাকে। আর এই পরিবর্তন সরাসরি অডির উপরই গভীর প্রভাব ফেলে। যেখানে কোম্পানির প্রধান লক্ষ ছিলো অটোমেশন নিয়ে সেখানে কোম্পানির টার্গেট হয়ে উঠে যুদ্ধ সরঞ্জাম উৎপাদনে। যার কারণে মার্কেটেও দেখা দেয় পরিবর্তন। এই পরিবর্তন ছিলো ৫০% ইতিবাচক এবং বাকি ৫০% নেতিবাচক।
এই বিশেষ সময়টিতে অডির নামে নেতিবাচক খবরও প্রকাশিত হয়। যা ছিলো পুরোপুরি সত্য। বিশেষ করে এই সময় তাদের জোরপূর্বক শ্রমের ব্যবহার ছিলো অনেক বেশি লক্ষণীয়। যুদ্ধবন্দী এবং কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বন্দী সহ হাজার হাজার শ্রমিককে তারা জোর করে কাজ করিয়ে নিতো!
পরবর্তীতে অডি নিজের এসব নেতিবাচক পদক্ষেপের কারণে জবাবদিহিতা করতেও বাধ্য হয়।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে মিত্র বাহিনীর বোমা হামলায় অটো ইউনিয়নের অনেক কাজকে কমিয়ে ফেলে। অডির প্রধান কারখানাগুলি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
১৯৪৫ সালে অডির অবশিষ্টাংশ দ্বারা জব্দ করা হয়। কোম্পানির সকল সম্পত্তি সোভিয়েত ইউনিয়নে(Soviet Union) নিয়ে যাওয়া হয়।
সবমিলিয়ে বন্ধ হয়ে যায় কোম্পানির কার্যক্রম।
১৯৪৯ সালে বাভারিয়ার(Bavaria) সরকার এবং মার্শাল প্ল্যান তহবিল থেকে লোন নেই অডি। এই লোন পেয়ে কোম্পানিটি অটো ইউনিয়ন জিএমবিএইচ হিসাবে বাভারিয়ার ইঙ্গোলস্টাডতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্জন্ম ঘটে অডির। যদিও এই পুনর্জন্ম ছিলো বেশ চ্যালেঞ্জের!
সেই বছরই ৪ পার্টনারের এই কোম্পানি নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরু করে। এই সময়টাতে অডির বেশ কয়েকটি সফল মডেলের অভিষেক ঘটে।
আর এসময়কার তৈরি করা অডির DKW F89 এবং Auto Union 1000 মডেলের ২ টি গাড়ি বাজারে অডিকে আরো বেশি পরিমাণে হাইলাইট(highlight) করে। ফলে অডি দ্রুত পুরো বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।
এছাড়াও একই সময়ে ছোট টু-স্ট্রোক গাড়ি এবং মোটরসাইকেল তৈরি করে বাজারে রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় অডি কোম্পানি। ধীরে ধীরে, অটো ইউনিয়ন নিজেদের গন্ডি বাড়ায়। ষাটের দশকে এসে অডি পুরোপুরি ব্র্যান্ডকে নতুনত্ব এবং গুণমানের উপর জোর দিতে শুরু করে এবং আগের চাইতে আরো বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
সেই থেকে শুরু! আজ অডি হয়ে উঠেছে বিলাসিতা(luxury), কর্মক্ষমতা(performance)এবং উদ্ভাবনের(invention) প্রতীক। অডির গাড়িগুলিতে যোগ হয়েছে নিত্য নতুন সব ফিচার। নিজেকে পুরো বিশ্ব দরবারে পরিচিত করিয়ে নিয়েছে একটি গ্লোবাল পাওয়ার হাউস হিসাবে।
বর্তমানে অডির রেভিনিউ ৫৫ হাজার কোটি পাউন্ডেরও বেশি। Q8 এবং ই-ট্রন সিরিজের মতো বেশকিছু হাই কোয়ালিটি কার তৈরির কারণে এই রেভিনিউয়ের পরিমাণ দিনকে দিন বাড়ছে।
এছাড়াও অডি প্রচুর বিনিয়োগও(investment) করছে। উদ্দেশ্য একটাই এবং সেটি হলো সামনের বছরগুলিতে ভালো মানের বৈদ্যুতিক মডেল লঞ্চ করা!
বলে রাখা ভালো অডি Q8 কিন্তু দারুণ সব ফিচারে সাজানো গাড়ি। যেটিতে থাকছে ডুয়াল টাচস্ক্রিন(dual touchscreen) সহ হাইব্রিড(hybrid) প্রযুক্তি।
অডি Q8 ছাড়াও বর্তমানে অডির ঝুলিতে রয়েছে ৩০ টিরও বেশি মডেল। আশা করা যায় ভবিষ্যতে এর পরিমাণ আরো বাড়বে। আর এসব মডেলের মধ্যে এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা পেয়েছে কোম্পানিটির হাই-পারফরম্যান্সের স্পোর্টস কার(high performance sports car)।
আর এসবকিছু সম্ভব হয়েছে অডির ইঞ্জিনিয়ারিং(engineering) দক্ষতার কারণে। পাশাপাশি রয়েছে সঠিক সময়ে সঠিক খাতে ইনভেস্ট(invest) এর অভ্যাসটি। যার কারণে বারবার বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা আসলেও বিজনেস পলিসি এবং ইনভেস্টমেন্ট অডি কোম্পানির পতন সামলে নিয়েছে!
আর এভাবেই দিনশেষে আজ অডি হয়ে উঠেছে বিশ্ব অটোমেশন(automation) কোম্পানির এক সফল উদাহরণ হিসাবে। পরিণত হয়ে উঠেছে কার-প্রেমীদের একমাত্র চাওয়া-পাওয়ার ব্র্যান্ডে।
স্পোর্টস কার ভালো লাগে আর অডি সম্পর্কে জানে না এমন মানুষ কম ই আছে। ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে লাইক করতে ভুলবেন না কিন্তু!!