HungryNaki ব্যর্থ হলো কেন ? The Rise & Collapse of HungryNaki
বর্তমানে অনলাইনে পাওয়া যায় না এমন পণ্য খুব কমই আছে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে অনলাইন ফুড ডেলিভারি সার্ভিস নিজের একটি শক্তিশালী জায়গা করে নিয়েছে অনলাইন দুনিয়ায়। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে অনলাইন ফুড বিজনেস বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে।
বর্তমানে ফুডপান্ডা, পাঠাও ফুডের মতো ফুড ডেলিভারি সার্ভিসগুলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকলেও বাংলাদেশে প্রথম এই সার্ভিসটি শুরু করেছিল হাংরিনাকি । ২০১৩ সালে বাংলাদেশ যখন প্রযুক্তিগত দিক থেকে এতোটা উন্নত ছিলনা তখনই তৈরি করা হয়েছিল HungryNaki নামক এই ফুড সার্ভিস প্লার্টফর্মটি।আজ আমরা কথা বলব বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন ফুড ডেলিভারি সার্ভিস হাংরিনাকি সম্পর্কে। কিভাবে যাত্রা শুরু করেছিল হাংরিনাকি? বাংলাদেশে এর বিস্তার কেমন ছিলো? আর কিভাবেই বা বন্ধ হলো বাংলাদেশের প্রথম ফুড ডেলিভারি সার্ভিসটি?
ইন্টারনেটের কল্যাণে ঘরে বসেই ফুড অর্ডার করা এখন খাবারপ্রেমীদের জন্য অনেক বেশি সহজ হয়ে গিয়েছে। এখন কষ্ট করে দূরের রেস্টুরেন্টে গিয়ে লম্বা লাইন দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। নিজের ফোন বা ল্যাপটপের মাধ্যমে ফুড অর্ডার করা যায় যেকোনো সময়। বাংলাদেশে যতগুলো স্ট্যান্ডার্ড ফুড ডেলিভারি সার্ভিস রয়েছে তার মধ্যে হাংরিনাকি অন্যতম। ২০১৩ সালে এই ফুড ডেলিভারি প্লার্টফর্ম বাংলাদেশের প্রথম ফুড ডেলিভারি প্লার্টফর্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করে। দেশীয় ব্রান্ড হিসেবে নামের মধ্যে দেশীয় ভাব ফুটিয়ে তোলার জন্য নামকরণ করা হয়েছিল হাংরিনাকি।
৩ জন তরুণ উদ্যোক্তার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে হাংরিনাকি তাদের যাত্রা শুরু করে। হাংরিনাকির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হচ্ছেন তানভীর আহমেদ, তৌহিদুর রহমান, তরিকুল ইসলাম । তারা প্রত্যেকে চাকরিরত থাকলেও তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিজনেস আইডিয়া সম্পর্কে চিন্তা করতেন। বিভিন্ন আইডিয়া নিয়ে চিন্তা করতে করতেই কাটিয়ে দেন প্রায় তিন মাসের মতো সময়। কিন্তু তখনও ফুড ডেলিভারি সার্ভিসের কথা তাদের মাথায়ই আসে নি।
মজার বিষয় হলো এই দীর্ঘ আলোচনার সময় তারা প্রতিবারই বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করতেন। কখনো গাড়ি পাঠিয়ে ড্রাইভার দিয়ে খাবার আনতেন, কখনো বাইরের কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার অর্ডার করতেন।
সেই সময় বাংলাদেশে কোনো ফুড ডেলিভারি সার্ভিস চালু হয়নি। তখন তারা উপলব্ধি করেন তাদের মতো আরও অনেকেরই হয়ত খাবার অর্ডার করা নিয়ে ভোগান্তি হয়। তখনই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকায় ফুড ডেলিভারি সার্ভিস নিয়ে কিছু একটা করার। সেই চিন্তা থেকেই পরবর্তীতে ২০১৩ সালের অক্টোবরের ১ তারিখ তারা তাদের ওয়েবসাইটটি কার্যকর করেন।
৬ জনের একটি টিম অফিসের একটি মাত্র রুম ভাড়া নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করেন। ৩০ রেস্টুরেন্টের সাথে পার্টনারশিপে তারা তাদের বিজনেসটি শুরু করেন। হাংরিনাকি প্রথম মাসে প্রায় ২০০ টি অর্ডার সম্পন্ন করেছিল। শুরুটা শুধু ঢাকায় হলেও পরবর্তীতে এর বিস্তার বাড়তে শুরু করে। পরবর্তীতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, চট্রগ্রাম, কক্সবাজারসহ শহরে ব্যাপক সারা জাগায় হাংরিনাকি সার্ভিসটি। ফাস্টফুড থেকে শুরু করে সি ফুড, হ্যাভি ফুডসহ ১,২০,০০০ এরও বেশি খাবারের আইটেম রয়েছে হাংরিনাকি অ্যাপে।
২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সাত বছর হাংরিনাকি ছাড়া বাজারে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকার তারা নিজস্ব দাপটে চলছিল। পরবর্তীতে ২০২০ সালে উবার ইটস ও ২০২১ সালে সহজ ফুড তাদের যাত্রা শুরু করে। যদিও হাংরিনাকি সবথেকে বড় বাংলাদেশী মালিকানাধীন এবং পরিচালিত অনলাইন ফুড ডেলিভারি সার্ভিস তবুও এদের টিকে থাকতে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে। কারণ হাংরিনাকির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল জার্মানভিত্তিক গ্লোবাল ফুড ডেলিভারি সার্ভিস ফুডপান্ডা। যা বিশ্বব্যাপী ২৬ টি দেশে তাদের সার্ভিসটি দিয়ে যাচ্ছে। ফুডপান্ডা বাজারে আসার পর থেকে হাংরিনাকির চাহিদা একেবারে কমে আসে। অনলাইন ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান ফুডপান্ডা ও পাঠাও ফুডের আধিপত্যে বিগত কয়েক বছর থেকে হিমশিম খাচ্ছিল হাংরিনাকি।
এরপর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য হাংরিনাকি যথাসাধ্য চেষ্টা করে। শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে ভোক্তারা ফুড ডেলিভারিতে ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়। হাংরিনাকি শুরুর দিকে ঢাকায় ডেলিভারি চার্জ ছিলো ৭৫ টাকা কিন্তু পরবর্তীতে তা ১৯ টাকার নামিয়ে আনা হয়।এরপর নিজেদের কার্যক্রমের পরিধি সীমাবদ্ধ ও কর্মী সংখ্যা কমিয়ে বাজারে টিকে থাকার চেষ্টা করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে করোনাকালীন সময়ল খাবারের দাম বেড়ে যায়, যার ফলে ভোক্তারা ব্যয় কমিয়ে দেয়। বাজারে বিনিয়োগও কমে যায়। এরপর ফুড ডেলিভারি খাত পতনের মুখোমুখি হতে শুরু করে।
হাংরিনাকির ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, স্টার্টাপ ব্যবসা নিয়ে কখনোই নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। আগে হাংরিনাকিতে পুরো ঢাকা শহর থেকে অর্ডার দেয়া যেত। এখন তা কমে হাতেগোনা কয়েকটি রেস্টুরেন্টে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। শুধু হাংরিনাকি না, বিপদের মুখে আছে অনলাইন ফুড ডেলিভারির প্রায় প্রতিটি কোম্পানি। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতায় দিনকে দিন অর্ডারের সংখ্যা কমছে। একসময় অনলাইন ফুড ডেলিভারিতে প্রতিদিন দেড় লাখ মানুষ খাবার অর্ডার দিতেন। এখন তা কমে ৫০ হাজারে নেমে এসেছে।
এরপর থেকে হাংরিনাকি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয় এবং একপর্যায়ে এই প্লার্টফর্মটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। ২০২১ সালের মার্চ মাসে আলিবাবা গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ই-কমার্স সাইট দারাজ ফুড ডেলিভারি প্লার্টফর্ম হাংরিনাকিকে কিনে নেয়। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজন একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়। আলিবাবা এই স্টাটার্পটিকে ১.০ মিলিয়ন ডলারেরও কম দামে নিজেদের করে নিয়েছে।
হাংরিনাকি অধিগ্রহণের পর দারাজ ১০০ এলাকায় প্রতিষ্ঠানটিকে সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। ৩০ এলাকায় বিস্তৃতির পর তা গত বছর ১৫-তে নামিয়ে আনা হয়। বর্তমানে হাংরিনাকি রাজধানীতে মাত্র কয়েকটি এলাকায় ফুড ডেলিভারি করে। তাদের রেস্তোরাঁ ও ডেলিভারি ম্যানের সংখ্যাও কম।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিকূল সময়ে ভর্তুকি দিয়ে সম্প্রসারণ না করে লাভের দিকে মনোযোগ দিতেই প্রথমে কার্যপরিধি সীমিত করা এবং এখন পুরোপুরি বন্ধের কৌশল নিয়েছে দারাজ সদর দফতর।
বর্তমানে ফুড ডেলিভারি বাজারের দুই-তৃতীয়াংশের দখল ফুডপান্ডার হাতে। বাকি বাজার পাঠাও ফুডসের দখলে।
হাংরিনাকি স্টার্টআপটি লয়াল কাস্টমার বেইজ হলেও টিকো থাকতে না পারার কারণ ছিলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে দক্ষতা না থাকা এবং চ্যালেঞ্জ নেওয়া মানসিকতা না থাকা। তবে দারাজ হাংরিনাকি প্লার্টফর্মটি টিকিয়ে রেখে ভবিষ্যতে রিওপেন করতে পারে।কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।