গেমিং জায়ান্ট থেকে প্রযুক্তির গডফাদার- টেনসেন্ট এর অন্ধকার জগত
অনলাইন কিংবা অফলাইনের গেমিং জগতে যদি আপনার চলাফেরা থাকে, তাহলে প্রশ্নটা আপনারই জন্য। মোবাইলের কোন গেমসটা আপনার সবচেয়ে প্রিয়? ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান্স (Clash of Clans)? পাবজি (PUBG)? নাকি অন্য কোনও গেমস! আপনার উত্তর ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক থাকলেও, একটি জায়গায় হয়তো আপনি বারবার একটি কোম্পানিকেই বেছে নিচ্ছেন মনের অজান্তেই! শুধু মোবাইল গেমস নয়, অনলাইনের সব জনপ্রিয় গেমসের সাথেও জড়িত এই কোম্পানিটি! আর এই জায়গা তৈরি করতে গিয়ে টেক জায়ান্ট হিসেবে পরিচিত এই কোম্পানিটি পার করেছে বিবেকের বাঁধ পর্যন্ত! চলুন, আজ কথা বলা যাক চীনের গেমিং ইন্ডাস্ট্রির রাজা, টেনসেন্ট (Tencent)নিয়ে।
টেনসেন্টের যাত্রা
১৯৭১ সালে চীনের গুয়াংডন প্রদেশে জন্মগ্রহন করেন পনি মা (Pony Ma)। পনি মার পিতা, মা চেংশু একজন পোর্ট ম্যানেজার ছিলেন। চাকরির সুবাদে গুয়াংডন ছেড়ে তাদের চলে যেতে হয় জেন প্রদেশে। সেখানকার শেনজেন ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড এপ্লাইড টেকনোলজির ব্যাচেলর ডিগ্রির পড়াশোনা ১৯৯৩ সালে শেষ করেন পনি মা। প্রযুক্তিপ্রেমী পনি মা লেখাপড়া শেষ করেই চাকরিজীবনে প্রবেশ করেন। প্রথমদিকে মাত্র ১৭৬ ডলার বেতনের চাকরি করতেন তিনি। তবে পনি মা যখন শেনজেন রানশান কমিউনিকেশন কোম্পানী লিমিটেডের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন, তখন ইন্টারনেটের বিশাল দুনিয়ার সাথে পরিচয় হয় তার। চাকরির সুবাদেই সেইসময় ইসরায়েলের কোম্পানি ‘মিরাবিলিস’ এর এক প্রেজেন্টেশনে অংশগ্রহন করেন, পনি মা, যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়! ১৯৯৬ সালে ইসরায়েলী এই কোম্পানিটি তাদের ইন্টারনেট ম্যাসেজিং এপ ‘’আইসিকিউ’’ (ICQ) মার্কেটে নিয়ে আসে, যা রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। এই এপটির প্রেজেন্টেশনেই উপস্থিত ছিলেন পনি মা। তিনি বুঝতে পারেন, ইন্টারনেট ভবিষ্যতে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক বস্তুতে পরিনত হবে। প্রেজেন্টেশন থেকে ফিরে এসেই পনি মা তার কলেজ জীবনের কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করেন, এবং চীনেই এরকম এক কোম্পানি চালু করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৯৮ সালে টেনসেন্ট ইনকর্পোরেশনের যাত্রা শুরু হয়। সেইসময় এই কোম্পানিটি ম্যাসেজিং এপ বাজারে আনার জন্য পরিচিতি পায়। প্রতিষ্ঠার ১ বছরের মধ্যেই টেনসেন্ট থেকে মুক্তি পায় QQ নামের এক ম্যাসেঞ্জার app । তবে কোম্পানি তৈরির প্রথম ৩ বছর কোনও প্রফিটের মুখ দেখতে পায়না কোম্পানিটি। তবে ইন্টারনেটের যাত্রাকালীন সময়ে এমন একটি app বাজারে এনে নিজেদের যোগ্যতার জানান দেয় পনি মার কোম্পানিটি।
২০০১ সালে সাউথ আফ্রিকান টেক কোম্পানি নাসপার্স (Naspers) ,টেনসেন্ট এর ৪৬.৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। এরপর টেনসেন্ট অল্প অল্প করে তাদের উন্নতির ধারা বাড়াতে শুরু করে, এবং খুব দ্রুতই তাদের প্রথম সাফল্যের দেখা পায়। ২০০৩ সালে টেনসেন্ট তাদের গেমিং ডিভিশনের যাত্রা শুরু করে, যা অনলাইন গেমস তৈরির কাজ শুরু করে। যেখানে দশকের পর দশক অন্যান্য টেক কোম্পানি একটি সফল প্রোজেক্ট মার্কেটে আনতে ব্যর্থ হয়, সেখানে নাসপার্স টেনসেন্টের বিশাল অংশ কিনে নেয়ার ১০ বছরের মাথাতেই কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসে ‘উইচ্যাট’ (wechat) নামের আরেকটি ম্যাসেজিং app । এটি শুধু ম্যাসেজিং app নয়, বরং একের ভিতর সব কাজ করার মতো এক App ছিলো। এখানে ম্যাসেজ পাঠানো থেকে শুরু করে অনলাইনে মার্কেটিং করা, ফাইল শেয়ার করা, ভিডিও কল করা, অনলাইনে যাবতীয় পেমেন্ট করা থেকে শুরু করে আরও অনেক কাজ করতে পারে।
টেনসেন্ট চীনের অভ্যন্তরীণ মার্কেট ধরতে পেরেছিলো। তারা বুঝেছিলো, শুধু একটি সার্ভিস প্রদান না করে, একটি app এ সব সার্ভিস প্রদান করলে চীনে এই app এর জনপ্রিয়তা সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে। টেনসেন্টের এমন সিদ্ধান্ত দারুণ কাজে আসে, আর খুব দ্রুতই ১.২ বিলিয়ন গ্রাহকের ভরসার নাম হয়ে উঠে উইচ্যাট। এখান থেকেই শুরু হয় টেনসেন্ট এর সফলতার যাত্রা।
টেনসেন্টের সফলতা
মাত্র এক দশকের মাথায় এতো বড় মার্কেট নিজেদের করে নেয়ার পর, টেনসেন্ট একের পর এক বিনিয়োগ করতে শুরু করে। তারা ধীরে ধীরে চীনের সব বড় বড় মিউজিক কোম্পানিগুলোকে কিনে নিতে থাকে। তবে তাদের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ গুলোর একটি হয় ২০১১ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারিতে, যখন টেনসেন্ট প্রায় ২৩০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আমেরিকান গেমিং কোম্পানি ‘রায়ট গেম (Riot Games)’ এর মালিকানা কিনে নেয়। এই কোম্পানিই লিগ অফ লেজেন্ড এর মতো জনপ্রিয় গেমস তৈরি করে, যা সারাবিশ্বে আকাশছোয়া জনপ্রিয়তা পায়।
এরপর টেনসেন্ট তার বিনিয়োগের যাত্রা আর থামায়নি। ধীরে ধীরে সুপারসেল (Supercell), মিনিক্লিপ (Miniclip), সি লিমিটেড (C. LIMITED ), এপিক গেমস (Epic Games), গ্রাইন্ডিং গিয়ার (Grinding Gear) গেমসের মতো সারাবিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানির মেজরিটি শেয়ার কিনে নিতে শুরু করে টেনসেন্ট। সেইসাথে চীনের অভ্যন্তরীণ ব্যবসাতেও নিজেদের আধিপত্য বাড়াতে শুরু করে কোম্পানিটি। টেকনোলজির জগতে চীনের দুই জায়ান্ট আলিবাবা (Alibaba) এবং বাইজুকে ছুয়ে ফেলে টেনসেন্ট (Tencent)। ধীরে ধীরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে চীনের এই টেক কোম্পানিটি।
চীনের বিশাল মার্কেটে প্রবেশ করার জন্য অনেক গেমিং কোম্পানিই সুযোগ খুজতে শুরু করলে, টেনসেন্ট এগিয়ে আসে। বিদেশী গেমস চীনে রিলিজ দেয়ার চিন্তাভাবনা থাকলে, কোম্পানি যত বড়ই হোক না কেন, তাদের একজন চাইনিজ পার্টনারের দরকার হতো। আর এই চাইনিজ পার্টনার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে টেনসেন্ট (Tencent) । তারা একে একে কোরিয়া, জাপান, আমেরিকা থেকে শুরু করে সারাবিশ্বের বড় বড় সব গেমিং কোম্পানির সাথে পার্টনারশিপে যেতে শুরু করে। বর্তমানে অনলাইন জগতের সব জনপ্রিয় গেমসের সাথেই টেনসেন্টের নাম জড়িয়ে আছে। আপনার মোবাইলে ইন্সটল করে রাখা গেমসগুলোর মালিকানা টেনসেন্টের কাছে, এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। যেই কোম্পানি বছরের পর বছর লাভের মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত ছিলো, সেই টেনসেন্ট কোম্পানি এখন শুধু চীনের নয়, বরং সারাবিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী কোম্পানিগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। বর্তমানে টেনসেন্টের মার্কেট ভ্যালুয়েশন প্রায় ট্রিলিয়ন ডলারের অংক ছুয়ে আছে! এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা পনি মা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন। প্রায় ৩৪.৫ বিলিয়ন ডলারের মালিক এই ব্যবসায়ী প্রথম চাইনিজ নাগরিক হিসেবে ফোর্বস (forbes) এর সেরা দশ ধনী ব্যক্তির তালিকায় স্থান পান। আর টেনসেন্ট পৃথিবীর সেইসব কোম্পানিগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে, যাদের বছরের আয় ছাড়িয়ে যায় একশো বিলিয়ন ডলারের অংক কেও!
টেনসেন্টের ডার্ক সাইড
চীনের মতো একটি দেশের টেক জায়ান্ট হওয়া যেমন গর্বের বিষয়, তেমনিই সেটি একটি ঝামেলাদায়ক ব্যাপারও। চীন সবসময় সরকারবান্ধব আইন প্রস্তুত করে থাকে, যার ফলে অনেকসময় লোকসানের মুখে পড়তে হয় বড় বড় কোম্পানিগুলোকে।
ঠিক এমনই এক নিয়ম চীন বাজারে নিয়ে আসে, যা টেনসেন্টকে ফেলে দেয় হুমকির মুখে। গেমসের আসক্তি থেকে চীনের তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে চীনা সরকার গেমস খেলার সময়সীমা ধরে দেয়। ১৮ বছরের নিচের বাচ্চারা প্রতি সপ্তাহে ৩ ঘন্টার বেশি গেমস খেলতে পারবেনা বলে আইন প্রণয়ন করা হয়। সেইসাথে ছুটির দিনে ৩ ঘন্টার বেশি গেমস খেলা যাবেনা, এমন আইনও আসে।
এই আইন প্রণয়নের ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয় টেনসেন্ট। তাদের গেমিং মার্কেটের জন্য এমন একটা আইন হুমকির সমান, তা বলাই বাহুল্য। চীনের আইন ভাঙ্গার ক্ষমতাও নেই টেনসেন্টের। তাই তারা তাদের গেমিং মার্কেট চীনের বাইরে বৃদ্ধি করতে থাকে, আর তাদের প্রথম টার্গেট হয় ভারতের মতো দেশগুলো।
ভারতে পাবজির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে গেলেও, কিছুদিন পর বের হয়ে আসে টেনসেন্টের এক রহস্যময় খবর। চীনের সরকারের আইনমতে, চীনের সব টেক জায়ান্ট কোম্পানিকেই তাদের গ্রাহকদের তথ্য শেয়ার করতে হবে। আর এই জিনিসটিই মাথা ঘুড়িয়ে দেয় ভারতীয় সরকারকে। একদিকে চীনের সাথে ভারতের বর্ডারে ঝামেলা, অন্যদিকে ভারতের কোটি কোটি জনগণের ব্যক্তিগত তথ্য চীনের কাছে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা, দুটো একসাথে হওয়ায় ২০২০ সালে পাবজি গেমস এর মতো চীনা এপ্লিকেশনগুলোকে ব্যান করা হয়।
টেনসেন্ট এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক কোম্পানিগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। শুধু গেমিং দুনিয়াই নয়, Messaging Service , Artificial Intelligence প্রযুক্তি থেকে শুরু করে সবখানেই কোম্পানিটির হাত পৌঁছে যাচ্ছে। আর এই নেটওয়ার্কের ফায়দা নিতে চাইছে চীনের সরকার। সারাবিশ্বের উপর নজর রাখা এবং কয়েকশো কোটি মানুষের তথ্য সংগ্রহ করার মতো ক্ষমতা রয়েছে এখন টেনসেন্ট এর। কথিত আছে, কোনও ভিডিও গেমস যদি সামান্যতম জনপ্রিয়তাও পায়, তাহলেই সেই গেমসের মালিকানা নিয়ে নেয় টেনসেন্ট। সম্প্রতি পশ্চিমাবিশ্বে জনপ্রিয় একটি গেমস রবলোক্স (RobLox) এর মালিকানাও নিজেদের করে নিয়েছে টেনসেন্ট, যেই গেমসে অল্পবয়সী বাচ্চাদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। এমন একটি গেমস থেকে খুব সহজেই বিভিন্নধরনের স্পর্শকাতর তথ্য বের করে নেয়া সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও অনলাইনের সবচেয়ে আধুনিক ম্যাসেজিং app ডিসকর্ডের (Discord) অন্যতম বড় শেয়ারহোল্ডার এই টেনসেন্ট কোম্পানি। তাই পশ্চিমা বিশ্বের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিজেদের হাতের মুঠোয় রাখার সব ব্যবস্থাই নিয়ে রেখেছে চাইনিজ এই টেক কোম্পানি, যার ফল ভোগ করতে চলেছে চীন (China)।
কিছুদিন আগেই এসাসিন ক্রিড (Assassin’s Creed) গেমস বানিয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া গেমিং স্টুডিও ইউবি সফট (Ubisoft) কেও কিনে নিয়েছে টেনসেন্ট। এভাবে চলতে থাকলে, অদুর ভবিষ্যতে গেমিং জগতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করবে চাইনিজ এই কোম্পানি। টেনসেন্টের এই যাত্রা চালু থাকলে, খুব শীঘ্রই অনলাইনের কয়েকশো কোটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য খুব সহজেই নিজেদের ডাটাবেজে নিয়ে নিবে চীনের সরকার। আর তাই, ইতিমধ্যেই টেনসেন্টের উপর কড়াকড়ি আরোপ আনতে চলেছে বহির্বিশ্বের বেশকিছু ক্ষমতাধর দেশ। কিন্তু ঘটনা যখন এতোদুর এগিয়েই গিয়েছে, তখন একটা প্রশ্নই সামনে চলে আসে… টেনসেন্টকে কি আর আটকে রাখার উপায় আছে?
আমাদের ব্লগ পড়ে নতুন কিছু শিখে থাকলে এবং পরবর্তী ব্লগ পেতে নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথেই থাকবেন। কমেন্ট করে জানান আপনার ডিভাইস এ বর্তমানে টেনসেন্ট কোম্পানির কোন অ্যাপ টি ইন্সটল আছে ?