অ্যামাজন সম্পর্কে যা জানলে আপনিও অবাক হয়ে যাবেন |
অ্যামাজনের(Amazon) যেসব ডার্ক সাইড জানলে আপনিও অবাক হবেন
ধরুন… আপনি চিন্তা করলেন আপনার দরকারি কোন একটি প্রোডাক্ট ঘরে বসেই অ্যামাজনে অর্ডার দেবেন। হয়তো ভাবছেন এ আর এমন কি? জাস্ট একটা সিম্পল প্রোডাক্ট অর্ডার করলেই তো হলো। তখনি আপনি আপনার মোবাইল থেকে অ্যামাজন অফিসিয়াল সাইট খুঁজে বের করে সার্চ করতে লাগলেন দরকারী প্রোডাক্টটি। পেয়েও গেলেন হয়তোবা খানিক বাদে। কিন্তু এই খানিকটা সময় যে গড়িয়ে রীতিমতো ৩/৪ ঘন্টায় পৌঁছে গেছে আপনি তা হয়তো খেয়াল ই করেননি। এবং তার কারণ কি তা আপনি নিজেও বুঝতে পারেন নি। কারণ হলো আপনি যে প্রোডাক্ট কিনতে এসেছেন সে প্রোডাক্ট বাদেও আরো হাজার হাজার প্রোডাক্ট দেখা শুরু করেছেন। রকমারী প্রডাক্টের আকর্ষন যেন আপনাকে আটকে রাখছে তার মায়াজালে। ব্যাস!! ১টি প্রোডাক্ট কিনতে এসে লোভ দেখিয়ে আপনাকে দিয়ে কিনিয়ে নিয়েছে আর পাঁচটি প্রোডাক্ট। আর এই কাজে অ্যামাজন ব্যবহার করেছে নিউরো সাইকোলজিক্যাল মার্কেটিং(Neuromarketing )।
অ্যামাজন…. যাকে বলা হয় দি হোলি গ্রেইল অফ শপিং(Holy grail of shopping)। বিশ্বের এক নম্বর এই ই কমার্স সাইটে(e-commerce site) প্রতিদিন ১৬ লাখের ও বেশি অর্ডার প্লেস হয় যার বিক্রয় লব্ধ আয় গড়ে ১০৪ কোটি ডলার। দ্রুত সময়ে ডেলীভারি এবং স্বল্প মুল্যের কারনে বিশ্বের ঘরে ঘরে রয়েছে এর জনপ্রিয়তা।
কিন্তু এরি সাথে রয়েছে কিছু খারাপ দিক যার কারনে অ্যামাজন হতে সমালোচনার স্বীকার? আর এরি বিস্তারিত জানব বিজনেস ম্যানিয়ার আজকের ব্লগে ।
অ্যামাজনের কথা বললে সবার আগে বলতে হবে এর প্রুতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের (Jeff Bezos)। যার অসাধারন মার্কেটিং এর কল্যানে অ্যামাজনের আজকের এ অবস্থান। কিন্তু তার শুরুর পথটি কিন্তু এতটাও মসৃণ ছিলনা। জেফ বেজসের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১২ জানুয়ারি আমেরিকার নিউ মেক্সিকোর আলবুকার্ক(Albuquerque) শহরে । বেজোসের ছেলেবেলা কাটে তার কিশোরী মায়ের হাতে। পরে তিনি এক কিউবান অভিবাসীর কাছে দত্তক হয়ে যান। শুরু হয় সৎ বাবার কাছে মানুষ হবার জার্নি।
প্রযুক্তি এবং উদ্যোক্তা শব্দগুলির প্রতি সেই সময়টা থেকেই তার আগ্রহ কাজ করতে শুরু করে। এই অনুভুতি হৃদয়ে পুষতে পুষতে তিনি ১৯৮৬ সালের দিকে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি(Princeton University) থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কম্পিউটার সাইন্সের উপর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
পড়াশোনা শেষ করে ক্যারিয়ার হিসাবে শুরু করেন ওয়াল স্ট্রিটে(Wall Street)। এরপর ১৯৯৪ সালে ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা দেখে বেজোস একটি অনলাইন বইয়ের দোকান শুরু করেন। যদিও তখন বেজোস DE Shaw & Co. নামের একটি কোম্পানিতে বেশ ভালো বেতনে চাকরি করতেন! তবে উদ্যোক্তা হবার স্বপ্নকে মাথায় রেখেই বেজোস এই ভালো বেতনের জবটি ছেড়ে দেন।
যাইহোক! ওয়াশিংটনের একটি গ্যারেজ থেকে তিনি তার অনলাইন কোম্পানি অ্যামাজন চালু করেন। আর ধীরে ধীরে এই কোম্পানি বইয়ের দোকানের পাশাপাশি বিশ্বের বৃহত্তম অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্মে (Online Shopping Platform)পরিণত হয়।
বর্তমানে বেজোস কাজ করছেন অ্যামাজন ই–কমার্স(e-commerce) এবং ক্লাউড কম্পিউটিং(cloud computing) নিয়ে। গ্রাহক সন্তুষ্টি, ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বেজোসের সফলতার মূল চাবিকাঠি হলেও সফলতা পেতে তিনি কম ডার্ক টেকনিকের সাহায্য নেননি! উপরন্তু তার ক্যারিয়ারের পজেটিভ মার্কেটিং টেকনিকের চাইতে নেগেটিভ মার্কেটিংয়ের(Negative marketing) ব্যবহারই ছিলো দেখার মতো। কিভাবে? তা জানতে হলে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। জানতে হবে অনলাইন কোম্পানি অ্যামাজনের যাত্রা সম্পর্কে।
অ্যামাজনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৪ সালে। DE Shaw & Co. নামক কোম্পানিতে বেজোস সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে কর্মরত থাকলেও একটা উদ্দেশ্য মাথায় রেখে সেই জব ছেড়ে দেন। তবে এই উদ্দেশ্য ঠিক করার আগে চমৎকার একটি ফ্যাক্ট বেজোসকে রীতিমতো অবাক করে দেয় এবং সেটি হলো প্রতি বছর ওয়েবসাইটের ক্রমবর্ধমান চাহিদা। ওয়েবসাইটের এমন বাড়তি ব্যবহারের দিকটাকে মাথায় রেখে বেজোস ভাবতে লাগলেন তিনি অনলাইন ব্যবসা শুরু করবেন। তিনি ঠিক করলেন আপাতত তার অনলাইন শপ বই তুলবেন এবং অল্প খরচে সহজ শিপিং সিস্টেম চালু করবেন। বেজোস এবং তার স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি এই বিজনেসে পুরোপুরি মন দিতে সবকিছু গুছিয়ে চলে আসে সিয়াটল শহরে । সেখানে নিজেদের গ্যারেজ থেকে বিজনেসের জন্য যাবতীয় অফলাইন কাজ সারতে লাগলেন। আর এই গ্যারেজ থেকে কাজ করেই তারা ২ জন অ্যামাজনের জন্য ব্লুপ্রিন্ট(Blue-print) তৈরি করা শুরু করেন।
বেজোস তার প্ল্যান অনুযায়ী তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বই উঠালেন। যাতে গ্রাহক অনেকগুলি বইয়ের মাঝে যেকোনো একটি বই পছন্দ করে কেনার সুযোগ পায়। ১৯৯৫ সালের ১৬ জুলাই তার ওয়েবসাইট প্রথম লাইভ করেন। শুরুতে বেজোস সাইটটিতে এক মিলিয়নেরও বেশি বই লিস্টিং করে ফেলে৷ এরপর ৫০ টি রাজ্য এবং ৪৫ টি দেশে বই শিপিংয়ের(shipping) কাজ করতে থাকে অ্যামাজন ।
সেলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় নিজেরা তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করলেন। এরই প্রেক্ষিতে বেজোস তৈরি করলেন ছোট্ট একটি টিম।
অ্যামাজন কোম্পানির টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে কাজ করে ১৯৯৭ সালের সময়টা। এই সময়টাতে বেজোস যাই আর্ন করতেন তার সবই ইনভেস্ট করতেন। পাশাপাশি সুযোগ বুঝে বাড়তি ইনভেস্ট করার ক্ষেত্রেও সময় দিতেন। ২০০০ সালের শেষের দিকে এসে বেজোসের এই সফল অনলাইন কোম্পানিটি বইয়ের দোকান থেকে একেবারে রিটেইল স্টোর এ পরিণত হয়ে যায়। ইংরেজিতে যাকে বলে “এভ্রিথিং স্টোর”(Everything Store)। বেজোসের দৃষ্টি বইয়ের বাইরে ইলেকট্রনিক্স, খেলনা, পোশাকসহ অন্যান্য প্রোডাক্টের উপর পড়ে।
অ্যামাজন প্রাইম(Amazon Prime):
অ্যামাজনের এই যাত্রা সফল হতে না হতেই বেজোস কোম্পানিটির অংশ হিসাবে লঞ্চ করে অ্যামাজন প্রাইম। অ্যামাজন প্রাইম মূলত এমন একটি সিস্টেম যার মাধ্যমে গ্রাহক বার্ষিক ফির মাধ্যমে ২ দিনের মধ্যে শিপিং সার্ভিস(shipping service) উপভোগ করতে পারবে। অনলাইন কেনাকাটার সুবিধার জন্য কোম্পানিটিতে এই নতুন সিস্টেম একটি নতুন দাঁর উন্মোচন করে। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে অ্যামাজন।
কিন্ডল(Kindle):
কল্পনা করুন তো হাজার হাজার বই কেবল একটি ডিভাইসে সুলভ মূল্যের কেনা যাচ্ছে। বইয়ের তাকে পছন্দের বইটি খুঁজতে গিয়ে ক্লান্ত হবার কোনো প্রয়োজন পড়ছে না।এমন প্রোডাক্ট হল কিন্ডল । আর অ্যামাজনের এই সিস্টেম বই পড়ুয়াদের মধ্যে বড়সড় একটা হাইপ(hype) তৈরি করে। ২০০৭ সালের দিকে কিন্ডেল বাজারে আসার পর প্রায় প্রায় সাত লাখেরো বেশি ইউনিট সেল করে।
ক্লাউড কম্পিউটিং(Cloud computing):
বেজোস কিন্তু এসব করেই থামেনি! বরং ক্লাউড কম্পিউটিং এর সম্ভাবনা দেখে সে ২০০৬ সালে অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস বা AWS চালু করে বসে। যার মাধ্যমে অ্যামাজন গ্রাহকদের ব্যবসায়িক স্কেলযোগ্য ক্লাউড স্টোরেজ এবং কম্পিউটিং পাওয়ার অফার করে।
মূলত যারা অনলাইন বিজনেস করে বা অনলাইন প্রোডাক্ট সেল করে তাদের জন্য এই সিস্টেমটি একেবারে সোনায় সোহাগা হয়ে উঠে। এই সিস্টেমের মাধ্যমে গ্রাহকরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটারিং কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারে। যেমন স্টোরেজের কাজ, কম্পিউটার ব্যবহার, ডেটাবেস তৈরি কিংবা নেটওয়ার্কিং! আর এই সিস্টেমের কারণে দেখা যায় অ্যামাজন রীতিমতো অনলাইন মার্কেটের দুনিয়ায় ঝড় তুলে বসে আছে।
জনপ্রিয়তা
অ্যামাজনের এতোসব সুবিধার কারণে কোম্পানিটি সারা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। আর করবেই না বা কেনো! কত শত কারণ রয়েছে এর পেছনে! তাছাড়া বেজোস সেই ২০১৩ সাল থেকে একটি ড্রোন ডেলিভারি(Drone Delivery) সিস্টেম চালু করার চেষ্টা করে আসছে। যার মাধ্যমে গ্রাহক প্রোডাক্ট অর্ডারের ৩০ মিনিটের মধ্যেই প্রোডাক্ট হাতে পাচ্ছে।
পাশাপাশি ২০১৪ সালের দিকে অ্যামাজন ইকো চালু করা হয়েছিলো। এটি মূলত এআই আলেক্সা(Alexa) দ্বারা পরিচালিত একটি স্মার্ট স্পিকার। যার মাধ্যমে ইউজার স্মার্ট ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, মিউজিক চালাতে পারবে এবং এমনকি সাধারণ ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমে অ্যামাজন থেকে পণ্য অর্ডার করতে পারবে।
ডার্ক সাইড(Dark Side)
এতোসব সুবিধা, প্রযুক্তি এবং গ্রাহক সেটিসফাইয়িং ফিচার থাকলেও বেজোসের এই প্রতিষ্ঠানের নেগেটিভ সাইডের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
এক্ষেত্রে রয়েছে অ্যামাজনের প্রোডাক্ট স্টকিংয়ের সমস্যা। না! তাদের স্টকের পরিমাণ কম নয়। তবে প্রোডাক্ট স্টক করতে গিয়ে অ্যামাজন কোম্পানি শ্রমিকদের প্রচুর খাঁটিয়ে নেয়। এখানকার শ্রমিকদের প্রতিদিন ১০ ঘন্টা কাজ করতে হয়। পাশাপাশি ওভার টাইম হিসেবে কখনো কখনো ১২ ঘন্টাও কাজ করার দরকার পড়তে পারে। জানা যায় অনেক সময় এসব লেবারদের খাবার গ্রহণে বিরতি চলাকালীন সময় পর্যন্ত দেয়া হয় না। এছাড়া বেজোসের কোম্পানিটির কর্মক্ষেত্রে কর্মচারীদের কাজের সময় আহত হওয়ার অসংখ্য রিপোর্ট পাওয়া গেছে। কারণ এখানকার কাজের পরিবেশ ৯০% অনিরাপদ।
কিন্তু ধুর্ত বেজোস আবার নিজেদের লাভ বুঝতে ১৬ আনা মাথা ব্যবহার করে থাকে। অ্যামাজন কর্মীরা ভালো মতো কাজ করছে কিনা তা নিয়মিত চেক করা হয়। এ জন্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার করে কোম্পানিটি। শুধু স্টক করার সময় লেবাররাই নয়! বরং এর পাশাপাশি অ্যামাজনের বিরুদ্ধে রয়েছে ডেলিভারি ড্রাইভারদের অতিরিক্ত খাটিয়ে নেয়ার অভিযোগ । মাঝেমধ্যেই তাদের একদিনে প্রোডাক্ট ডেলিভারি করার আলটিমেটাম দেওয়া হয়। ফলে এক্সিডেন্ট, অসুস্থতাসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে ডেলিভারি কর্মিরা ।
অন্যদিকে অ্যামাজনের কর্পোরেট সংস্কৃতি কিন্তু যথেষ্ট নেতিবাচক। এখানে সবচেয়ে বেশি ফলো করা হয় ডারউইনবাদ। যারা সমাজবিজ্ঞান পড়েছেন তারা নিশ্চয় জানেন ডারউইনবাদে শ্রমিক প্রচুর কাজ করলে তাকে বাদ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় নতুন কাউকে। সুতরাং কাজ ভালো না হলে, অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে একজন শ্রমিক হিসেবে আপনার চাকরি নট হবার চান্স একেবারে ১৬ আনাই বলা চলে।
অ্যামাজনের আরেকটি কমন অন্ধকার দিক হলো অ্যামাজনের বিশাল মার্কেটপ্লেসের কাছে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা নিজেদের মাথাই তুলতে পারে না। এমনও অভিযোগ আছে যে অ্যামাজন তার প্ল্যাটফর্ম থেকে ডেটা ব্যবহার করে ছোট ছোট বিজনেস সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়। আর সেই খোঁজ খবর থেকে পাওয়া ডেটা চুরি করে অ্যামাজন কপিক্যাট প্রোডাক্ট নিজের দোকানে তোলে।
এছাড়াও অ্যামাজন নিজের ট্যাক্স দায়বদ্ধতা কমানোর জন্য ট্যাক্স লুপ হোল এবং অফশোর হেভেন ব্যবহার করে। যার সারকথা হচ্ছে বেজোস নিজেই বেতন কম নিয়ে, বিভিন্ন সিস্টেমে কোম্পানির অংশীদারদের শো করে এবং অন্যান্য চোরা সিস্টেমের সাহায্য নিয়ে ট্যাক্সের পরিমাণ একেবারে কমিয়ে আনা।
অ্যামাজনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিতেবাচক দিক হচ্ছে কোম্পানিটি সরাসরি পরিবেশের ক্ষতি করছে। তারা তাদের প্যাকেজিংয়ে এতোবেশি এফোর্ট দেবার কারণে পরিবেশে বেড়ে যাচ্ছে বর্জ্যের পরিমাণ। তবে একটি কোম্পানি রান করতে কি এতোটুকু করাই যায়? নাকি অ্যামাজন সীমা ছাড়িয়ে বহু আগেই পৃথিবীর কাছে ক্রিমিনালে পরিণত হয়েছে?
আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে দিন কমেন্টবক্সে! ব্লগটি ভাল লাগলে লাইক এবং সাবস্ক্রাইব করুন। পরবর্তী ব্লগ পড়ার আমন্ত্রন রইল।