Nestle : যে ইতিহাস আপনার অজানা । The Biggest Mafia In Food Industry
কফি লাভারদের মাঝে নেসক্যাফে (Nescafe) খুবই সুপরিচিত একটা নাম। এমনকি নেসক্যাফে ছাড়া অন্য কফি ব্রান্ডের নাম আমাদের অনেকেরই জানা নেই। আর ম্যাগি (Maggi) নুডলস খায় নি বা এর নাম শুনেনি এদেশে এমন মানুষ হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
আর বহুল পরিচিত এই দুটো ব্রান্ডের প্যারেন্ট কোম্পানি হলো নেসলে (Nestlé)। নেসলের ফুড আইটেম, চকলেটের সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। এখন অনেক প্রোডাক্ট সেল করলেও নেসলের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল কিন্তু বেবি ফুড সেল করার মাধ্যমে। এমনকি তারাই প্রথম বেবি ফুড এর কনসেপ্টটা বাজারে আনে।
কিন্তু এক সময় বেবি ফুড দিয়ে যাত্রা শুরু করা এই কোম্পানিটিকে এখন বলা হয়ে থাকে বেবি কিলার(baby killer)। কিন্তু কেন?
প্রিয় পাঠক আজকের ব্লগে আমরা আপনাদের সামনে নেসলের এমন সব তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো, যেটা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।
১৮৬০ সালের দিকে জার্মানিতে শিশুমৃত্যুর হার একদম চরম পর্যায় পৌঁছে ছিল। এদের মধ্যে বেশির ভাগ শিশুই মারা যেত অপুষ্টি জনিত কারণে। সে সময় জার্মানিতে বাস করতো হেনরী নেসলে (Henry Nestlé) নামের এক ব্যক্তি। স্ত্রীসহই ছিল তার বসবাস।
হেনরীর স্ত্রী একসময় খেয়াল করে জার্মানি প্রায় ১% মায়ের শরীরে বুকের দুধ তৈরি হয় না। আর হলেও এত কম হয়! যার কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুক্ত। আর এটি ছিল উচ্চ শিশু মৃত্যু হারের অন্যতম একটা কারণ । ঠিক এ বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে হেনরীর স্ত্রীকে। সেই সাথে হেনরী নেসলে কেও। এরপর স্ত্রীর জোরাজুরিতে হেনরী একটি বেবি ফুড ফর্মুুুলা তৈরি করে। এরপর ১৮৬৭ সালে নেসলে নামে সেটা বাজার জাত করতে শুরু করে।
ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে কোম্পানির প্রফিট আর পরিধি দুটোই বাড়তে থাকে। এদিকে চার্লস পেজ (Charles Page) নামের এক মার্কিন ব্যক্তি ১৮৬৬ সালের দিকে এংলো সুইস (Anglo Swiss) নামের একটা নতুন কোম্পানি চালু করে।
১৮৬৭ থেকে ১৯০৫ সাল অব্দি মোটামুটি এই সময়টা এংলো সুইস আর নেসলে একে অপরের বেশ ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তাদের এই প্রতিযোগিতার জোরে সে সময় মার্কেটে আর কোনো কোম্পানিই আসতে পারে নি।
১৯০৫ সালে হেনরী, নেসলে কোম্পানি থেকে পুরোপুরিভাবে রিজাইন নিয়ে নেয়। তখন নেসলে আর এংলো সুইস এর বোর্ড মেম্বাররা মিলে সিদ্ধান্ত নেয় এবং দুটো কোম্পানিকে মার্জ করে দেয়। পরে নাম হয় নেসলে এংলো সুইস কোম্পানি (Nestlé Anglo Swiss Company)।
এরপর থেকেই নেসলের মার্কেটিং আর বিজনেস স্ট্রাটেজিতে নানা রকম পরিবর্তন আসতে শুরু করে। যেখানে হেনরী এর আমলে নেসলের মাত্র ৪টি ফ্যাক্টরি ছিল ১৯১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ টিতে।
এরপর নেসলে এমন একটি বড় সিদ্ধান্ত নেয়, যা নেসলের ভবিষ্যৎ ই বদলে দেয়। নিত্য নতুন প্রোডাক্ট বাজারে নামানোর থেকে শুরু করে রাইভাল হয়ে উঠতে পারে এমন ছোট কোম্পানি বা ভবিষ্যতে ভালো করতে পারে এমন ছোট ছোট কোম্পানি গুলোকে কিনতে শুরু করে।
যেমন ১৯৪৭ সালে ম্যাগি নামের ছোট একটা কোম্পানি কিনে নেসলে একই নামে নুডুলস বাজারজাত করে । এরপর ১৯৮৮ সালে নেসলে কিটক্যাট নামের সুইস চকলেট কোম্পানি কিনে ফেলে। এভাবে প্রায় প্রতি বছরই নেসলে কোনো না কোনো ছোট কোম্পানি কিনে থাকে। যাতে করে বাজারে কোন কম্পিটিশন তৈরি না হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৭ সালে Blue Bottle Coffee নামে একটা কোম্পানি ভালো করতে শুরু করলে নেসলে সেটিও কিনে ফেলে।
এভাবে বড় হতে থাকা নেসলে বর্তমানে ১৮৯টি দেশে তাদের প্রোডাক্ট সেল করে থাকে। এতগুলো দেশের নাম সম্ভবত আমরা জানিই না। এছাড়াও বর্তমানে নেসলের রয়েছে প্রায় ৪৩০টি কোম্পানি যাতে অফিসিয়ালি কাজ করে প্রায় ৩লক্ষ মানুষ।
বর্তমানে নেসলের অধীনে রয়েছে প্রায় ২ হাজারের উপরে ব্রান্ড, আর এর আন্ডারে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার ধাচের আলাদা আলাদা প্রোডাক্ট।
এগুলোর মধ্যে নেসলের রয়েছে প্রায় ২৯টির মতো ব্রান্ড যেগুলোর সেল প্রায় ১ বিলিয়ন এর উপরে। বর্তমানে নেসলের রেভিনিউ প্রায় ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শুধুমাতে গতবছরই নেসলের রেভিনিউ করেছে প্রায় ৯৫ বিলিয়ন ডলারের।
আমাদের পরিচিত সেরিলাক (Cerelac), নিডো (Nido), নেসক্যাফে (Nescafe), ম্যাগি (Maggi), বুস্ট (Boost), কিটক্যাট (Kitkat) এসব কিন্তু নেসলের অধীনে।
প্রিয় পাঠক আগেই বলেছি নেসলেকে বর্তমানে বেবি কিলার নামে ডাকা হয়। কিন্তু কেন?
আমরা জানি একজন সন্তানের জন্য সবথেকে পুষ্টিকর খাবার হলো মায়ের দুধ। যার কোন বিকল্প নেই। যা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে শুরু করে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণেও বলা হয়েছে।
কিন্তু এখানে নেসলে তাদের মার্কেটিং একটু পরিবর্তন আনে। প্রথমে তারা বুকের দুধ এর সাথে তাদের বেবি ফুডের তুলনা না করলেও, প্রথমে একে তার বিকল্প এবং পরে সুপেরিওর হিসেবে মার্কেটিং করতে শুরু করে।
নেসলের এই মার্কেটিং এর টার্গেট ছিল মূলত উন্নয়শীল আর পিছিয়ে পড়া দেশগুলো। নেসলে এখানে আরেকটি মার্কেটিং টেকনিক ইউজ করে। তারা তাদের মহিলা সেলসম্যানদের নার্সের আদলে পোশাক পরিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে গিয়ে তারা নেসলের বেবি ফুডের ফ্রি স্যাম্পল দেওয়া শুরু করে।
এখন যেকোন সাধারন মা যদি হাসপাতালে যেয়ে দেখে নার্স বা ডাক্তারের ড্রেস পরা একজন স্যাম্পল হিসেবে একটা খাবার ফ্রীতে দিচ্ছে এবং এটাকে বুকের দুধ এর বিকল্প বা তার থেকেও ভালো বলে দাবি করছে। তাহলে যেকোন মা ই তাদের সন্তানের ভালো স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে সরল মনে সেসব বেবি ফুড কিনতো।
নেসলে এইসব বেবি ফুডের স্যাম্পল দিতো ৩০ দিনের হিসেব করে। কেননা একজন মা তার সন্তানকে ৩০ দিন অব্দি ফ্রি বুকের দুধ না খাওয়ালে প্রাকৃতিক ভাবে দুধ তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। এতে স্যাম্পল বেবি ফুড শেষ হয়ে গেলেও মা আর বাচ্চাকে খাওয়াতে পারতো না। ফলে তারা উচ্চ দামে এই বেবি ফুড আইটেমগুলো কিনতো।
নেসলে এর বেবি ফুড গুলো সাধারণত গরম পানিতে মিশিয়ে তারপর বাচ্চাদের খাওয়াতে হয়। কিন্তু গরীব দেশ যেমন আফ্রিকার অনেক দেশে যেখানে পরিষ্কার পানিরই অভাব সেখানেও তারা এসব প্রোডাক্ট সেল করতো। নিরক্ষর আফ্রিকান জনগোষ্ঠির অনেকেই ইংরেজি পড়তে পারতনা আর নেসলে তাদের এই ব্যাপারে বলতো ও না।, যার ফলে প্যাকেটের নিয়মাবলি লেখা থাকলেও মায়েরা নোংরা পানি বা অনেক সময় ঠান্ডা পানির সাথে মিশিয়ে বাচ্চাদের বেবি ফুড খাওয়াতো। এমনকি তারা এটুকুও জানতো না যে কতটুকু পানির সাথে কি পরিমানে বেবি ফুড মিশাতে হবে।
এতে করে ওই সব বাচ্চাদের পুষ্টির চাহিদা তো পূরণ হতই না বরং তারা নানা রকম শারীরিক অসুস্থতার শিকার হতে থাকে।
প্রিয় পাঠক, নেসলে এর কিটক্যাট বা নেসকেফে আমাদের মোটামুটি সকলের প্রিয়। কিন্তু এই প্রোডাক্টগুলো বানাতে দরকার পরে প্রচুর পরিমান কফি বিন।
আর এখানেই আসে নেসলের আরেকটা অন্ধকার দিক। নেসলের যে বিপুল পরিমানে কফি বিনের দরকার। এই বিন সংগ্রহ করতে তারা ব্যবহার করে শিশু শ্রমিকদের। আফ্রিকা, ব্রাজিলের বিভিন্ন অংশে নেসলের রয়েছে বিশাল বিশাল কফির বিনের বাগান। আর এখানে বেশিরভাগ কাজ করে শিশুরা।
কেননা, যেখানে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিককে বেতন ছাড়াও নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা সহ আরো অনেক মৌলিক অধিকার গুলো দিতে হয় সেখানে এইসব শিশু শ্রমিকদের মাত্র ১ ডলারের কম দিয়ে ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টার উপরে কাজ করানো যায়।
এছাড়া বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া যায় যে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে যে শিশু পাচারের ঘটনা ঘটে এসবের সাথেও নেসলে সরাসরি জড়িত। অনেক তথ্য প্রমান থাকলেও নেসলের মতো একটা জায়েন্ট কোম্পানির সামনে সেসব গরীব দেশের মানুষ এর কখনো দাঁড়ানোর সাহস হয় নি আর এটাই যেনো স্বাভাবিক আজকের এই পৃথিবীতে।
২০১৩ সালে আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের বিভিন্ন গ্রামে হূট করে চরম পানির সংকট দেখা দেয়। হাহাকার উঠে যায় পানির জন্য। আর সবাই আংগুল তোলে নেসলের দিকে।
কেননা এই নেসলেই পাকিস্তানের ওই গ্রামগুলাতে প্রবাহিত হওয়া পানির দিকগুলো পরিবর্তন করে দেয়। বা পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এরপর সেই পানিই সংগ্রহ করে বোতলজাত করে সেগুলো ওই গ্রামগুলোতেই চড়া দামে বিক্রি করা শুরু করে।
শুধু তাই নয়, নেসলের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের পুকুর নদী, খালের পানিকে ইচ্ছাকৃতভাবে দূষিত করে সেখানে পানির কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তাদের বোতল জাত পানি বিক্রি করার।
আর এভাবেই নেসলের বোতল জাত পানির ব্রান্ড নেসলে পিউর ওয়াটার বর্তমানে এক নাম্বার বোতল জাত পানির ব্রান্ড।
তো প্রিয় পাঠক আজ এ পর্যন্তই। আমাদের পছন্দের এসব ব্রান্ডগুলোর পিছনে কি ভয়ংকর সত্যি লুকিয়ে আছে তা আমাদের প্রায় সকলেরই অজানা। আমাদের পরিচিত এই ব্রান্ড যে এখনও কত মানুষের মৃত্যুর কারণ, কত শিশুর ভবিষ্যৎ নষ্টের কারণ, কত মা বাবার বুক খালি করার কারণ তা আমাদের অজানা। হয়তো আমরা কখনো জানবো না।
আজ আর না, আগামী ব্লগে আমরা আসবো এমনই কোন বিষয় নিয়ে। সেই পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। সচেতন থাকুন আর আমাদের সাথেই থাকুন। আর এ ধরণের ব্লগ পছন্দ করলে, বিজনেস ম্যানিয়ার নিউজলেটারটি Subscribe করতে ভুলবেন না।