বাংলাদেশের বাজার সিন্ডিকেট কি খুবই শক্তিশালী ? Price Hike in Ramadan 2024
পবিত্র মাহে রমজান। সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে বছর পেরিয়ে প্রশান্তির মাস। সিয়াম- সাধনার এই মাসে সাহেরি ও ইফতারে বিশ্বব্যাপী বৈচিত্র্যময় রন্ধনশিল্প দেখা যায়। ভোজনরসিক বাংলাদেশীরাও বিকল্প নয়। প্রতিবছর রমজান মাস জুড়ে বিশেষ করে ইফতারে বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের সমাহার দেখা যায় ডাইনিং টেবিলে।
কথায় আছে, “ আগামীকাল যদি কেয়ামত হত, তাহলে আজ এদেশের ব্যাবসায়ীরা তসবি ও জায়নামাজ মজুদ করে দাম বাড়িয়ে দিত। ” শুনতে হাস্যরসাত্মক মনে হলেও পবিত্র রোযার মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগাতার দাম বৃদ্ধিতে হতাশায় ছায়া থেকে উক্ত বচন ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রতি বছর রোযার আগে আগেই বাজারে যেন জিনিসপত্রের দামে আগুন লাগে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তালিকা ধরে মোটা চাল(rice), খোলা আটা (flour), সয়াবিন তেল(Soybean oil), চিনি (sugar), মসুর ডাল (lentil), ছোলা(Chickpea), পেঁয়াজ(onion), দেশি রসুন(garlic), দেশি শুকনা মরিচ(dried red chili), রুই মাছ (Salmon fish), ব্রয়লার মুরগি(Poultry chicken), গরুর মাংস(Beef), ডিম(egg), খেজুর(Date) পণ্যেগুলোর মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত রোজার তুলনায় এবার দশটা পণ্যের দাম বেশি, মাত্র পাঁচটির কম। এদিকে যে পাঁচটি পণ্যের দাম কম, সেগুলোর মূল্য গত বছর অনেক বেড়ে গিয়েছিল, তারপর কমেছে। সেগুলোর দামও চড়াই বলা যায়।
ইফতারে সাধারণ মানুষ প্রধানত ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, শসা ও ফল- মূল ইত্যাদি রাখেন। শরবত তৈরির জন্য ট্রাঙ্কের পাশাপাশি ব্যাবহৃত হয় লেবু, বেল, ডাবের পানি, আখের রস ইত্যাদি।
দুই মাস আগেই ছোলার দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছিল। এখন বেড়েছে আরও ৫ টাকা। বাজারে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকায়।বেগুনের দাম কেজি প্রতি ৬০ থেকে ৮০ টাকা থেকে বেড়ে এখন তা ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অল্প কয়েক দিন আগেও ক্ষীরার দাম ৪০ টাকার আশপাশে ছিল। এখন দাম আরো বেড়ে কেজি প্রতি ৬০-৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কেজি প্রতি শসার দামও ৬০ থেকে বেড়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি হয়েছে। লেবুর দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আকারভেদে প্রতি হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৮০ টাকা । সারাদিন রোজা রেখে এক গ্লাস শরবতে রোজাদার যে পরিতৃপ্ত হবেন, তাতেও আশঙ্কা। বাজারে এক কেজি চিনি কিনতে এখন ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা খরচ হচ্ছে। অথচ চিনির ওপর শুল্ক কমানো হয়েছিল। কিন্তু দাম কমে উল্টো বেড়েছে কেজিতে পাঁচ টাকা। ইফতারে অনেকেই খেজুরের পাশাপাশি মাল্টা, আপেল, পেয়ারা, আনারস, তরমুজ ইত্যাদি রাখার চেষ্টা করেন। ফলের দাম কেজিতে ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। যেমন এক কেজি মাল্টা ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকায় বিক্রি করতে চাইছেন বিক্রেতারা। সব মিলিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষের নাজেহাল অবস্থা।
ইফতারের পর রাতের খাবার ও সেহেরিতে স্বল্প আয়ের পরিবারে মাছ অথবা মাংস রাখার উপায় নেই। রোজার আগের দিনই মাছ কেজিতে ২০ থেকে ১০০ টাকা বেশি বাড়িয়ে দেন বিক্রেতারা । থেমে নেই মুরগি ও মাংসের দাম বাড়া।সোনালি মুরগির দাম ৩০ টাকা বেড়ে ৩৩০-৩৫০ টাকা এবং গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ১০০০ টাকায়। বাংলাদেশে যখন পণ্যের দাম এত বেশি, পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে আরব বিশ্বে প্রায় সকল পণ্যে বিভিন্ন ধরনের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এমনকি ইউরোপের অমুসলিম দেশগুলোতেও বিভিন্ন ইফতারি আইটেমে ব্যাবসায়ীদের ছাড় দিতে দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে কেন রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এত ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায় তা নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত, নানা হিসাব- নিকাশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত মাস ফেব্রুয়ারি শেষে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছর যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা লাগত, তা কিনতে এবার ফেব্রুয়ারিতে লেগেছে প্রায় ১১০ টাকা। ।বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির বড় কারণ ২০২২ সালের পর থেকে ডলারের ৪০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি। যখন দাম বাড়তে থাকে, তখন দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মূল্যস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছে। আহসান মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতির (price inflation)কষ্ট হলো, এতে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়। আর জিনিস পত্রের দাম কমাতে সরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগ পুরোপুরি সফলতার মুখ দেখেনি।
সাধারণত কোন দেশে প্রতি মাসে জিনিসপত্রের দাম ৫০ শতাংশ বেড়ে গেলে তাকে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি(high inflation rate) বলা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি দেখা গিয়েছিল ফ্রান্সে, ফরাসী বিপ্লবের সময়। সে সময় মাসিক মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৪৩ শতাংশে। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এমন মুদ্রাস্ফীতির রেকর্ড পাওয়া যায় না। কিন্তু ১৯০০ সালের পর থেকে এখন পর্যম্ত পুরো পৃথিবীতে ৫৫ বার উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ঘটনা ঘটেছে। ইউরোপ ও মধ্যএশিয়ায় সতের বার উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ল্যাটিন আমেরিকায় পাঁচটি, পশ্চিম ইউরোপে চারটি, দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায় একটি। কিন্তু পুঁজিবাদী বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনো হাইফার ইনফ্রেশনের মুখোমুখি হয়নি। তবে মার্কিনিরা মোট দুইবার হাইফার ইনফ্রেশনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রথমবার তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে গৃহযুদ্ধের সময়। এই শতাব্দীতে মূদ্রাস্ফীতির কথা উঠলেই সবার আগে আলোচনায় আসে আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ের কথা। রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে দেশটির জনগন লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হয়। এদিকে স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েকবছরে ১০ বার মূদ্রাস্ফীতির কবলে পড়েছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে হাইফার ইনফ্রেশন বা উচ্চ মূদ্রাস্ফীতির ঘটনা ঘটেছিল একবারই ১৯৭৪ সালে। বর্তমান পরিস্থিতিতে উচ্চ দ্রব্যমূল্য অতীত ইতিহাসকে আলোচনায় টেনে আনছে। কোভিড পরিস্থিতি ও রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর অনেক দেশেই মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াও এর ব্যাতিক্রম নয়। বিশেষ করে প্রতিবেশী পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গিয়ে প্রায় অচল অবস্থা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু খাদের তলা থেকে শ্রীলঙ্কাসহ অন্য দেশগুলো একটু একটু করে উঠে এসে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেও বাংলাদেশ এখনো তা পারেনি। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বুঝা যাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি ক্রমাগত আরো বৃদ্ধি পাবে।
বাংলা দেশে সিন্ডিকেট কি খুবই শক্তিশালী?
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এক সাংসদ বলেন “ দাম কমাতে বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক কমানো হয়ছে। কিন্তু বাজারে সেসব পণ্যের দাম কমেনি। কেন আমরা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না? সিন্ডিকেট কি এত বেশি শক্তিশালী?”
তিনি আরো বলেন, “মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ অনেক কষ্ট পাচ্ছে। দুর্বল ব্যাংকিং খাত, ডলারের বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা, রিজার্ভ কমে যাওয়া সামগ্রিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।”
অজুহাত হিসেবে এখন ব্যাবসায়িরা কোভিড-১৯ মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কথা টেনে আনা হয়। কিন্তু আমেরিকা, জাপান এমনকি পার্শবর্তি দেশ ভারত সহ অনেক দেশই এই শঙ্কট কাটিয়ে উঠেছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পারছে না।
আসল ব্যাপারটা হল গুটিকয়েক ক্ষমতাশালী ব্যাবসায়ী ভোগ্যপণ্য আমদানি ও গুদামজাতকরণের পুরো প্রক্রিয়া নিজেদের করায়ত্ব করে নিয়েছেন। তারা অধিক মুনাফার লোভে অবৈধভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রাখে। যার ফলে জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত উর্ধ্বমুখী।
মাহে রমজানের মাসে পৃথিবীর অন্য সবদেশের ব্যাবসায়ীদের সংযম দেখা যায়। অসংযমী কেবল আমাদের দেশের ব্যাবসায়ীরা। কেউ জানেনা এর শেষ কোথায়। এরইমধ্যে বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। ইতোমধ্যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সামনের বছরগুলোতে আরো বাড়বে বিদ্যুৎ এর দাম। কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহ দিয়ে এই সেবা যে চাহিদামত সরবরাহ করা হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আধুনিক সভ্যতা বিদ্যুৎ ছাড়া অচল।তাই এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে আবাসিক বাসা- বাড়ি, দোকান- পাট, কল- কারখানা, হাসপাতালে প্রতিটি সেক্টরে। বিদ্যুৎ এর দাম বেড়ে যাওয়ায় কারখানাগুলোতে জ্বালানির অভাবে উৎপাদন কমে যাবে। ফলে চাহিদার তুলনায় যোগান কমে যাওযায় স্হানীয় ভাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম আরো বাড়বে। একইসাথে বিদেশি পণ্যের উপর আমদানি নির্ভরতা তৈরি হবে। সিন্ডিকেট তো আর বসে থাকবে না। তখন তারা বিদেশ থেকে আমদানি করা বাড়তি পণ্যের উপর অধিক মুনাফার লালসায়, সেগুলো গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করবে এবং চওড়া দামে বাজারে ছাড়বে। মুদ্রাস্ফীতির সাথে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর জার্মানি যখন মিত্র শক্তির চাপিয়ে দেওয়া ক্ষতিপূরণ দিতে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন জার্মান সরকার অধিক পরিমাণে নোট ছাপিয়ে অর্থনৈতিক দুরাবস্থার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সরকারও নোট ছাপিয়ে কোনরকমে সংকট মোকাবেলার চেষ্টা করে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? নোট ছাপিয়ে কখনো অর্থনৈতিক উন্নতি করা সম্ভব নয়। আর এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করে কৃচ্ছসাধন এবং সিন্ডিকেটের দুরভিসন্ধি কঠোর হস্তে দমন করা।
রমজান মাস আত্বশুদ্ধির একটা মাস । যে মাসে ধনী গরীব সবাই একই কাতারে এসে মিলিত হয়। কিন্তু কিছু দুরভিসন্ধি মূলক ব্যাবসায়ির কারনে সাধারণ জনগনের যে দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা অচিরে যেন বন্ধ হয় আমরা সে কামনা করি। আগামী ব্লগে আপনারা কোন বিষয় নিয়ে ভিডিও দেখতে চান আমাদের কমেন্ট করে যানাতে পারেন। সেই অব্দি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আমাদের সাথেই থাকুন। আর এ ধরণের ব্লগ পছন্দ করলে, নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ ।