সেন্ট মার্টিন ঘিরে বিশ্ব-অর্থনীতির কূটকৌশল | Saint Martin Island | Business Mania
গত ১১ জুন মায়ানমারের একটি অজ্ঞাত সশস্ত্র গোষ্ঠী টেকনাফ-সেন্টমার্টিননাফ নদীর টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে একটি দ্বীপগামী স্পিড বোটে গুলি চালায়। এর পর বেশ কয়েকদিন, সেন্ট মার্টিন রুটে মিয়ানমারের যুদ্ধজাহাজও ঘোরাফেরা করে আসছিল । এই ঘটনায় বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে প্রায় ১২ দিন সেন্টমার্টিন দ্বীপের বসবাসরত জনগন ও ঘুরতে আসা পর্যটক বিচ্ছিন্ন থাকে । দেখা দেয় তীব্র খাদ্য সঙ্কট, বাড়তে থাকে উত্তেজনা।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান যদিও বলেন কামাল বলেন, “মিয়ানমার নিশ্চিত করেছে যে তাদের সৈন্যরা তাদের ভিন্নমতাবলম্বী আরাকান আর্মিদের ওপর গুলি চালাচ্ছে”
এর আগে ২০১৮ সালে মায়ানমার তাদের মানচিত্রে সেন্ট মার্টিনকে মায়ানমারের অংশ হিসেবে দেখায়
এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তাদের তীব্র কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকার তখন মায়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে, কড়া প্রতিবাদ জানায় এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার কথা স্পষ্ট করে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মাঝে এক অজানা সঙ্কা নিয়ে আসে “ আসলে কি সেইন্ট মার্টিন দ্বীপ হারাতে চলেছি আমরা?”
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ভরপুর একটি ছোট্ট দ্বীপ, সেইন্ট মার্টিন (Saint Martin) । পর্যটনের জন্য তো বটেই, দেশে বিদেশে এ দ্বীপটি নিয়ে মানুষের কৌতূহল অনেক।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ১৮৯০ সালে ১৩টির মতো আদিবাসী রাখাইন ও বাঙালি পরিবার সর্বপ্রথম এ দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। মূলত নারিকেল গাছের প্রাধান্য থাকায় স্থানীয় অধিবাসীরা এটিকে নারিকেল ‘জিঞ্জিরা’ বলে ডাকত। আরবি ‘জিঞ্জিরা’ অর্থ সমুদ্রবেষ্টিত উপদ্বীপ। ১৯০০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে সম্পন্ন ভূমি জরিপের সময় এ দ্বীপটিকে ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও সে সময় বার্মা তথা মিয়ানমার ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিল। তারপরও দ্বীপটির অবস্থানগত কারণে এটিকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত না করে ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে ১৯৪৭-এর পরে এটি বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে পড়ে যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে এই দ্বীপটি নতুন রাষ্ট্রের মানচিত্রে সম্পূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমার উপকূল থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় সেন্টমার্টিন দ্বীপের অবস্থান। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দ্বীপ তার জন্মলগ্ন থেকেই উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরসংলগ্ন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অঞ্ছল হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই এদেশের পর্যটন অর্থনীতিতে এ দ্বীপের অবস্থান অনস্বীকার্য। জনবহুল বাংলাদেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র এ সেন্টমার্টিন দ্বীপ।
সেইন্ট মার্টিনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এর অবস্থান খুবই কৌশলগত ভাবে খুবি গুরুত্বপুর্ন।
বঙ্গোপসাগরের ঠিক একদম দক্ষিণে, যেখানে বাংলাদেশের শেষ সীমানা সেখানেই অবস্থান করছে সেইন্ট মার্টিন । এর আশপাশে আছে ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, আরেকদিকে আছে মায়ানমার। ফলে এই জায়গাটি ভৌগলিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বহু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জাহাজগুলো চলাচল করার পথ হল বঙ্গপোসাগর। বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যের এক বিশাল অংশ এই পথ হয়ে।
চীন, জাপান বা কোরিয়ার মতো দেশগুলো তাদের তেল ও পণ্য আমদানি করে এই পথ দিয়েই। বঙ্গোপসাগরের এই অংশটি ভারত মহাসাগরের সাথে যুক্ত, যা এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুটের মধ্যে পড়ে। ফলে, এই জায়গাটা যদি কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে পুরো এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বাণিজ্যের উপর তার একটা বিশাল প্রভাব থাকবে।
ভূমধ্যসাগর থেকে যে বাণিজ্য পথ চলে আসে, সেটা এই অঞ্চল দিয়ে আসতে হয়। তাছাড়া, মালাক্কা প্রণালী হয়ে বিশাল পরিমাণ জাহাজ আসে এই দিক দিয়েই।
ভারত বাংলাদেশ হতে বন্দর সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থার দেরি দেখে ২০১৬ সালে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে প্রায় ১২০ মিলিয়ন ইউএস ডলার বিনিয়োগে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিয়েত্তে’তে ‘সিয়েত্তে পোর্ট’ নামে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলে।
মিয়ানমারের কালাদান নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা এ গভীর সমুদ্রবন্দর ভারতের ‘কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট’(Kaladan Multi-Mode Transit Transport Project) নামক বহুমুখী প্রকল্পের অংশ, যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন ও চীন প্রদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য ও পরিষেবা পরিবহণের লক্ষ্যে যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলা। এ অঞ্চলে ভারতের তৎপরতা তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চীনের জন্য সবসময়ে বিরাট উদ্বেগের বিষয়। কারণ, চীন সর্বদাই মিয়ানমারের মতো বিশ্বস্ত বন্ধুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের এসব আঞ্চলিক প্রকল্পে নজরদারির ক্ষেত্রে খুবই তৎপর।
চীনের কুনমিং থেকে মিয়ানমারের শান প্রদেশ হয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এশিয়ান হাইওয়ে বাস্তবায়নে চীন বেশ সক্রিয়। আবার মিয়ানমারের ঘুমধুম হয়ে বাংলাদেশের টেকনাফের ঝিলাংঝা দিয়ে দোহাজারী পর্যন্ত ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে প্রকল্পতেও রয়েছে চীনের বিপুল বিনিয়োগ। ফলে ভারতকে দমন ও চীনের নিজ স্বার্থের উন্নয়নে উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের এ উপকূলীয় অঞ্চল চীনের কাছে ভূ-অর্থনৈতিক দিক থেকে বিরাট গুরুত্ব বহন করে।
বিশ্বের ৮০টি দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫০টি সামরিক ঘাঁটি আছে। এই সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র শক্তির সামরিক ঘাঁটি আছে। ভৌগোলিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রবেশদ্বার হচ্ছে বাংলাদেশ। সর্বোপরি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশ! বাংলাদেশের এই ভৌগোলিক অবস্থান সেন্টমার্টিনে মার্কিন ঘাঁটি স্থাপিত হলে , তা চীনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে । বঙ্গোপসাগরের প্রবেশদ্বারে থাকা সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মার্কিন বেস, চীনের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য পথগুলোর ওপর আমেরিকার সরাসরি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ তৈরি হবে । এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের নৌ চলাচল ও সামরিক তৎপরতার ওপরও চাপ তৈরি করতে পারবে আমেরিকা, যা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করার একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কখনও ওই বিষয়টি না বললেও এ কথা সত্য যে তাদের চলমান চীন মোকাবিলার নীতির জন্য বঙ্গোপসাগরের জলরাশিতে নিয়মিত সামরিক উপস্থিতি দরকার। তাদের সাম্প্রতিক দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ নীতিতে তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তারা অতীতের চেয়ে বেশি জোর দিয়েছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে তাদের অস্ত্রশস্ত্র যুক্ত করতে এবং সামরিক সদস্যদের অধিক সংখ্যক প্রশিক্ষণ প্রদানে তারা বেশ আগ্রহী।
সেইন্ট মার্টিন দ্বীপটি বঙ্গোপসাগরের এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যেখানে অনেক ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে, সমুদ্রের তলদেশে প্রচুর পরিমাণে তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ থাকার সম্ভাবনা এখানে রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারনা করে। এই সম্পদগুলো উত্তোলন করা গেলে, বাংলাদেশ তার জ্বালানি খাতে বিশাল লাভবান হতে পারে। কিন্তু এই সম্পদগুলোর দিকে নজর শুধু বাংলাদেশের নয়। চীন, ভারত, এমনকি মায়ানমারও এই সম্পদগুলো নিজ দখলে আনতে চায়।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আশপাশ দিয়ে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং আরও অনেক দেশের পণ্য এবং জ্বালানি আমদানি হয়। এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের রুট থাকার কারণে এর সামরিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বর্তমানে অনেক বেড়ে গিয়েছে। যদি এই দ্বীপ কোন কারণে অন্য কোনো দেশের হাতে চলে যায়, তাহলে পুরো অঞ্চলের বাণিজ্যিক ও কৌশলগত ভারসাম্য বদলে যেতে পারে।
এ অঞ্চলের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর দমন ও নজরদারি করা এবং বঙ্গোপসাগরের সম্ভাবনাময় Blu ইকোনমির হাতছানি হয়তো সেন্টমার্টিন দ্বীপকে মার্কিনিদের কাছে বেশ গুরুত্ববহ করে তুলেছে; যা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সেন্টমার্টিন তথা বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।শেষ পর্যন্ত কি হতে পারে? এই দ্বীপ কি বাংলাদেশের অধীনে থাকবে, নাকি এর উপর অন্য কোনো দেশের নজর আরও বাড়বে? ভবিষ্যতে এই দ্বীপকে কেন্দ্র করে বড় কোনো আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে । অথবা বাংলাদেশ এই দ্বীপের কৌশলগত গুরুত্ব বুঝে উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিয়ে হয়তো একে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক হাব হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এ কারণে সেইন্ট মার্টিনের মতো উপকূলবর্তী দ্বীপগুলোতে বাস্তুসংস্থানগত ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি উন্নয়নের অনেক সুযোগও রয়েছে। বাংলাদেশের যদি এই দ্বীপে টেকসই উন্নয়নের পরিকল্পনা থাকে, তবে এটি শুধু পর্যটনের জন্য নয়, জ্বালানি, বাণিজ্য এবং সামুদ্রিক গবেষণার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
এ বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে , পৃথিবীর বড় বড় দেশগুলো তাদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য এই ধরনের কৌশলগত জায়গাগুলোতে বিশেষভাবে নজর রাখে। এমনও হতে পারে, ভবিষ্যতে আমরা এখানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বা সংঘর্ষও দেখতে পারি। বাংলাদেশের জন্য এই দ্বীপের গুরুত্ব যে কতটা, সেটা সময়ের সাথে আরও পরিষ্কার হবে।
জন সচেতনতার জন্য ব্লগটি শেয়ার করুন আপনার পরিজনের সাথে। ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে মন্তব্য জানান কমেন্ট বক্সে, পরবর্তি ব্লগ পড়তে বিজনেস ম্যানিয়ার নিউজলেটারটি সাবসস্ক্রাইব করুন।