দেউলিয়া থেকে রয়াল এনফিল্ড যেভাবে বিশ্বসেরা হল | Royal Enfield | Business Mania
শক্তিশালী ইঞ্জিনের (Engine) শব্দ, স্টাইলের অনন্যতা, আর রাস্তায় রাজত্ব করার গর্ব . বাইকপ্রেমীদের কাছে Royal Enfield এর বাইক যেন শুধুই একটি যান নয়, বরং জীবনের এক অংশ। আর সেই অনুভূতিকে নিয়ে আসতে বাংলাদেশে কবে আসছে বহু প্রতীক্ষিত এই ব্র্যান্ডটি , যার জন্য হাজারো বাইকার অপেক্ষা করছে?
গুঞ্জন ছিল, বাইকের এই কিংবদন্তি ব্র্যান্ড (Brand) শীঘ্রই বাংলাদেশের রাস্তায় দেখা যাবে। আমাদের আশেপাশের দেশগুলোতে এটি অনেক আগেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশে এর আসা নিয়ে ছিল অনেক কৌতূহল। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ করে গত অক্টোবর এর ২১ তারিখ বাংলাদেশের বাজারে ছাড়া হয় এই বাইকটি। আর বাজারে আসার পরই হাজারো তরুণের ধরাছোঁয়ার মাঝে চলে আসে রয়েল এনফিল্ড (Royal Enfield)।
কিন্তু কি আছে এই বাইকে যার যে কোনো বাইকারের মাঝে এত জনপ্রিয়? কিভাবে হলো Royal Enfield এর উত্থান,কিভাবে ব্র্যান্ডটি বিশ্ব বাজারে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাই নিয়ে Business Manier আজকের ব্লগ পোস্ট।
রয়েল এনফিল্ডের (Royal Enfield) ইতিহাস শুরু হয় ১৮৯১ সালে, যখন কোম্পানিটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডের (England) রেডডিচে (Redditch)। শুরুতে এটি সাইকেল প্রস্তুতকারক ছিল, কিন্তু ১৯০১ সালে, কোম্পানিটি তাদের প্রথম মোটরসাইকেল (Motorcycle) বাজারে আনে, যা তাদের বিশ্বব্যাপী পরিচিতি এনে দেয়।
বিশেষত, রয়েল এনফিল্ডের (Royal Enfield) বাইকগুলি ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর জন্য ব্যবহৃত হত, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জনপ্রিয়তা পায়। এই যুদ্ধকালীন সময়ে, রয়েল এনফিল্ডের (Royal Enfield) বাইকগুলো প্রধানত বাহিনীর সরবরাহ এবং যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হতো।
যুদ্ধের পর, কোম্পানিটি তার ব্যবসা প্রসারিত করা শুরু করে এবং ১৯৫৫ সালে মাদ্রাজের একটি কোম্পানির সাথে যৌথ উদ্যোগে ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করে। ভারতীয় বাজারে আসার পর, রয়েল এনফিল্ড (Royal Enfield) দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে, কারণ এটি যুবকদের মধ্যে স্বাধীনতার একটি প্রতীক হিসেবে পরিগণিত হয়। কোম্পানিটি তখন ‘বুলেট (Bullet)’ মডেলটি লঞ্চ করে, যা দ্রুত বাইকপ্রেমীদের মধ্যে একটি আইকনিক (Iconic) মডেল হয়ে ওঠে। ১৯৬২ সালে, রয়েল এনফিল্ডের উৎপাদন একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছায় যখন ভারত সরকার অটো মোবাইল (Auto Mobile) শিল্পকে সমর্থন দিতে শুরু করে।
একদিকে, কোম্পানির জনপ্রিয়তা বাড়ছিল, অন্যদিকে, প্রতিযোগিতা এবং প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রাখতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে রয়েল এনফিল্ড তার অবস্থান ধরে রাখতে পারছিল না।
১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকে, রয়েল এনফিল্ড (Royal Enfield) প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়, বিশেষত নতুন প্রযুক্তির বাইক কোম্পানিগুলোর কারণে। এই সময়ের মধ্যে, বিশ্বব্যাপী বাজারে নতুন ধরনের হালকা এবং দ্রুতগতির বাইক বাজারে আসতে শুরু করে, যা তরুণদের কাছে অধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রয়েল এনফিল্ডের ভারী এবং পুরনো ডিজাইন, আর বাজারে টিকতে পারছিল না। কোম্পানিটি সময়োপযোগী আপডেট (Update) আনতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে বিক্রি কমে যেতে থাকে।
এর সাথে যোগ হয় আর্থিক সমস্যা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা, যা কোম্পানিটিকে প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে নিয়ে যায়। ১৯৭১ সালে, রয়েল এনফিল্ডের ইংল্যান্ডের কারখানা বন্ধ হয়ে যায় এবং ভারতীয় অংশটি কেবল টিকে থাকে, কিন্তু সেটা খুবই সীমিত পরিসরে।
এই সংকটকালে, কোম্পানির মান উন্নয়নে অযোগ্যতা এবং দুর্বল মার্কেটিং বাইকটির ক্রমাগত পতনের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাইকের নতুন প্রযুক্তির অভাব এবং আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তার বিরুদ্ধে অবহেলার কারণে একসময় প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় কোম্পানিটি।
তবে এ কাল বেশি দিন দেখতে হয়নি ব্র্যান্ডটিকে। কোম্পানির নতুন অধ্যায় শুরু হয় যখন ২০০০ সালের দিকে ২৬ বছর বয়সী ভারতীয় শিল্পপতি সিদ্ধার্থ লাল রয়েল এনফিল্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লাল কোম্পানির প্রধান হওয়ার পর প্রথমেই কোম্পানির মূল বিষয়বস্তুতে মনোযোগ দেন, ক্লাসিক ডিজাইন (Classic Design), প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডিং (Premium Branding), এবং নতুন প্রযুক্তির মিশ্রণ। তিনি ঐতিহ্যবাহী ‘বুলেট (Bullet)’ মডেলটি আপডেট করেন এবং বাজারে নতুন মডেল নিয়ে আসেন, যেমন ক্লাসিক ৩৫০ (Classic 350) এবং হিমালয়ান (Himalayan)।
এছাড়া, উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন, যার ফলে বাইকের মান এবং আন্তর্জাতিক বাজারে গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। সিদ্ধার্থ লালের নেতৃত্বের মাধ্যমে রয়েল এনফিল্ড (Royal Enfield) কেবল ভারতে নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ব্র্যান্ডের প্রতি নতুন দর্শন যুক্ত করেন, যা কোম্পানির জন্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়।
ব্র্যান্ডিংয়ের (Branding) ক্ষেত্রে, সিদ্ধার্থ লাল একটি দৃঢ় বাজারজাতকরণ কৌশল গ্রহণ করেন। তিনি বাইকপ্রেমীদের কাছে রয়েল এনফিল্ডকে একটি লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড (Lifestyle brand) হিসেবে উপস্থাপন করেন, যা তাদের স্বাধীনের প্রতীক। এই কৌশলের ফলে, বাইকটি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ইভেন্টে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে।
তদুপরি, কোম্পানির আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের ফলে, রয়েল এনফিল্ডের বিক্রি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ২০১৭ সালে, ভারতীয় বাজারের বাইরের বিক্রিতে রেকর্ড বৃদ্ধি ঘটে, এবং রয়েল এনফিল্ড (Royal Enfield) ইউরোপ (Europe), আমেরিকা (America), এবং অস্ট্রেলিয়াসহ (Australia) বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করে । এই নতুন বৃদ্ধির মাধ্যমে, রয়েল এনফিল্ড আবারো একটি শীর্ষস্থানীয় মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড(Motorcycle brand) হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, যা বাইকপ্রেমীদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নেয়।
রয়েল এনফিল্ডের জনপ্রিয়তা শুধুমাত্র তার ঐতিহ্যবাহী ডিজাইন কিংবা শক্তিশালী ইঞ্জিনের জন্য নয় । এর ক্লাসিক ডিজাইন(Classic design) তরুণদের মধ্যে রোমাঞ্চের অনুভূতি জাগায়।
রয়েল এনফিল্ডের মধ্যে বেশ কিছু বিখ্যাত মডেল রয়েছে, যা বাইকপ্রেমীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ক্লাসিক ৩৫০ (Classic 350), বুলেট ৫০০ (Bullet) এবং হিমালয়ান (Himalayan) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ক্লাসিক ৩৫০ রয়েল এনফিল্ডের সর্বাধিক বিক্রীত মডেলগুলোর মধ্যে একটি। এর শক্তিশালী ইঞ্জিন এবং স্মার্ট ডিজাইন বাইকারদের একটি অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে। বুলেট(Bullet) ৫০০ তার ভারী এবং মজবুত ডিজাইনের জন্য পরিচিত। এই মডেলটি বাইকারদের সত্তরের দশকের আদর্শ রাইডিংয়ের অভিজ্ঞতা দেয়। আর হিমালয়ান অ্যাডভেঞ্চার (Himalayan Adventure) বাইকপ্রেমীদের জন্য একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় মডেল, যার টেকসই নির্মাণ এবং অফ-রোড সক্ষমতা সব ধরনের রাইডারদের জন্য উপযুক্ত।
তবে প্রশ্ন উঠে, কেন এতদিন বাংলাদেশে আসেনি রয়েল এনফিল্ড (Royal Enfield)? এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, দেশটির বাইক বাজারে আইন ও নীতিমালা বেশ কঠিন ছিল। বাংলাদেশে ১৬০ সিসি(160cc) এর অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন বাইক নিষিদ্ধ ছিল। যার কারণে আমদানি করাও সম্ভব ছিলনা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদের মধ্যে রয়েল এনফিল্ডের প্রতি আগ্রহ থাকলেও, বিপণন কৌশলগত কারণে কোম্পানিটি তার অবস্থান স্থাপন করতে পারেনি।
এছাড়া, বাজারে প্রতিযোগিতাও একটি বড় ফ্যাক্টর (Factor)। দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে রয়েল এনফিল্ডকে তার মূল্যায়ন নতুন করে করতে হয়। তাই এতদিন পরেও বাইকটি দেশের বাজারে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দামের দিক থেকে, রয়েল এনফিল্ডের দাম অন্যান্য প্রিমিয়াম (Premium) বাইকের তুলনায় কিছুটা বেশি। ক্লাসিক ৩৫০(Classic 350) এর দাম ভারতীয় বাজারে প্রায় ১.৮ লাখ টাকা, যা বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক যাত্রা করার পরে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে আনুমানিক ৩.৫০ থেকে ৪.৫০ লাখ টাকার মধ্যে । এই মূল্য অন্যান্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের তুলনায় কিছুটা বেশি হলেও, রয়েল এনফিল্ডের ব্র্যান্ড ভ্যালু (Brand value) এবং ঐতিহ্যকে বিবেচনা করলে এটি একটি গ্রহণযোগ্য মূল্য।
রয়েল এনফিল্ডের ব্রান্ডিংও তার জনপ্রিয়তার একটি বড় অংশ। বাইকটিকে জীবনযাত্রার একটি অংশ হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে, সিনেমা ও পপ কালচারে (Pop-Culture) বাইকটির উপস্থিতি এর আবেদন বাড়িয়েছে। বিভিন্ন বলিউড সিনেমা এবং সিরিজে রয়েল এনফিল্ডের রাইডারদের চিত্রায়ণ করে এটি যুবক সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে রয়েল এনফিল্ড একটি উচ্চমানের ও স্টাইলিশ (Stylish) বাইক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সবশেষে, রয়েল এনফিল্ডের জনপ্রিয়তা এবং বাংলাদেশের বাজারে আসার অপেক্ষা উভয়ই বাইকপ্রেমীদের জন্য একটি নতুন অধ্যায় শুরু করেছে।
রয়েল এনফিল্ডের যাত্রা একটি চিত্তাকর্ষক কাহিনী, যা ইতিহাস, সংকট, এবং পুনরুজ্জীবনের চিত্র তুলে ধরে। বাইকপ্রেমীদের সবকিছুই রয়েল এনফিল্ডের প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের বাজারে কিংবদন্তি ব্র্যান্ডটির এর আগমনে বাংলাদেশে মোটরসাইকেল সংস্কৃতিতে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে ।
একদিকে, রয়েল এনফিল্ডের জনপ্রিয়তা আরেকদিকে, নতুন বাজারে প্রবেশের ফলে ব্র্যান্ডটির সম্ভাবনাকে আরও উজ্জ্বল করবে। তাহলে প্রশ্ন থাকে ,এই অপেক্ষার ফল কি সত্যিই পাওয়া যাবে? সময়ের সাথে সাথে আমরা দেখব, রয়েল এনফিল্ড বাংলাদেশে কিভাবে তার ঐতিহ্য এবং নতুনত্বের সমন্বয়ে নতুন একটি অধ্যায় রচনা করে।
কেমন লাগলো আমাদের আজকের ব্লগটি? কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। ভালো লাগলে লাইক দিন, নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং শেয়ার করুন।