Sridhar Vembu ও Zoho Corp এর বিস্ময়কর উত্থান।
কল্পনা করুন লুঙ্গি পড়া গ্রামের সহজ সরল ভদ্রলোক যিনি বাইসাইকেলে ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামে, সেই তিনি কিনা এমন এক কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা যাদের বার্ষিক আয় প্রায় ১০০ কোটি ডলার , তার অধীনে দেশে বিদেশে প্রায় ১২০০০ হাজারেরও বেশি মানুষ কাজ করে, আর তার নিজের আর্থিক মুল্য বর্তমানে প্রায় ৩৭০ কোটি ডলার!!
শুধু তাই নয়! সিলিকন ভ্যালির(Silicon Valley) সেরা টেক জায়ান্টদের সাথে তুলনা করা হয় তার কোম্পানিটিকে।
টয়োটা, ডেল, মার্সিডিজ, পুমা (Toyota, Dale, Mercedes, Puma)সহ বিশ্বের নামি দামী সব কোম্পানী এই স্টার্ট আপ টির ক্লায়েন্টের তালিকায় রয়েছে । কিন্তু অনেকে আবার নাম পর্যন্ত শোনেনি কোম্পানীটির।
বলছিলাম যোহো (Zoho) কর্পোরেশন আর এর ফাউন্ডার শ্রীধর ভেম্বুর(Sridhar Vembu) কথা ! কিন্তু কিভাবে যোহো হয়ে উঠলো পৃথিবীর মস্তবড় টেক কোম্পানি? কিভাবে গ্রামের এক সহজ–সরল ব্যাক্তি জন্ম দিলো এক কোম্পানীর যারা বড় বড় টেক হাব কেও টেক্কা দিচ্ছে ?
যোহো প্রতিষ্ঠাতার গল্পঃ
তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভুরে ( Thanjavur) জন্ম নেওয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শ্রীধরের ছোটবেলা থেকেই ছিল নতুন কিছু শেখার ঝোক। প্রচলিত শিক্ষার বাইরেও তিনি নিজ থেকে অনেক কিছু শিখতে চাইতেন। আর তাই দিনের বেশিরভাগ সময় শ্রীধর কে পাওয়া যেত লাইব্রেরি বই পড়া অবস্থায়। শেখার প্রতি এই ভালোবাসা পরবর্তিতে তাকে একজন সফল উদ্যোক্তা হতে সাহায্য করেছে।
এর আগে তিনি মাদ্রাসের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বা IIT থেকে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার স্নাতক, এরপর আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি (Princeton) পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এমন একাডেমিক যোগ্যতা থাকার পরও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে পাওয়া ভালো বেতনের চাকরিটিকে “না” করে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র উদ্যোক্তা হওয়ার বাসনায়!
শ্রীধর তার ভাইয়ের সাথে মিলে ১৯৯৬ সালে এডভান্ট নেট এএনসি ( AdventNet ANC) নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত করে। যা পরে জোহো কর্পোরেশনে পরিণত হয়!
এডভান্ট নেট কোন ধরনের ঋন বা বাইরের বিনিয়োগ ছাড়া আত্মনির্ভরশীল ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে চেয়েছিল। তাই তারা সবসময় ব্যবসা থেকে করা মুনাফা আবার রি ইনভেস্টমেন্ট করত।
এডভান্ট নেট এর শুরুর বছরগুলিতে, তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখেছিল, যে উদ্ভাবন যেমন ব্যবসায় বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি তা বিক্রয় এবং বিপণন করার পেছনে সমান মনোযোগ লাগে । শ্রীধর ভেম্বু তাই তার কর্মিদের ভাল বিক্রয় কৌশলের গুরুত্ব শেখানোর দিকেও মনোনিবেশ করেছিলেন ।আর এভাবেই শুরু হয় জোহোর ছোট স্টার্টআপ থেকে বড়সড় গ্লোবাল টেক পাওয়ার হাউসে পরিণত হবার কঠিন যাত্রা।
এই যাত্রায় শুরুতে কোম্পানিটি কেবল নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট সলিউশন প্রদানের উপর ফোকাস করে৷ শুরুতে তারা গ্রাহক হিসাবে টার্গেট করে টেলিযোগাযোগ এবং নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম বিক্রি করে এমনকিছু সেলারকে।
শুরুতে জোহোর মার্কেটিং(Marketing) টেকনিকঃ
শুধুমাত্র সার্ভিসের কোয়ালিটিকেই শুরুতে শ্রীধর অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলো। যার কারণে জোহো টিম বেশ দ্রুতই তাদের সার্ভিস সেলিংয়ের মাত্রাকে বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়।
রিব্র্যান্ডিং(Re-branding):
২০০০ সালের মাঝামাঝি শ্রীধর এবং তার টিম লক্ষ্য করে মার্কেটে ইন্টারনেটের উত্থান এবং ক্লাউড কম্পিউটিং বেশ ভালোই সাড়া পাচ্ছে। সুযোগ বুঝেই নিজেদের আপডেট করার কাজে নামে শ্রীধর এবং তার টিম। লক্ষ্য একটাই এবং সেটি হলো তাদের কোম্পানীকে ধীরে ধীরে SaaS বা সফটওয়্যার এস এ সার্ভিস অ্যাপ্লিকেশন রিলেটেড সেবার দিকে নিয়ে যাওয়া।
২০০৫ সালে এসে জোহো তার প্রথম SaaS অ্যাপ্লিকেশন, জোহো সিআরএম চালু করে। বলে রাখা ভালো জোহো কোম্পানির জন্য এটি ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। কারণ বিজনেস রিলেটেড অ্যাপ্লিকেশন মার্কেটে এডভান্ট নেট CRM সাহায্যেই কোম্পানিটি নিজেদের দারুণ মার্কেট তৈরির সুযোগ পায়।
জোহো উত্থান
২০০৯ সালে শ্রীধর ইন্ডিয়া এসে জোহো কর্পোরেশন নামে কোম্পানি লিস্টিং করে। এবং সম্প্রতি যোহো ব্যবহারকারী গ্রাহক সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে এবং CNBC তথ্য অনুযায়ি যোহো বিশ্বের প্রথম বুটস্ট্রাপ SaaS কোম্পানী যারা এই মাইলফলক ছুয়েছে।
আর জোহোর এই উত্থান বা রিব্র্যান্ডিংয়ে কেবল তাদের নাম পরিবর্তনটাই সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় ছিলো না! বরং এর চাইতেও ইন্টারেস্টিং বিষয় ছিলো কোম্পানিটির নতুন CRM সিস্টেমের যাত্রা।
কারণ এই নতুন CRM সিস্টেমে জোহো কর্পোরেশন অ্যাকাউন্টিং, ইমেল, প্রজেক্ট পরিচালনা সহ একটি বিজনেস রান করার সকল টুকিটাকি সিস্টেমের উপর সার্ভিস নিয়ে কাজ করা শুরু করেছিলো।
এ–সময় কোম্পানিটি জোহো মেইল, জোহো প্রজেক্টস, জোহো বুকস এবং জোহো ইনভয়েস সহ ৫৫ টিরও বেশি বিভিন্ন ক্যাটাগরির অ্যাপ্লিকেশন অফার করতে শুরু করে।
একটু খেয়াল করলে দেখা যায় জোহো কর্পোরেশন বছরের পর বছর ধরে, নিজেদের সার্ভিসের পরিমাণকে বাড়ানোর চেষ্টা করেছে! আর এই বিষয়টিই কোম্পানিকে করে তুলেছে সময়ের কম্পিটিভ টেক জায়ান্টে।
সফলতার কারণ
নিজেকে সফল করতে জোহো নতুন নতুন সার্ভিস যুক্ত করার পাশাপাশি ছোট এবং মাঝারি আকারের ব্যবসায়ীদের জন্য সকল সার্ভিস অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে প্রদান করার ঘোষনা দেয়। ফলে কোম্পানিটি মার্কেটের অন্যান্য টেক জায়ান্টদের পেছনে ফেলে সার্ভিস প্রদানের দিক দিয়ে অনেকটাই এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
পাশাপাশি জোহোকে সফল ব্র্যান্ডে তৈরি করতে শ্রীধর সেরা মানের কর্মী পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগ দেয়। সাংগঠনিক কাঠামো বজায় রাখার উপর জোর দিতে তিনি কর্মীদের জন্যে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। যা সমসাময়িক কোম্পানিদের জন্যে বেশ বিরল ছিলো। অন্যদিকে এই গুণের কারণে জোহোর কর্মীদের সেরা মানের সার্ভিস দেওয়ার মাধ্যমে টেক দুনিয়ায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করে বসে। সবমিলিয়ে কর্মীদের ওপর করা ইনভেস্টমেন্ট শ্রীধর এবং তার কোম্পানিকে দ্রুত সফলতার দিকে ধাবিত করে।
অন্যদিকে জোহো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশে নিজেদের ব্রাঞ্চ খুলতে শুরু করে। পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকা সহ ভারতের অন্যান্য অংশেও নিজেদের ব্রাঞ্চ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে কোম্পানিটি।
শ্রীধর স্বল্পোন্নত এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে মনোযোগ দিতে শুরু করে। পাশাপাশি কম টাকায় সে স্থানীয় ট্যালেন্টদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।
আর এভাবেই জোহো আজকের এই জনপ্রিয় এবং প্রতিষ্ঠিত টেক জায়ান্ট হিসাবে নিজেদের গড়ে তোলে।
ব্যবহারকারীঃ
জোহোর এই বিশ্বমানের টেক জায়ান্ট কোম্পানিতে পরিণত হবার পথটা যে অনেকটাই মসৃণ ছিলো তা কিন্তু না! বছরে বছরে এমনকি মাসে মাসেও জোহোকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। পড়তে হয়েছে বিজনেস রিলেটেড কিংবা ব্র্যান্ডিং রিলেটেড বিভিন্ন জটিলতার মুখে।
যেমন ধরুন বিভিন্ন সমসাময়িক টেক জায়ান্টদের সাথে জোহোর একটি SaaS বাজারে প্রবেশ করে বসেছে। যেখানে রয়েছে Microsoft, Google, এবং Salesforce এর মত প্রতিষ্ঠিত টেক জায়ান্টদের আধিপত্য। এই কোম্পানিগুলির যেমন ইনভেস্টমেন্টের কোনো অভাব নেই, ঠিক তেমনই তাদের ব্র্যান্ডিংয়েরও কোনো তুলনা হয় না। সাথে রয়েছে বড় বড় কাস্টোমার বেস।
তবে জোহো এবং শ্রীধর চালাকি করে বেশ স্মুথলি নিজেদের কম্পিটিশন বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। নিজেরদের একটু পরিবর্তন করে কোম্পানিটি ফোকাস করেছে বিভিন্ন ছোট ছোট সার্ভিস প্রদানের দিকে।
কম্পিটিশনে নিজেদের ধরে রাখতে জোহোকে মোকাবেলা করতে হয়েছে ইনভেস্টমেন্ট চ্যালেঞ্জএর ও। তবে বেশকিছু সার্ভিস নতুনভাবে কোম্পানিতে যোগ করে করে ইনভেস্টমেন্ট জোগাড়ে সক্ষম হয়েছিলো কোম্পানিটি। সাথে ছিলো শ্রীধরের জমানো অর্থ!
এসব চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি জোহোকে বিভিন্ন সাইবার সিকিউরিটি রিলেটেড হুমকির মুখেও পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে Zoho একটি ডিজিটাল প্রোডাক্টের কারণে হ্যাকারদের হাতে পড়ে। আর এই ঘটনাটি পরবর্তীতে জোহোর সুনাম, ডেটা সুরক্ষা এবং গ্রাহকের আস্থা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছিলো। যদিও পরে জোহো দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে এবং গ্রাহকদের সাথে স্বচ্ছভাবে যোগাযোগ বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।
এছাড়া কোভিডের সময় যেখানে বিভিন্ন আন্তজাতিক কোম্পানী যাদের পণ্য আমরা হর হামেশা ব্যবহার করছি , তারা হাজার হাজার কর্মী ছাটায় করেছে নিজেদের কস্ট কাটিং এর নামে,অন্যদিকে শ্রীধর ভেম্বু আর যোহো তাদের কর্মীদের ছাটাই তো করেইনি বরং তাদের কোম্ফরটেবল লিভিং এনসিউর করেছিল। কেননা শ্রীধর ভেম্বু সবসময় মনে করত যাদের দ্বারা কোম্পানি মুনাফা অর্জন করছে তাদের দুঃসময়ে দেখভাল করাও তার দায়িক্ত। আর এটি সম্ভব হয়েছিল যোহোর ক্যাশ রিসার্ভ থাকার কারনে। শ্রীধর এক সাক্ষাতকারে বলেন যোহো তে যে পরিমান ক্যাশ রিসার্ভ রাখা হয়েছে তা দিয়ে এক বছর পুরো কোম্পানি বিনা আয়েও চলতে পারবে। আর যোহো ভয়াল করোনা মহামারীর সময় তা করেও দেখিয়েছে।
শুরুতেই বলা হয়েছিল জোহো ইতিমধ্যেই ভারতের গ্রামীণ এলাকায় বেশ কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করার চেষ্টা করছে। যদিও টেক জায়ান্ট হিসাবে এভাবে কম উন্নত এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাটা বেশ লজিস্টিক এবং অপারেশনাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
তবুও জোহো অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করে চলেছে। করছে পার্ফেক্ট প্ল্যানিং এবং নিচ্ছে কার্যকরী উদ্যোগ।
বর্তমান অবস্থা ও আয়:
বর্তমানে জোহো সফ্টওয়্যার–এ–সার্ভিস বা SaaS ইন্ড্রাস্টিতে চমৎকার কাজ করে চলেছে। বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারীদের সার্ভিস দিচ্ছে এই টেক জায়ান্ট।
তাছাড়া জোহো গত ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আয় করেছে করেছে প্রায় ৯ হাজার কটি রূপী। যা এর আগের বছর থেকে ২৯% বৃদ্ধি পেয়েছে। আর মুনাফা পরিমান ছিল প্রায় ৩০০০ কোটি রুপী , বর্তমানে জোহোর কর্মী সংখা ১২ হাজার এর ও বেশি !
অবদান এবং ভালো দিক:
টেক জায়ান্ট হিসাবে জোহো ইতিমধ্যেই ভারতে হাজার হাজার চাকরি তৈরি করেছে। বিশেষ করে প্রযুক্তি এবং সফ্টওয়্যার ডেভলপমেন্টে সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন কাজের সুযোগ। গ্রামীণ এলাকায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে কোম্পানিটির কার্যক্রম। তাছাড়া জোহো সরাসরি ভারতের হাই স্কুলেই বিভিন্ন টেক রিলেটেড প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। বৈশ্বিক কোম্পানি হিসেবে ভারতের রপ্তানি আয়কেও সমৃদ্ধ করছে শ্রীধরের ও জোহো কর্পোরেশন৷
কোন এক অনুষঠানে একবার শ্রীধর ভেম্বু বলেছিল তার অনুপ্রেরনা হিসেবে কাজ করেছিল আর এক ভারতীয় জায়ান্ট ব্যবসায়ী কারশান ভাই প্যাটেল ও তার ব্র্যান্ড নির্মা। আজকের ব্লগটি এই পর্যন্ত। পরবর্তী ব্লগ দেখার আমন্ত্রন রইল।