বাংলাদেশে ফুডপান্ডার ভবিষ্যৎ কি? What’s the Future of Foodpanda In BD
২০১৩ সালের কোনো এক সকালবেলা! ভাবুন ঢাকার কোন এক ব্যস্ততম সড়কে আপনি হাঁটছেন। রাস্তার পাশেই স্ট্রিট ফুডের পশরা সাজিয়ে বসা। স্ট্রিডফুডের(street food) এমন ফ্লেভারে ভরে গেছে চারপাশ। কিন্তু আজ ট্রাই করবার মতো সময় আপনার নেই। অফিসে প্রচুর কাজ, বস ঝামেলা করছে। আপনার মন হয়তো ভাবছে “আচ্ছা কেমন হতো যদি বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাসায় বসে এসব খাবার অর্ডার করতে পারতাম!”
ঠিক এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে জন্ম নেয় চমৎকার একটি বিজনেস আইডিয়ার যার নাম ফুডপান্ডা (Food Panda)। জার্মান ভিত্তিক ফুড ডেলিভারি (food delivery) কোম্পানীর সহযোগী হিসেবে ব্রাঞ্চ শুরু হয় বাংলাদেশে। মানুষের মাঝে নতুন এক ধরণের ফিলিংস কাজ করে খাবার নিয়ে। কিন্তু কিভাবে খুব দ্রুত সময়ে কোম্পানিটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এতোটা ভালো পারফর্রম্যান্স(performance) করা শুরু করে? কোম্পানিটির সফলতার মূল মন্ত্র কি? এই সফলতা অর্জন করতে গিয়ে কি কি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলো কিংবা হচ্ছে? আদৌ কি কোনো খারাপ দিক আছে কোম্পানিটির?
সময়টা ২০১৩ সাল। অস্ট্রেলিয়া থেকে চার্টার্ড একাউন্টিং পাস করা আম্বরিন রেজা এবং অর্থনীতি তে স্নাতক করা জুবায়ের সিদ্দিকী সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশের মাটিতেই অনলাইন ফুড ডেলিভারি বিজনেস নতুন করে চাঙ্গা করবেন। যদিও বিশ্বব্যাপী অনেক আগেই ফুড ডেলিভারি বিজনেস জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু বাংলাদেশে এমন কন্সেপ্ট সেটি প্রথম ছিল । ফুডপান্ডা মূলত জার্মান ভিত্তিক কোম্পনী ডেলিভারি হিরোর একটি সহযোগী সংস্থা হিসাবে বহু বছর ধরে বিভিন্ন দেশে কাজ করে আসছিল। কোম্পানিটি বিশ্বব্যাপি শুধু খাবার নিয়ে কাজ না করে বিভিন্ন মুদি পণ্য ডেলিভারি নিয়েও কাজ করে থাকে। সে-সময় ইন্টারন্যাশনাল ফুডপান্ডা কোম্পানি বিভিন্ন মুদি পণ্য এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মাত্র ৩০ মিনিটে গ্রাহকের কাছে ডেলিভারি করার চ্যালেঞ্জ নেয়৷ মূলত শহর অঞ্চলের মনুষদের জন্য এই সার্ভিস নিয়ে কাজ করা শুরু করে ফুডপান্ডা।
আম্বরিন রেজা (Ambareen Reza) ,জুবায়ের সিদ্দিকী (Zubair Siddiky ) ২ জনেরই মাথায় ছিলো তারা ২ জনই এই বিজনেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাবার গ্রহণের অভ্যাস পরিবর্তন করবেন। পাশাপাশি চিন্তা করেছিলেন একটি নতুন ডিজিটাল ইকোসিস্টেম তৈরি করে সে অনুযায়ী অনলাইনে সেল করবেন বিভিন্ন আইটেমের খাবার।
খুব দ্রুতই সফল হয়ে ওঠা এই বিজনেস আইডিয়া কিভাবে জেনারেট হলো আম্বরিন রেজা এবং জুবায়ের সিদ্দিকীর মাথায়? আম্বরিন রেজা এবং জুবায়ের সিদ্দিকীর পরিচয়ই বা কি?
মূলত আম্বরিন রেজা ফুডপান্ডা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় কো ফাউন্ডার (Co-Founder) হিসাবে এই ব্র্যান্ডের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বর্তমানে এই উদ্যোক্তা ফুডপান্ডা বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৩ সালের দিকে তিনি লক্ষ্য করেন বাংলাদেশে স্থানীয় ফুড ডেলিভারি সিস্টেম (food delivery system) একেবারেই নাজুক। এই ক্ষেত্রে কাজ করার পরিমাণও জিরো। খেয়াল করেন মানুষ দ্রুত এবং কম সময়ে ঘরে বসেই খাবার পাওয়ার মতো সিস্টেম খুঁজছে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না, ঠিক কোন সিস্টেমটিকে ফলো করলে ঘরে বসে এমন সার্ভিস পাওয়া যাবে। নিজের উদ্যোক্তা মনোভাবকে পুঁজি করে তিনি বিজনেসের প্রাথমিক খরচ মেটাতে তার পরিবারের কাছ থেকে টাকা ধার নেন। আর মাত্র চারজনের একটি ছোট দল নিয়ে ফুডপান্ডা কোম্পানির যাত্রা শুরু করেন।
উদ্যোমী আম্বরিন রেজা রেস্তোরাঁর অনবোর্ডিং থেকে শুরু করে প্রোডাক্ট ডেভলপমেন্ট এবং ফান্ডিং সংগ্রহ থেকে শুরু করে কোম্পানির প্রতিটি কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। নিজের ১০০% মনোযোগ দিতে শুরু করেন নতুন এই বিজনেসে।
শুধু ফুডপান্ডাই নয়! আম্বরিন বিভিন্ন লজিস্টিক কোম্পানি এবং শিক্ষা সম্পর্কিত স্টার্ট আপগুলিতে প্রচুর ইনভেস্ট করতে ভালোবাসেন। বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম ফসল এবং শিখোর মতো কোম্পানিতেও তিনি ইনভেস্ট করেছেন। মোটকথা বাংলাদেশে উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা সেক্টরে তিনি বেশ এক্টিভ থাকেন!
অন্যদিকে জুবায়ের সিদ্দিকী ফুডপান্ডা বাংলাদেশ কোম্পানি আর এক কো ফাউন্ডার হিসাবে কাজ করেছেন এবং এখনো দায়িত্ব পালন করছেন। জুবায়ের মূলত এই বিজনেসকে ছড়িয়ে দিতে আম্বরিনকে সবদিক দিয়েই সহযোগিতা করেছিলেন।
আমরা সবাই জানি বর্তমানে ফুডপান্ডা সবচেয়ে বেশি অনলাইন কেন্দ্রিক। অর্থ্যাৎ বেশিরভাগ অডিয়েন্স কোম্পানিটিকে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হিসাবেই চেনে এবং সার্ভিস গ্রহণ করে অনলাইনের সাহায্যেই! আর এই অনলাইন ভিত্তিক বিজনেস মডিউল প্রযুক্তির সাহায্যে সাজাতে এবং পুরো কোম্পানিটিকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সাজিয়ে কাজ করেছে জুবায়ের। অর্থ্যাৎ ফুডপান্ডা বাংলাদেশের আজকের এই সরব অনলাইন কার্যক্রমের পুরো ক্রেডিট এই উদ্যোক্তা জুবায়েরের!
মার্কেটে ফুডপান্ডার একটি শক্তিশালী অনলাইন ফুড সার্ভিসিং নেটওয়ার্কে তৈরি করতে যেসব চ্যালেঞ্চের মুখোমুখি হতে হয় মোটামুটি সে সব চ্যালেঞ্জ নিয়েই নিরলস পরিশ্রম করেছেন জুবায়ের৷ এক্ষেত্রে জুবায়েরের এতো পরিশ্রমের মূল কারণ ছিলো প্রাথমিকভাবে এমন অনলাইন ফুড সার্ভিসিং নেটওয়ার্কের ধারণাটি তখনো বাংলাদেশে খুব একটা চালু না হওয়া। তাছাড়া ফুডপান্ডার শুরুর দিককার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ, খাবারের গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, টেকনোলজি সম্পর্কিত বিভিন্ন জটিলতা ইত্যাদি নিয়েও জুবায়ের বেশ সক্রিয় ছিলেন। আর এরি ফলে বাংলাদেশে ফুড ডেলিভারী বিজনেস এর ৬৯% এখন ফুডপান্ডার দখলে।
আম্বরিন রেজা এবং জুবায়ের সিদ্দিকী ২ জনই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনেক বেশি সক্রিয় থাকলেও ফুডপান্ডা বাংলাদেশকে শুরুর দিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। যেহেতু এমন অনলাইন ফুড ডেলিভারি সিস্টেম(online food delivery system) বা প্ল্যাটফর্ম আগে বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যায়নি সেহেতু শুরুর দিকে এসব চ্যালেঞ্জের সমাধানও ছিলো মোটামুটি অজানা।
যেমন চ্যালেঞ্জ হিসাবে আমরা ফুডপান্ডার শুরুর দিককার মার্কেট গ্যাপ অ্যাড্রেসিংয়ের কথা ধরতে পারি। দক্ষ এবং নির্ভরযোগ্য খাদ্য সরবরাহকারীর অভাব ছিলো এই চ্যালেঞ্জের মূল বিষয়। উন্নতমানের খাবার তৈরি করবে, দক্ষ বাবুর্চিদের দ্বারা বাজেটের মধ্যে খাবার বানানো হবে…এসমস্ত বিষয় নিয়ে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলো ফুডপান্ডা কোম্পানিটি।
পাশাপাশি ছিলো না ভালো কোনো লজিস্টিক সার্ভিস। লজিস্টিক সার্ভিস বলতে ফুড ডেলিভারি সিস্টেমটিকে একটু আপগ্রেড করে দ্রুত ও ভালো মানের সার্ভিস নিশ্চিত করা হবে এমন কোনো সিস্টেম দেশে চালু ছিলনা।
এছাড়াও যাত্রার শুরুতেই দেখা দিয়েছিলো প্রাথমিক প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে বিভিন্ন জটিলতা। ফুডপান্ডার প্রতিটি কার্যক্রমকে স্ট্রিমলাইন করার জন্য প্রযুক্তির সুবিধার উপর বেশ জোর দিতে হয়েছে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাদের। কাজ করতে হয়ে উন্নতমানের লজিস্টিক সফ্টওয়্যার (logistic software) নিয়ে। যা মেইনলি ডেলিভারি রুট এবং সময়কে অপ্টিমাইজ (optimize) করে ফুড ডেলিভারি দেবে সাধারণ ক্রেতাদের। একই সাথে, ফুডপান্ডাকে তার রেস্টুরেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করতে হয়েছিলো।
মোটামুটি অনলাইনের সাহায্য খাবারের অর্ডার গ্রহণ করা, ফুডপান্ডা অ্যাপ বা বিশেষ প্রিন্টারের মাধ্যমে সরাসরি রেস্তোরাঁয় সেসব অর্ডার ডিটেইলস পাঠানো সবকিছুই ছিলো ঝামেলার কাজ।
এতোসব ঝামেলার কাজকে সময় নিয়ে দক্ষতার সাথে সহজ করে নিয়েছে ফুডপান্ডার প্রতিষ্ঠাতাগণ৷ ফুডপান্ডার উদ্ভাবনী পদ্ধতি এবং প্রযুক্তি-চালিত সমাধান এই ২ মিলে বেশ অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হতে থাকে। অ্যাপ ডাউনলোডের সংখ্যা, অর্ডারের পরিমাণ এবং গ্রাহক বেস(customer base) কেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্ম ধীরে ধীরে অনেকটাই বড় হয়ে যায়! ধীরে ধীরে ফুডপান্ডা খাবারের পাশাপাশি কাজ করতে শুরু করে অন্যান্য সার্ভিস নিয়ে।
এরই প্রেক্ষিতে কোম্পানি প্রতিষ্ঠিার ৭ বছর পর, অর্থ্যাৎ ২০২০ সালে কোম্পানিটি বাজারে আনে পান্ডামার্ট। পান্ডামার্ট (Pandamart) মূলত একটি কিউ কমার্স (Q-commerce)বা কুইক কমার্স মডিউলের বিজনেস। এই বিজনেসের আন্ডারে ফুডপান্ডা মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে মুদি এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গ্রাহকের বাড়িতে পৌঁছে দিতে শুরু করে। ভোক্তাদের বিস্তৃত পরিসরের চাহিদা মেটাতে গিয়ে দেখা দেওয়া বিভিন্ন সমস্যা যেমন প্যাকেজিং, জ্যাম ঠেলে জিনিস পৌঁছে দেওয়া, অর্ডারের গ্রাহক পক্ষ থেকে কোনো আপডেট থাকলে তা সরাসরি অফলাইন শপে নিশ্চিত করা সবকিছুই বেশ দক্ষ হাতে সামলে নিচ্ছে কোম্পানির সাথে যুক্ত কর্মকর্তাগণ!
করনা মহামারীর আগে এগ্রেসিভ মার্কেটিং আর নানান অফারের মাধমে ফুডপান্ডা তাদের ডেলিভারি সার্ভিস বৃদ্ধি খুবি দ্রুততার সাথে বাড়িয়ে নেয়। করনা মহামারির মধ্যে, ফুডপান্ডার দৈনিক ডেলিভারির পরিমাণও অনেকাংশে বেড়ে যায়, এমনকি কোম্পানিটি এই সময়ে প্রতিদিন ১.৩ লাখেরও বেশি অর্ডার পূরণ করেছে, একই সাথে বাংলাদেশের 64টি জেলায় তার পরিষেবাগুলি সমপ্রসারিত করে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে মূল্যস্ফীতি খাদ্য সরবরাহের বাজারে একটি মন্দার দিকে পরিচালিত করেছে, ভোক্তারা তাদের বাজেট কমিয়ে ফেলে ।
অন্যান্য ফুড ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম যেমন উবার ইটস(Uber Eats), আলিবাবা(Alibaba) গ্রুপের হাংরি নাকি (Hungry naki), এবং স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত সহজ ফুড( sohoj food) তীব্র প্রতিযোগিতা এবং প্রতিকূল পরিবেশের কারনে লাভের মুখনা দেখায় ইতমধ্যে বাজার থেকে বেরিয়ে গেছে।ফুডপান্ডার সঙ্গে পাল্লা দিতে বাজারে রয়ে গেছে শুধু পাঠাও (pathao)।
ইন্ডাস্ট্রি ইনসাইডারদের মতে, বর্তমানে প্রায় ১ লাখ (১০০,০০০) অনলাইন ফুড অর্ডার পূরণ করে ফুডপান্ডা বাংলাদেশে মার্কেট লিডার হিসেবে তার অবস্থান বজায় রেখেছে।
তবে হ্যাঁ! একটি কোম্পানি হিসাবে ফুডপান্ডার যে নেহায়েতই কোনো নেগেটিভ সাইড নেই, তা কিন্তু নয়! জানা যায় ফুডপান্ডায় কর্মচারীগণ প্রচুর পরিশ্রমের বিপরীতে পাচ্ছেন বেশ অল্প বেতন। গ্রাহকের বিভিন্ন ফরমায়েশ, দ্রুত ডেলিভারি, বিভিন্ন দূর্যোগের মুখে পড়া সবমিলিয়ে এই অল্প বেতনে পুষিয়ে উঠতে পারছেন না এসব কর্মচারীগণ! বিশেষ করে ফুডপান্ডার রাইডারদের কথা একেবারে না বললেই নয়! দেখা যায় মাত্র ১৩ টাকা লাভের আশায় সারাদিনই পরিশ্রম করতে হচ্ছে তাদের! পাশাপাশি ইদানীং খাবার দাবারেও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন সমস্যা। এছাড়াও মনপোলি বিজনেস করার জন্য ফুডপান্ডা তার কম্পিটিটর দের সহজে মার্কেটে এস্টাব্লিশড হতে দেয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
তবুও ভোজনরসিক বাঙালিদের কাছে ফুডপান্ডা একটি ইমোশনের নাম! যেখানে টাকায় কেনা যায় সুখ, সেই সুখ পছন্দের খাবারে তৃপ্তির ঢেঁকুর উঠার!