বাইজুস যেভাবে এক বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা হারিয়েছিল !!
২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের সবচেয়ে বড় অনলাইন শিক্ষা প্লাটফর্ম বাইজুস (Byju’s) । যার উন্নত শিক্ষা পদ্ধতি এবং অনন্য প্রয়োগকৌশল অবলম্বনের ফলে খুবই রাতারাতি জনপ্রিয়তা অর্জন করে নেয় ভারতের শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে। বিশ্বের প্রায় ১২০টি দেশের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়া এই কোম্পানি ১৫০ কোটির ও বেশি সাবস্ক্রিপশন(subscription) ছিল এবং কোম্পানিটির মার্কেট প্রাইস ছিলো ৫ হাজার ৪০০ শত কোটি টাকা।
কি এমন পন্থা অবলম্বন করেছিল বাইজুস যার ফলে এত দ্রুত এত জনপ্রিয়তা আর ব্যবসা সফল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন? আর কি’ই বা এমন ভুল ছিল যা এই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালের পর পতনের দিকে ঝুকে গেলো? । আমাদের আজকের ব্লগটি জনপ্রিয় এড টেক কোম্পানী বাইজুস এর উথান এবং পতনের গল্প।
শুরুর গল্প
২০০৮ সালের দিকে ভারতে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের(coaching center) পরিচিতি কিন্তু ছিলো ব্যাপক। বলা যায় জমজমাট একটা ব্যবসা। আর এই জমজমাট সময়টাতেই এক কোচিং সেন্টারের আইআইটি (IIT) প্রশিক্ষক ছিলেন স্নাতক পাশ করা প্রকৌশলী বাইজু রাভেন্দ্রন। ১৯৮০ সালের ৫‘ই জানুয়ারি ভারতের কেরালার, কন্নার জেলার আজিকোড গ্রামে জন্ম নেওয়া বাইজু রাভেন্দ্রনের বাবা রামানন্দ রাভেন্দ্রন ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক এবং মা শোভানবল্লী ছিলেন একজন গণিতের শিক্ষিকা। বাবা– মা দুজনই শিক্ষক ব্যাকগ্রাউন্ডের হওয়ার ফলে শিক্ষা জীবনে টিকে থাকতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি বাইজু রাভেন্দ্রনের। রাভেন্দ্রন স্কুল জীবন শেষ করেন আজিকোডের একটি স্থানীয় মালায়লাম মিডিয়াম স্কুল থেকে।
তারপর কন্নার (Kannur) গভর্নমেন্ট কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে B.Tech ডিগ্রী লাভ করেন। এবং তিনি স্নাতক পাশ করার পর একটি বহুজাতীয় শিপিং কোম্পানিতে সেবা প্রকৌশলী হিসাবে যোগদান করেন। ২০০৩ সালে ছুটির সময় বাড়ি এসে বন্ধুদের ক্যাট পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সাহায্য করতেন বাইজু। পরবর্তীতে নিজেও ক্যাট পরীক্ষায় দু‘বার শতকরা ১০০ ভাগ নম্বর লাভ করেন। তার টিউশন পদ্ধতি বন্ধুদের মাঝে বেশ সাড়া জাগালে এবং ভালো ফল দেখে তিনি তার উচ্চ বেতনের চাকরি পদত্যাগ করে কোচিং এ ক্লাস করানো শুরু করেন।
প্রাথমিক ভাবে বাইজু তার এক বন্ধুর বাড়ির ছাদে শুধুমাত্র এমবিএ প্রার্থীদের(MBA) এক সপ্তাহ বিনা পয়সায় পড়াতে শুরু করেন এবং এখান থেকেই বাইজু শিক্ষা ক্ষেত্রের একজন সফল উদ্যোক্তা(Entrepreneur) হিসেবে যাত্রা শুরু করেন।তবে একটা সময় ছাদে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তীতে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ২০০৮ সালে প্রাথমিক ভাবে বাইজু্র অফলাইন কোচিং সেন্টার শুরু হওয়ার পর, বাইজু তার ছাত্রদের সফলতা তাকে অনুপ্রাণিত করে। এবং এরপর ২০১১ সালে তিনি একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন, যার নাম ছিলো Byjus’s । যেখানে Byjus’s এর অংশীদার হিসেবে ছিলেন বাইজুর স্ত্রী দিব্যা গোকুলনাথ।
BYZU’S আসলে কি ?
BYJU’S হলো আমাদের দেশে বিস্তার ছড়ানো 10 মিনিট স্কুল(10 min school), শিখ(shikho) বা ওস্তাদ(ostad) এর মতো একটি শিক্ষামূলক প্রযুক্তি (edtech) এবং অনলাইন শিক্ষাদান প্রতিষ্ঠান।BYJU’S অ্যাপটি সাধারণত ক্লাস 1 থেকে ক্লাস 12 পর্যন্ত স্কুলের ছেলেমেয়েদের এবং বিশেষকরে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার যেমন IIT-JEE, NEET, CAT, IAS এর জন্য সহায়তা করত। প্রথম দিকে প্রায় ১২–২০ মিনিটের ডিজিটাল অ্যানিমেশন ভিডিওর মাধ্যমে গণিত ও বিজ্ঞানের ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করাই ছিলো BYJU’S এর মূল লক্ষ।
তবে প্রথম দিকে BYJU’S অনলাইন প্লাটফর্মটি প্রতিষ্ঠিত হয় বাইজুস ক্লাসেস “BYJU’S CLASSES ” নামে। এবং পরবর্তীতে ২০১৭ সালে সেই নাম পরিবর্তন করে নামকরণ হয় BYJU’S নামে। একসময় বাজুস (BYJU’S) ছিলো ভারতের অন্যতম ও বেশ সফল একটি অনলাইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে বাইজুস BYJU’S এর এই সফলতার পেছনে রয়েছে তার অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দ্বারা তৈরি আকর্ষণীয় এবং তথ্যপূর্ণ ভিডিও লেকচার , যার ফলে BYJU’S থেকে শিক্ষার্থীরা সহজেই অ্যাডাপ্টিভ লার্নিং(Adapting learning) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণ করত।
২০১৫ সালে এসে BYJU’S মোবাইল অ্যাপ(mobile app) এবং ওয়েবসাইট (website) লঞ্চ করে, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে থেকে সার্ভিস নিতে পারত। পাশাপাশি রাভেন্দ্রন তার শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে বাইজুস এর সফল শিক্ষার্থীদের সফলতার গল্প ব্যাপক ভাবে প্রচার করত।এই ভাবে প্ল্যাটফর্মটি লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীকে উন্নত শিক্ষা প্রদানে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বিশেষ করে ছোট ছোট শহর এবং গ্রামাঞ্চলে BYJU’S এর নাম দ্রুতই ছড়িয়ে পরতে শুরু করে। ২০২২ সালে এসে বাইজুস বিশ্বব্যাপি ১৫০ কোটি বারের ও বেশি ডাউনলোড হয় এবং এর ব্যাবহারকারিরা দৈনিক গড়ে ৭১ মিনিট সময় ব্যয় করত। এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে BYJU’S কোম্পানিটি বেশ সমৃদ্ধি হতে থাকে। অনলাইন স্কুল ছাড়াও এর আয়ের মাধ্যম ছিলো অনেক। তবে ২০২৩ সালের আর্থিক বছরের হিসেব অনুযায়ী , বাইজু‘স 5,400 কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছিল।এর মধ্যে 4,600 কোটি টাকাই এসেছিল তার স্কুল বিভাগ থেকে এবং 800 কোটি টাকা এসেছিল অনলাইন বিভাগ থেকে। পাশাপাশি তার বিনিয়োগ থেকে আয় হয় 1,200 কোটি টাকা। এছাড়া বাইজু‘স বিজ্ঞাপন, সাবস্ক্রিপশন ফি এবং অন্যান্য উৎস থেকেও বেশ মোটা অংকের একটা এমাউন্ট আয় করে থাকে পরিমান ছিল 600 কোটি টাকা। এবং যার যোগফল ছিলো 7,200 কোটি টাকা!
এই সময় রাভেন্দ্রন ও তার স্ত্রী এর যৌথ সম্পদ এর পরিমান দাড়ায় ৩শত ৪০ কোটি ইউ এস ডলারে। বাইজুস প্রতিষ্ঠা করে রাভেন্দ্রন একাই লাভবান কিংবা নিজের অবস্থা পরিবর্তন করেছেন এমনটা কিন্তু নয়।
বাইজুস এপ এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল কয়েক হাজার শিক্ষার্থীদের এবং কর্মজীবীদের।
তবে প্রচলিত প্রবাদে আছে , চাঁদের ও কলঙ্ক আছে?
বাইজুর পতন
কেননা বাইজু রাভেন্দ্রনএর এই প্রতিষ্ঠান এত জমজমাট আর অর্থ সফল হওয়ার পরেও কোথাও না কোথাও তো বাঁধা থেকেই যায় তাই না? এই যেমন BYJU’S এর উচ্চ খরচের কোর্স গুলোর কথাই যদি বলা হয়। অনলাইনের সময় থাকার পরও শহরের পাশাপাশি ভারতের প্রত্যন্ত গ্রাম গুলোর শিক্ষার্থীরা এরকম উচ্চ খরচের কোর্স বহন করতে পারতো না। আর এই কারণটাই একটা সময় BYJU’S এর পতনের কারণ হয়ে দাড়িয়ে ছিলো।
এছাড়া আক্রমণাত্মক বিপণন কৌশল এবং আর্থিক অব্যবস্থাপনাও কোম্পানির পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বড় ইভেন্টের স্পনসরশিপ(sponsorship) এবং সেলিব্রেটি এনডোর্সমেন্ট বাইজুসের উপর আর্থিক অবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করেছে, যার ফলে 2021 সালে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে ।বাইজুস-এর বিরুদ্ধে ব্যবহারকারীর ডেটা সংগ্রহ এবং ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ, ডাটা গোপনীয়তার লঙ্ঘন সহ নানা অভিযোগ ছিল । এছাড়া বেতন ও কাজের পরিবেশ নিয়েও ছিল শিক্ষকদের অসন্তোষ্টতা।
২০২২ সালের শেষের দিকে, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়, যার ফলে অনেক লোক তাদের বিলাসবহুল খরচ কমাতে বাধ্য হয়, যার মধ্যে শিক্ষা খাতও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এবং বাইজুস কে তাদের মত বেশ কয়েকটি প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যারা কম দামে অনুরূপ পণ্য এবং পরিষেবা অফার করেছিল।
বাইজুসেরর এর ব্যয় বহুল কোর্সের বিপরীতে স্বল্প মুল্যের এই কোর্স গুলি শিক্ষার্থীরা সহজে বেছে নিতো। এর ফলে Byju’s এর উপরে ব্যাপক একটি অর্থনৈতিক মন্দা(Economic recession)সৃষ্টি হয়। এবং Byju’s আর্থিক সমস্যায় পড়তে শুরু করে। এছাড়া করনা মহামারীর শেষের সাথে সাথে, স্কুল পুনরায় খোলা হলে, অনলাইন শিক্ষার চাহিদা বেশ হ্রাস পায়। ফলে কোম্পানিটি ১২ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করে এবং সকল ব্যয় হ্রাসের পদক্ষেপ নেয়।
২০২৩ সালের শেষের দিকে, Byju’s- কোম্পানির মার্কেট ভ্যালু ১০০ কোটি ইউ এস ডলারে নেমে আসে। যা Byju’s এর পতনের অন্যতম কারন। তবে এর পেছনে আবার অনেকেই বিশ্লেষন করেন যে বাইজুস তার প্রতিষ্ঠানের দ্রুত বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি এবং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিষদ ও ছিলো বেশ অদক্ষ(inefficient)। এপ্রিল 2023-এ, ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ED)-তদন্তের আওতায় আনে এবং এর তিনটি অফিসে ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট (FEMA) এর অধীনে অভিযান চালানো হয়।
এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বাইজু–এর বিরুদ্ধে 9,362.35 কোটি রুপির মানি লন্ডারিং অভিযোগ দায়ের করে। এছারা 2023 এর শেষদিকে সা একটি বিদেশী ঋণদাতা সংস্থা বাইজুসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার পরে এড–টেক কোম্পানির জন্য আইনি সমস্যা আরো বাড়তে থাকে। আর সমস্ত কারণগুলি মিলে BYJU’S-এর উপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করে এবং প্রতিষ্ঠানটি পতনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে।
তবে আলোচনা – সমালোচনা আছে বলেই এক একটি প্রতিষ্ঠান উপরে ওঠতে অনুপ্রেরণা পায়। আর এই অনুপ্রেরণার ফলেই সকল আলোচনা – সমালোচনাকে পেছনে ফেলে BYJU’S প্রতিষ্ঠাতা বাইজু রাভেন্দ্রন শিক্ষাক্ষেত্রে বিপুল সফলতা ও অবদানের জন্য ওট্টা (otta) পুরস্কার লাভ করেন। যা তার এই লড়াইয়ে এক অন্যতম সম্মাননা এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নতুন প্রেরণা।
তো আপনাদের কি মনে হয়,বাইজুসের পতনের মূলে আসলে কি ছিল ? অব্যবস্থাপনা না কি স্বল্প সময়ে দ্রুত সাফল্যের দেখা পেয়ে তা ধরে না রাখতে না পারা?
আর ভিডিও ব্লগ ভাল লেগে থাকলে লাইক দেয়ার অনুরোধ রইল। পরবর্তি ব্লগ পড়ার আমন্ত্রন রইল।