চট্টগ্রামের PHP Group: শান্তি, সুখ আর সমৃদ্ধির গোপন ফর্মুলা? | Business Mania
প্রিয় দর্শক বিজিনেজ মিনিয়ার আজকের আলোচনায় আমরা এমন একজন মানুষ এবং তার প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে জানবো। যার কর্ম জীবন তো শুরু হয়েছিল মাত্র ১০০ টাকা বেতনের একজন কর্মচারী হিসেবে কিন্তু বর্তমানে যার প্রতিষ্ঠা করা কোম্পানির বাতসরিক টার্ন ওভার প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
জি আজকের আলোচনা আমাদের PHP ফ্যামিলি বা PHP গ্রুপ ওফ ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়ে। যেটা কিনা বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ একটি গ্রুপ ও ইন্ডাস্ট্রি।
বেশি কথা না বাড়িয়ে চলুন আলোচনা শুরু করা যাক।
পিএইচপি ফ্যামিলি নামের চট্রগ্রামভিত্তিক এই বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয় সুফি মুহাম্মদ মিজানুর রহমান এর হাত ধরে। বর্তমানে তিনিই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা চ্যায়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মিজানুর রহমান জন্মগ্রহন করেন ১৯৪৩ সালের ১২ই মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের কাঞ্চন গ্রামে। তার পিতার নাম সুফি মুহাম্মাদ দায়েম উদ্দিন আর মাতার নাম রাহাতুন নেসা। স্থানীয় ভারত চন্দ্র বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৬১ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর একই বছর সরকারি তোলারাম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন।
এই উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়ই মিজানুর রহমানের কর্মজীবন শুরু হয়। এসময় তিনি মাত্র ১০০ টাকা বেতনে নারায়ণগঞ্জ এর জালাল জুট ভ্যালি কোম্পানিতে মাত্র ১০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। সেই সাথে লেখা পড়াও চালাতে থাকেন।
এরপর ১৯৬৩ সালে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন।
উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর তিনি ১৯৬৫ সালে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে চট্রগ্রামে চলে আসেন। এবং মাসিক ১৬৩ টাকা বেতনে জুনিয়র কর্মচারী হিসেবে ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তান যেটা বর্তমানে সোনালি ব্যাংক নামে পরিচিত সেখানে যোগদান করেন। তার পোস্টিং হয় চট্রগ্রামের লালদিঘি ব্রাঞ্চে।
সেখানে চাকরিরত অবস্থাতেও তিনি তার পড়ালেখা চালিয়ে যান এবং ব্যাংকিং এর উপর ডিপ্লোমা পাশ করেন। সাথে ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম ও পাশ করেন। সেখানে চাকরিরত অবস্থাতেই তিনি ১৯৬৭ সালের ৪ জুলাই বিবাহ বন্ধনে জড়ান।
বিয়ের এক মাসের মাথায় তিনি এস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে জব লেটার (Job-Letter) পান। এবং সেখানে মাসিক ৮০০ টাকা বেতনে ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিপার্টমেন্টর একজন জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন।
মূলত এখানে চাকরিরত অবস্থাতেই তিনি এক্সপার্ট ইম্পোর্ট (Export-Import) ব্যবসার ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারে। কীভাবে এই ব্যবসাগুলো পরিচালিত হয়, কি কি কাগজপাতি দরকার পরে এসব জানতে পারে। সেই সাথে অনেক বিজনেজ পারসোন এর সাথেও পরিচিতি হয়।
কিন্তু ১৯৭১ সালে দেশ মুক্তি লাভ করলে দেশে অবস্থানরত অনেক পাকিস্তানি আমদানিকারক দেশ থেকে চলে যান। এদিকে নব্য স্বাধীন হওয়া দেশের বাজারে পন্যের চাহিদাও ব্যাপক অন্যদিক আমদানিকারক ও তেমন নেয়।
ঠিই এইসময়ই মিজানুর রহমান তার বাবার পরামর্শে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট এর ব্যবসায় নামেন। সেই সময় দেশের মার্কেটে জাপানিজ টায়ার এর ব্যাপক চাহিদা ছিল। তাই মিজানুর রহমান এস্টার্ন মোটর্স এর এক কর্মকতার সাথে মিলে জাপান (Japan) থেকে টায়ার আমদানি করেন।
এসময় মিজানুর রহমানের পকেটে ছিল মাত্র ১০৬৪ টাকা। বাকি টাকা তিনি ব্যাংক থেকে লোন নেন। প্রথম বারের চেষ্টাতেই টায়ার বিক্রি করেই বেশ ভালো একটা প্রফিট পান মিজানুর রহমান। যেটা তিনি তার ব্যাংকের লোন পরিশোধ করে দেন।
এরপর ধীরে ধীরে তিনি বিশ্ব এর বিভিন্ন দেশ থেকে নানা রকম পন্য আমদানি করতে থাকেন। যেমন জার্মানি (Germnay) আর ডেনমার্ক (Denmark) থেকে দুধ পাউডার, স্ট্যাশনারির (Stationary) আইটেমগুলো চীন থেকে। ব্রাজিল (Brazil0 থেকে চিনি। ইন্ডিয়া (India) আর মায়ানমার (Myanmar) থেকে চাল ইত্যাদি।
পরবর্তীতে এই বিজনেস এর প্রফিট থেকে তিনি ঢাকার মৌলুভিবাজারে নিজস্ব দোকান ও দেন।
কিন্তু এখানেই থেকে থামেননি তিনি এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট বিজনেজ থেকে পাওয়া প্রফিটকে কাজে লাগিয়ে এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে কক্সবাজারের সীতাকুন্ডে একটা জাহাজ ভাঙ্গার ফ্যাক্টরি চালু করেন। কোম্পানিটির নাম দেন RM shipbreaking factory এবং প্রথম বছরেই প্রায় ৬০ হাজার ডলার খরচ করে Ocean H. নামের একটা পুরনো জাহাজ কিনেন। এটা থেকেও বেশ ভালো প্রফিট পান তিনি৷
পরবর্তীতে দুই বছরের মাথায় তিনি আরেকটা ফ্যাক্টির দেন। যেখানে স্টীল শিট থেকে স্টিল এর রড তৈরী করা হতে থাকে। প্রতিদিন প্রায়া ৪০০ টন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন এই ফ্যাক্টরিটাও। প্রথম থেকেই ছিল প্রফিটেবল। পরবর্তী RM গ্রুপের অধীনে তারা আরো কিছু ফ্যাক্টরি চালু করেন।
কিন্তু এর কিছু বছর পরেই RM গ্রুপ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এবং মিজানুর রহমান এর অধীনে আসে শিপব্রেকিং ফ্যাক্টরি, অক্সিজেন প্লান্ট আর রাবারে বাগান। এই তিনটি বিজনেজ নিয়েই মিজানুর রহমান ১৯৯৯ সালে PHP গ্রুপ ওফ ইন্ডাস্ট্রিজ চালু করেন। PHP এই নামটি তিনি নিয়েছেন Peace, Happiness and Prosperity এই তিনটি শব্দ থেকে।
PHP গ্রুপ প্রতিষ্ঠার পর প্রথমে তিনি চালু করেন PHP Galvanising Industry। এরপর ২০০৫ সালে তিনি চালু করেন পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রি। প্রায় ২৪.২৭ একর জমির উপর, ১৫০০ কোটি টাকা খরচ করে চালু করা হয় এই ফ্যাক্টরিটি৷ এরপর ফেনিতে দৈনিক প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টন আইরোন শিট (Iron sheet) উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন আরো একটি ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেন৷ এছাড়াও ২০১৭ সালে Proton Brand এর সাথে মিলে গাড়ি এস্যাম্বল (Assemble) করার একটা কারখানা চালু করে PHP গ্রুপ। মূলত এই তিনটা প্রডাক্ট এই পিএইচপির লিডিং প্রডাক্ট।
তবে সব মিলিয়ে আলাদা আলাদা ১১টা সেক্টরে পিএইচপির টোটাল ৩৪টা কোম্পানি রয়েছে। যেগুলোর অধীনে রয়েছে প্রায় ২৪টি আলাদা আলাদা কারখানা। বর্তমানে পিএইচপি গ্রুপের অধীনে যে কয়েকটা কোম্পানি রয়েছে তার একটা তালিকা নিচে দেওয়া হলো গ্রুপের অধীন প্রতিষ্ঠান
পিএইচপি কোল্ড রোলিং মিলস লিমিটেড,পিএইচপি স্টিলস লিমিটেড,পিএইচপি ইস্পাত লিমিটেড,,পিএইচপি কনটিনিউস গ্যালভানাইজিং মিলস লিমিটেড,পিএইচপি এনওএফ কনটিনিউস গালভাইজিং মিলস লিমিটেড,পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রি-সাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড,পিএইচপি পাওয়ার জেনারেশন প্ল্যান্ট লিমিটেড,পিএইচপি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড,পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ,পিএইচপি অ্যাগ্রো পণ্য লিমিটেড,পিএইচপি কর্পোরেশন লিমিটেড,পিএইচপি ওভারসিজ লিমিটেড,বিএওয়াই টার্মিনাল অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড,পিএইচপি পেট্রো রিফাইনারি লিমিটেড,পিএইচপি স্টক ও সিকিউরিটিজ লিমিটেড,
পিএইচপি কটন মিলস লিমিটেড,পিএইচপি স্পিনিং মিলস লিমিটেড,পিএইচপি রটার স্পিনিং মিলস লিমিটেড,
পেলিকান প্রপার্টিজ লিমিটেড,দিনা কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড,
পিএইচপি লাটেক্স ও রাবার পণ্য লিমিটেড,পিএইচপি ফিশারিজ লিমিটেড।
বর্তমানে পিএইচপির ফোর্ট গ্লাস দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৪০% পূরন করতে সক্ষম। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে ইতালীয় প্রযুক্তি ব্যবহার এর মধ্য দিয়ে সাতটি ভিন্ন কালারের ফোর্ট গ্লাস উতপাদন করছে। এছাড়াও আরো তিনটি পন্য বেন্ডিং গ্লাস, ফাইবারগ্লাস নেট ও অ্যালুমিনিয়াম মই উতপাদনের ঘোষনাও দেয় প্রতিষ্ঠানটি৷
অন্যদিকে আবার ২০২৪ সালের মে মাসে, PHP মোটরস পেরোদুয়ার চারটি মডেল—পেরোদুয়া আরুজ (১৫০০ সিসি ৭-সিটার এসইউভি), পেরোদুয়া বেজা (১৩২৯ সিসি সেডান), পেরোদুয়া মাইভি (১৫০০ সিসি হ্যাচব্যাক) এবং পেরোদুয়া অ্যাক্সিয়া (১০০০ সিসি হ্যাচব্যাক)—বাংলাদেশের বাজারে উন্মোচন করেছে।
বর্তমানে পিএইচপির অধীনে কাজ করে প্রায় ১১ হাজার মানুষ। এবং মাত্র ১০৬৪ টাকার ইনভেস্ট এ শুরু হওয়া কোম্পানিটি প্রতি বছর কেবল ৯০০ কোটি টাকার ট্যাক্স ই দিয়ে থাকে।
এছাড়াও ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস (Corona virus) এর সময় যেখানে পিএইচপি ৪০ কোটি টাকা লস করলেও কোন কর্মচারীকে তো ছাটাই করেই নি। উলটো প্রায় ১২টির মতো বোনাস প্রদান করে।
দেশের শিল্প খাতে ব্যাপক অবদানের জন্য পরে ২০২০ সালে মিজানুর রহমানকে একুশে পদক দিয়ে ভূষিত করা হয়। এবং ৮১ বছর বয়সী মিজানুর রহমান এখনো পিএইচপি গ্রুপ নিজ হাতে পরিচালনা করে যাচ্ছেন।
প্রিয় দর্শক আমাদের আজকের আলোচনাএই অব্দি। আলোচনাটি ভালো লাগলে আমাদের জানাতে ভুলবেন না। সেই সাথে লাইক কমেন্ট আর শেয়ার করে আমাদের সাথেই থাকবেন।