Pakistan’s Endless Economic Crisis – পাকিস্তানের অন্তহীন অর্থনৈতিক সংকট
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তির দেশ পাকিস্তান (Pakistan)। এ অঞ্চলের প্রথম পারমাণবিক বোমার অধিকারী একটি দেশ। ভারতের মত একটি দেশ যাদের ভয়ে সবসময় তটস্থ হয়ে থাকে । তাদের আজ ব্যাংকে ডলার নেই। দোকানে আটা নেই। বিদ্যুৎ-কেন্দ্র চালানোর জ্বালানি নেই। কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরি নেই। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের অতি প্রয়োজনীয় পণ্য কেনারও সামর্থ্য নেই। যারা আজ এক করুণ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেনো? কি করে এমন কঠিন অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে পড়ল দেশটি? চলুন তবে জানার চেষ্টা করি নিউজলেটার-এর আজকের এই ব্লগ-এ।
কি হচ্ছে আসলে পাকিস্তানে (Pakistan)?
বিশ্বব্যাংকের (World Bank) তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৯.৫ কোটি পাকিস্তানবাসী এখন দরিদ্রতার মধ্যে বসবাস করছে। পাকিস্তানের (Pakistan) অর্থনীতি বর্তমানে শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। জনগণ দুধ, চিনি, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছে না। জ্বালানীর অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে টেক্সটাইল শিল্পসহ কলকারখানা। চাকরি হারিয়েছেন হাজারো মানুষ। দেশটি অনেক দিন আগে ইমরান খানের (Imran Khan) শাসন কালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএম এফ (International Monetary Fund, IMF) এর কাছে ‘বেইল-আউট ঋণ’(Bail-out loans) আবেদন করেছিলো। এবং সংস্থাটি ঋণ দিতে সম্মত ও হয়। কিন্তু এখন সংস্থাটি এমন অনেক কঠোর শর্ত আরোপ করতে চাইছে, যেগুলো পূরণের ক্ষমতা পাকিস্তানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর নেই।
এমনকি পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন (China) ও সৌদি (Saudi Arabia) আরবও এখন আর দেশটির এমন দুরারোগ্য ভিক্ষাবৃত্তির ভার নিতে চাইছে না। চীনা অর্থে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কিস্তির টাকা বহুদিন ধরে পরিশোধ না করায় ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে চীন। যার কারণে গোটা পাকিস্তান (Pakistan) ভয়াবহ লোডশেডিংসহ প্রায়ই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। আশঙ্কা জনকভাবে দাম বেড়ে ১ ডলার এখন ৩০০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সমস্যা এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে যে এখন ১ কেজি আটার দাম ১৬০ রুপি এবং ১ কেজি চিনির দাম ৩০০ রুপি ছাড়িয়ে গেছে।
দেশটির অর্থনীতি এখন যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। অর্থ সংকটে মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমানোর পদক্ষেপও নেয় দেশটির সরকার। বৈদেশিক লেনদেনে বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়েছে। রপ্তানি এবং বিভিন্ন খাত থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে খরচ সামলানো সম্ভব হচ্ছে না। দেশটির বার্ষিক রপ্তানি আয় এখনো ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচেই রয়ে গেছে অথচ আমদানি ব্যয় ৮০ থেকে ৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিবছর। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে পাকিস্তানের অবস্থান প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে। এত বিশাল জনগোষ্ঠীর খাবার আমদানি করা পাকিস্তানের জন্য এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেনো আজ পাকিস্তানের অর্থনীতির এই করুণ পরিস্থিতি? হঠাৎ করেই কি এই সংকটের আবির্ভাব হয়েছে? না কি বছরের পর বছর ভুল জায়গায় অর্থ ব্যয় করা এর পেছনের অন্যতম কারণ?
পারমানবিক বোমা (atomic bomb) নাকি উন্নয়ন?
পাকিস্তানের (Pakistan) যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা চলছে এটা বলতে গেলে হওয়ার ই ছিল। বিশ্লেষকদের মতে, ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছরই প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোয় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশটির অর্থনীতিতে। কোনও দেশে যখন তার অন্যান্য খাতের তুলনায় সামরিক খাত বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকে তখন সেই দেশের অর্থনীতির ওপর একটা বড় চাপ পড়া অবধারিত।
কেনো? কারণ, সামরিক খাত হচ্ছে একটা অনুৎপাদনশীল খাত। এখানে আপনি ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে সেই ১০ কোটি টাকা সহজে উঠে আসবে না। উপরন্তু এই এতো টাকা বিনিয়োগ করে আপনি যা যা সামরিক সরঞ্জাম কিনলেন সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আপনাকে আরও টাকা ঢালতে হবে এর পেছনে। কথা হচ্ছে ,যদি অর্থনীতি শক্তিশালী থাকে আর আপনার দেশ যদি যথেষ্ট ধনী হয় তাহলে যা ব্যয় হচ্ছে সামরিক খাতে তা পুষিয়ে ওঠা সহজ হয়। কিন্তু যে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল তার পক্ষে সামরিক খাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ রীতিমতো আত্মঘাতী ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
সামরিক খাতে কোনও দেশকে ব্যয় করতে হলে এজন্য যথেষ্ট বুঝেশুনে ব্যয় করতে হয়। যদিও যে কোনও দেশের প্রতিরক্ষা খাতে একবারেই ব্যয় না করলে চলে না। তবে কথা হচ্ছে এই প্রতিরক্ষা খাত তথা সামরিক খাতে ব্যয় এবং অর্থনীতির অন্যান্য খাতে ব্যয় এর মধ্যে একটা ভারসাম্য রাখতে হয়। তা না হলেই বিপদ ঘটে। আর এই ভারসাম্যই পাকিস্তান (Pakistan) কখনোই রাখে নি। তার উপর আবার তারা পারমাণবিক শক্তিও অর্জন করে ফেলেছে। যেটি রক্ষণাবেক্ষণের ও একটা বিশাল ব্যয় রয়েছে।
যাই হোক, কথা হচ্ছে উচ্চ মাত্রার সামরিক শক্তি এমন নয় যে পাকিস্তান (Pakistan) এর মতো দেশ সেটা রাখার অধিকার রাখে না। তবে কথা হচ্ছে এমন শক্তি অর্জন করতে হলে তাকে অতি অবশ্যই খুব শক্ত অর্থনীতির দেশ হতে হবে। যথেষ্ট ধনী একটা দেশ হতে হবে। তাহলে অর্থনীতির ওপর যে চাপটা থাকবে সেটা সে পুষিয়ে নিতে পারে। আর পাকিস্তানের অর্থনীতি কখনোই এতটা শক্তিধর ছিল না। কিন্তু তারপরও সাড়ে পাঁচ লাখের সেনাবাহিনীসহ সাত লাখের একটি সশস্ত্র বাহিনীর বোঝা বহন করতে হচ্ছে পাকিস্তানকে। অর্থনৈতিক যুক্তিতে কোনোভাবেই এই বোঝা বহন করা সম্ভব নয় পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু জন্মশত্রু ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য এত বড় সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ না করে উপায় ও নেই তাদের।
তার উপর আবার ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি পাকিস্তান এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান (Imran Khan) ইস্যুতে দিনদিন আরো উত্তপ্ত হচ্ছে পাকিস্তানের রাজনীতির মাঠ। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সংকটের মতো একটি পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতিকে আরও নিস্তেজ করে দিচ্ছে।
দেশটিতে চলমান এই সংকটের আরো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণ খুঁজে বের করেছেন বিশ্লেষকরা। পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি কৃষিপণ্য আর প্রবাসী আয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান এই দুই খাতের বাইরে পরির্বতনশীল পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের অর্থনীতিকে বহুমুখী করতে পারেনি দেশটি। করোনা (Covid-19) মহামারিতে দীর্ঘদিন লক-ডাউনসহ নানা নিষেধাজ্ঞা আর এরপর ইউক্রেন (Ukraine) যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার পরও জিডিপির (Gross Domestic Product, GDP) একটা বড় অংশই সেনাবাহিনীর পেছনে খরচ করেছে পাকিস্তান।
এর মধ্যে, এ বছর পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেপ্তারের পর দেশটিতে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তাতে করে আইএমএফ (IMF) থেকে খুবই প্রয়োজনীয় একটি ঋণ পাওয়া নিয়ে জটিলতা বেড়ে যায়। যার ফলে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট আরো গভীর-ই হবে। ২২ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেনো থমকে রয়েছে, আর মূল্যস্ফীতি সেটাতো বেড়েই চলেছে। একদিকে রুপির মূল্য-পতন ঘটছে ভয়াবহ ভাবে, অন্যদিকে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ফলে খাদ্যের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না দেশটি। খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। কয়েক মাস ধরেই আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে যে দেশটি ঋণ পরিশোধেও ব্যর্থ হতে পারে।
তাহলে পাকিস্তানের এরপর কি হবে?
আইএমএফের (International Monetary Fund, IMF) ঋণের ছাড়করণ গত নভেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে আছে। আগামী 2023 সালের জুনে এর মেয়াদ শেষ হবে। আইএমএফের যোগাযোগ পরিচালক জুলি কোজাক (Julie Kozack) বলেছেন, পাকিস্তানের ‘অনেক অর্থের দরকার’। তবে নির্বাচনের আগে আইএমএফের চাহিদামত সংস্কার দেশটি কতটা করতে পারবে, তা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিত নন। এসব সংস্কার স্বল্প মেয়াদে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়াবে বলেই ধারণা করছে সবাই। আর তাই নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকার জনগনের অসন্তুষ্টি বাড়াতে চাইবে না।
আইএমএফ (IMF) এর ঋণ পেতে পাকিস্তানকে এখন ভর্তুকি কমিয়ে অভ্যন্তরীণ কর আরোপ বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু বর্তমান সরকারের পক্ষে খরচ কমানো এবং কর বাড়ানো খুব সহজ কোনো কাজ নয়। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ (Shehbaz Sharif) দাবী করছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো তিনি আগের সরকার থেকে পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আগের সরকার আইএমএফের সঙ্গে করা চুক্তির বরখেলাপ করেছে, তবে আমরা তা মেরামত করার চেষ্টা করছি।’ বর্তমানে পাকিস্তানকে অন্যদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হবে। কিন্তু তার আগে পাকিস্তানের আইএমএফের সঙ্গে সমঝোতায় আসা প্রয়োজন। তা না হলে দেশটি হয়তো তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। তবে এখনো সম্ভাবনা আছে ইসলামাবাদ (Islamabad) হয়তো এমন একটি বাজে পরিস্থিতি এড়াতে পারবে।
অর্থনীতিবিদ গেরউইন বেল (Gerwin Bell) বলেন, ‘আমরা মনে করি না যে খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা খুব প্রবল। বন্ডে নেওয়া বেসরকারি খাতের ঋণ খুব বেশি না। আর দ্বিপক্ষীয় যেসব ঋণ রয়েছে, তার ঋণদাতারা এখন পর্যন্ত ঋণ নবায়ন করতে আগ্রহী।’ তিনি মনে করেন, চীন এবং উপসাগরীয় দেশগুলো পাকিস্তানকে ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখতে চায় না। পরবর্তী অর্থবছরে পাকিস্তানের ৩ হাজার ৫০০ থেকে, ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার দরকার হবে। ফেব্রুয়ারিতে তারা বলেছিল যে আগামী কয়েক বছরে সরকারি রাজস্বের অর্ধেক অর্থই খরচ করতে হবে ঋণের সুদ পরিশোধে। যদিও এর ফলে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও রাজনৈতিক অসন্তোষ আরও বাড়বে। কিন্তু এ ছাড়া অন্য উপায় ও নেই পাকিস্তানের হাতে।
পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক বলছে গুরুতর অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়ন সঙ্কটের মুখে পাকিস্তান। এটি এমন এক পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান সরকারের পক্ষে কি অর্থনীতিতে কোন পরিবর্তন আনা সম্ভব?
আপনাদের কি মনে হয়, পাকিস্তান (Pakistan) কি এই অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। ব্লগটি ভালো লাগলে লাইক দিন, সাবস্ক্রাইব করুন এবং বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন।