প্রকল্পের নামে জনগণের টাকা লুট! | Orion Group | Business Mania
বাংলাদেশের কর্পোরেট জগতে কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে, কখনো তাদের সাফল্যের জন্য, কখনো তাদের ব্যবসায়িক কৌশলের জন্য। Orion Group ঠিক তেমনই একটি নাম।
ফার্মাসিউটিক্যালস (Pharmaceuticals) থেকে শুরু করে পাওয়ার প্ল্যান্ট (Power Plant), অবকাঠামো নির্মাণ থেকে বিনোদন খাত Orion Group তাদের ব্যবসা বিস্তৃত করেছে বিভিন্ন সেক্টরে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠান এত দ্রুত এত বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হলো? সরকারি প্রকল্প থেকে শুরু করে ব্যক্তিমালিকানাধীন বিনিয়োগ, তাদের সম্প্রসারণের পেছনের বাস্তব চিত্রটা কেমন?
একদিকে তারা দেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, অন্যদিকে তাদের বিভিন্ন প্রকল্প, সরকারি সংযোগ ও ব্যবসায়িক প্রসারের ধরন নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে। বিশেষ করে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, সরকারি প্রকল্পে অংশগ্রহণ এবং ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় তাদের অবস্থান নিয়ে নানান বিতর্ক রয়েছে। Orion Group কি শুধুই দক্ষ ব্যবস্থাপনার ফল, নাকি এখানে অন্য কোনো ব্যবসায়িক প্রভাব কাজ করেছে?
আজকের আলোচনায় আমরা জানবো Orion Group এর উত্থান, তাদের ব্যবসায়িক কৌশল, বাজারে তাদের অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। তাহলে, চলুন শুরু করা যাক!
বাংলাদেশের শিল্প খাতে ওরিয়ন গ্রুপ একটি সুপরিচিত নাম, যা বিভিন্ন সেক্টরে তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাদের এই সফলতার পেছনে রয়েছে এক ইতিহাস, যা প্রতিষ্ঠানটির উত্থান, সম্প্রসারণ এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ (Challenge) মোকাবেলার গল্প বলে।
ওরিয়ন গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৫ সালে, যখন মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম ওরিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে এটি একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে, ১৯৯৩ সালে, ওরিয়ন গ্রুপ রাষ্ট্রায়ত্ত কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড অধিগ্রহণ করে, যা ‘তিব্বত’ ব্র্যান্ডের প্রসাধনী ও সৌন্দর্য পণ্য উৎপাদনের জন্য পরিচিত। এই অধিগ্রহণের মাধ্যমে ওরিয়ন গ্রুপ কসমেটিক্স (Cosmetics) ও টয়লেট্রিজ (Toiletries) সেক্টরে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে।
ফার্মাসিউটিক্যালস এবং কসমেটিক্স সেক্টরে সফলতার পর, ওরিয়ন গ্রুপ তাদের ব্যবসা বিভিন্ন খাতে সম্প্রসারণ করে। তাদের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষি, আতিথেয়তা, টেক্সটাইল (Textile), এবং বিমান পরিচালনা। বিশেষ করে, অবকাঠামো উন্নয়নে ওরিয়ন গ্রুপের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তারা মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণ করে, ঢাকার যানজট নিরসনে কিছুটা হলেও ভূমিকা পালন করে, যদিও না ঢাকার যানজট মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। এছাড়া, তারা সিটি সেন্টার ঢাকা নির্মাণ করে, যা দেশের সর্বোচ্চ ভবন হিসেবে পরিচিত।
পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতে, ওরিয়ন গ্রুপ উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করে। ২০১১ সালে, তারা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাথে তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা খুলনা, চট্টগ্রাম এবং মুন্সীগঞ্জে স্থাপিত হওয়ার কথা ছিল।
তবে, ওরিয়ন গ্রুপের ইতিহাস শুধুমাত্র সাফল্যের গল্প নয়। তাদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ (Challenge) এবং বিতর্কের মুখোমুখিও হতে হয়েছে। ২০০৭ সালে, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান (Chairman) মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং তাকে বিভিন্ন মামলায় শাস্তি প্রদান করা হয়। এছাড়া, ওরিয়ন গ্রুপের বিভিন্ন প্রকল্প এবং কার্যক্রম নিয়ে সময়ে সময়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে, ওরিয়ন গ্রুপ তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা বাংলাদেশে ক্রিসপি ক্রিম এবং ফিশ অ্যান্ড কো. রেস্টুরেন্টের ফ্র্যাঞ্চাইজি (Franchise) নিয়ে এসেছে, যা দেশের খাদ্য ও আতিথেয়তা খাতে তাদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করে। এছাড়া, তারা এলপিজি প্ল্যান্ট স্থাপনের মতো প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে, যা দেশের জ্বালানি খাতে তাদের অবদানকে আরও সুদৃঢ় করেছে।
ওরিয়ন গ্রুপের ইতিহাস একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে বিভিন্ন খাতে সফলতা অর্জন করতে পারে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যেতে পারে তার একটি উদাহরণ। তাদের এই যাত্রা বাংলাদেশের কর্পোরেট জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে দক্ষ ও অভিজ্ঞ পরিচালনা পর্ষদ, যারা প্রতিষ্ঠানটির কৌশলগত দিকনির্দেশনা ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে। নিচে ওরিয়ন গ্রুপের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করা হলো
মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম ওরিয়ন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। তার নেতৃত্বে, ওরিয়ন গ্রুপ ফার্মাসিউটিক্যালস, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, রিয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন খাতে সফলভাবে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। তিনি মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার এবং সিটি সেন্টার ঢাকার মতো মেগা প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া, তিনি তেজগাঁও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের সাবেক সভাপতি।
সালমান ওবায়দুল করিম ওরিয়ন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিমের পুত্র।
২০০৫ সালে তিনি ওরিয়ন গ্রুপে যোগদান করেন এবং প্রতিষ্ঠানটির পাওয়ার সেক্টর, রিয়েল এস্টেট, কনস্ট্রাকশন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং রেস্টুরেন্ট চেইন ইউনিটের তত্ত্বাবধান করছেন। তার নেতৃত্বে, ওরিয়ন গ্রুপ ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ ৩০০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ প্রকল্পে জড়িত হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে প্রতিষ্ঠানটিকে অন্যতম নেতৃস্থানীয় অবস্থানে নিয়ে গেছে।
তিনি ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেড, সিটি সেন্টার, ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট লিমিটেড, ডাচ বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড, ওরিয়ন হোল্ডিংস লিমিটেড এবং জাফলং টি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জারিন করিম ওরিয়ন গ্রুপের একজন পরিচালক এবং চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিমের স্ত্রী। তিনি ওরিয়ন ফার্মা লিমিটেডের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
ওরিয়ন গ্রুপ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত, তবে কার্যক্রম নিয়ে সময়ে সময়ে বিভিন্ন বিতর্ক ও আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
২০২৪ সালের আগস্টে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ওরিয়ন গ্রুপসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধারদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে। ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিমের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বড় বড় প্রকল্পে কাজ করার সময় এসব অভিযোগ ওঠে।
রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত বহুতল ভবন সিটি সেন্টারের মালিকানা ও শেয়ার সংক্রান্ত জটিলতায় ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। বেলহাসা একুয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি সিটি সেন্টারের ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা দাবি করে এবং অভিযোগ করে যে, ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান জালিয়াতির মাধ্যমে সম্পত্তি দখল করেছেন। এ বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা চলমান রয়েছে।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম এবং তার পরিবারের সদস্যদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তের অংশ হিসেবে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের বিরুদ্ধে ৫০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা দায়ের করে ওরিয়ন গ্রুপ। ওরিয়ন গ্রুপের অভিযোগ ছিল যে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও মানহানিকর সংবাদ প্রচার করেছে, যা তাদের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। ওরিয়ন গ্রুপের বিবৃতিতে বলা হয়, তাদের কোনো কোম্পানিতে বহিরাগত রাজনৈতিক মালিকানা নেই এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
ডিসেম্বরে, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ওরিয়ন গ্রুপের দুটি কোম্পানির শেয়ারদরে কারসাজির অভিযোগে কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের জরিমানা আরোপ করে। ওরিয়ন ইনফিউশন এবং ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারদরে কারসাজির দায়ে বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ এবাদুল করিমকে ১৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া, অন্যান্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানা আরোপ করা হয়।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো ওরিয়ন গ্রুপের কার্যক্রম নিয়ে সময়ে সময়ে বিতর্ক ও আলোচনার সৃষ্টি করেছে। তবে, প্রতিষ্ঠানটি তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন দাবি করে এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টা করছে।
ওরিয়ন গ্রুপ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও, কর ফাঁকি, শেয়ারবাজার কারসাজি, রাজনৈতিক সংযোগ ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
একদিকে, ওরিয়ন গ্রুপের মতো বিশাল কর্পোরেশন দেশের শিল্প ও কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে তাদের বিরুদ্ধে থাকা বিতর্কগুলো সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে, এই উন্নতি কি শুধুই পরিশ্রমের ফল, নাকি এর পেছনে রয়েছে বিশেষ সুবিধা ও রাজনৈতিক সংযোগ? সময়ই বলে দেবে, ওরিয়ন গ্রুপ ভবিষ্যতে কীভাবে তাদের ইমেজ ধরে রাখবে এবং নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে।
ওরিয়ন গ্রুপ সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়? তারা কি দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে, নাকি বিতর্কগুলো সত্যিই চিন্তার বিষয়? কমেন্টে আপনার মতামত জানাবেন!