৩০ লক্ষ মানুষ সর্বশ্বান্ত যে নারীর কারনে
ওয়ান কয়েন স্ক্যাম
যদি আপনাকে বলা হয় একুশ শতকের একটি উল্লেখযোগ্য স্ক্যামের কথা বলতে, কি বলবেন বলে ভাবছেন? শেয়ার মার্কেট স্ক্যাম এর কথা! শেয়ার মার্কেট স্ক্যামের ব্যাপারে তো আমরা অনেকেই জানি। তবে, তথ্য প্রযুক্তির এই অগ্রগতির যুগে অনলাইন প্রতারনাও যে পিছিয়ে নেই তা ভুলে গেলে কিন্তু একদম চলবে না। ডিজিটাল এই যুগে যেখানে গোটা বিশ্বের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন নিয়ে সেখানে এই জাঁকজমকপূর্ণ ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড এর অন্তরালেই রয়েছে, এক রহস্যময় আন্ডারওয়ার্ল্ড। আজকের ব্লগে আমরা আলোচনা করবো সেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে ধূর্ত ও অধরা স্ক্যামের জগৎ “ওয়ান কয়েন স্ক্যাম ”নিয়ে যা গোটা বিশ্বে আলোড়ণ সৃষ্টি করেছিল।
ক্রিপ্টোকারেন্সি স্ক্যামের সূচনা হয় ২০১৪ সালে যখন Dr. রুজা ইগনাতোভা নামের একজন ৩৬ বছর বয়সী বুলগেরীয়ান নারী ইন্টারনেটে একটি ঘোষনা দেন যেখানে বলা হয়েছিল, “We will kill bitcoin, বিটকয়েনের কোন ফিউচার নেই। কারণ আমরা যেই জিনিসটি নিয়ে এসেছি তা সবসময়ের জন্য বিটকয়েনের চাহিদাকে শেষ করে দিবে”। আর এই ঘোষনার ফলেই জন্ম হয় “ওয়ান কয়েন” এর। Dr. রুজা ইগনাতোভা মানুষকে এমনভাবে স্বপ্ন দেখায় যে, কেবল মাত্র ওয়ান কয়েনের মাধ্যমেই তাদের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব। আর তার এসব চাটুকারি কথার ফাঁদে পা দেয়, ১ জন কিংবা ১০০০ মানুষ নয় বরং গোটা বিশ্বের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কি এমন স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন Dr. রুজা ইগনাতোভা যে এত মানুষ তার দেখানো পথে চলে আজ সর্বহারা?
ধরূন, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ইন্টারনেট ঘাটতে ঘাটতে আপনার কম্পিউটারের জন্য একটি মাউস পছন্দ হল, এবং আপনি সেটি কেনার কথা ভাবলেন, অথচ আপনার কাছে তেমন ক্যাশ নেই আর এই কারণে আপনার মন ও কিছুটা খারাপ। এমন অবস্থায় আপনাকে সাহায্য করতে পারে যেই জিনিসটা, সেটি হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সি। ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে কিন্তু আপনার কাছে ক্যাশ না থাকা স্বত্তেও আপনি অনলাইন থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারবেন।
এখন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগছে না কি এই ক্রিপ্টোকারেন্সি? কিভাবেই বা আপনার কাছে কোন রকমের ক্যাশ না থাকার পরেও, আপনি অনলাইন থেকে আপনার পছন্দের জিনিসটি কিনতে পারবেন এটি ব্যাবহার করে?
চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক, ক্রিপ্টোকারেন্সি কি? ক্রিপ্টোকারেন্সিকে(Crypto Currency) বলা হয় গুপ্তমুদ্রা বা লুকায়িত মুদ্রা অর্থ্যাৎ এর অস্তিত্ব কেবল ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডেই বিদ্যমান। এই মুদ্রা ব্যাবহার করে যেকোন ধরণের লেনদেন শুধুমাত্র অনলাইনেই সম্ভব। ২০০৯ সালে বিট কয়েন যাত্রা শুরু করে যা এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলোর মধ্যে একটি।
এইতো গেল ক্রিপ্টোকারেন্সি পরিচিতি,এবার চলুন আবার নজর দেওয়া যাক ক্রিপ্টোকারেন্সি স্ক্যামের দিকে। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাস, Dr. রুজা ইগনাতোভা ইন্টারনেটে একটি ঘোষনা দেন যেই ঘোষনা বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার মানুষকে ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। তিনি নিজেকে একজন দূরদর্শী অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে সকলের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি ওয়ান কয়েনকে ক্রিপ্টোকারেন্সির জগতে একটি নতুন বিষ্ময় হিসেবে দাবি করেন। তিনি বলেন যে, ওয়ান কয়েনের রয়েছে ১২০ বিলিয়ন কয়েনের বিশাল সরবারহ যা এর স্থিতিশীলতা এবং বৃদ্ধি নিশ্চিত করবে এবং মানুষদের বিনিয়োগে উৎসাহী করতে তিনি বলেন, ওয়ান কয়েন খুব শীঘ্রই পাবলিক এক্সচেন্জে তালিকাভুক্ত হবে এবং বিশ্বব্যাপী সকলের দ্বারা গৃহীত হবে। প্রাথমিকভাবে এ সকল কথা বলে মানুষের গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করলেও তার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো ছিল আরও ধূর্ত।
ওয়ান কয়েনের সদস্য হওয়ার পদ্ধতিটা ছিল খুবই সাধারন। সদস্য হওয়ার জন্য ব্যাক্তিকে ওয়ান কয়েনের এডুকেশনাল প্যাকেজগুলো কিনতে হবে এবং এটার বদলে সে একটি টোকেন পাবে এবং ঐ টোকেন ব্যাবহার করে তিনি ওয়ান কয়েন মাইন অর্জন করতে পারবে যার বাজার মুল্য পরবর্তীতে আকাশচুম্বী হবে। এসব এডুকেশনাল প্যাকেজগুলো এই বলে বিক্রি করা হতো যে, এগুলো ক্রেতাদের ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ফাইন্যান্স সম্পর্কে ধারণা প্রদান করবে। কিন্তু এই এডুকেশনাল প্যাকেজগুলোর প্রতি ক্রেতাদের তেমন কোন আগ্রহই ছিলো না তারা বুঝতে পারছিল যে এগুলো কোন কাজেরই ই না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এসব মানুষগুলো যখন জানতোই, তাও তারা কেন এখানে ইনভেস্ট করছিল? এটার উত্তর হচ্ছে, ওয়ান কয়েন এবং ওয়ান কয়েনের মাইনিং এর কারনে এছাড়াও মাল্টি লেভেল মার্কেটিং সিস্টেমের বা MLM পদ্ধতির সাহায্যে নতুন সদস্য এড করা এবং এর ভিত্তিতে কমিশন অর্জন করার ব্যাবস্থা ছিল যা ছিল সবাইকে আকৃষ্ট করে রাখার আরেকটি কৌশল। ওয়ান কয়েনের সদস্যরা হতে পারতো এক্সক্লুসিভ কমিউনিটি এর সদস্য যেখানে তারা বিভিন্ন সাকসেসফুল মানুষের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেত আর এই এক্সক্লুসিভ লাইফস্টাইল পেতে সাধারণ মানুষরা এই এডুকেশনাল প্যাকেজগুলো কিনতো। এভাবে তারা প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে তাদের সদস্য বানাতে সক্ষম হয়।
এখন কি ভাবছেন? কেন কারো সন্দেহ হলো না তাদের উপর? তাই না! এর কারণ হচ্ছে, সবাই জানতো যে, তারা এডুকেশনাল প্যাকেজগুলো কেনার মাধ্যমে ক্রিপ্টোকারেন্সি অর্জন করছে এবং এই ক্রিপ্টোকারেন্সির রয়েছে অটো মাইনিং ফিচার অর্থ্যাৎ, একবার ইনভেস্ট করলেই সবসময়ের জন্য টাকা বাড়তেই থাকবে। এছাড়া Dr. রুজা বিভিন্ন ইকোনোমিক সম্মেলনসহ অসংখ্য ডিগ্রির কপি এমনকি বিখ্যাত ফোবর্স ম্যাগাজিনের প্রথম পাতায় তার ছবি ও দেখিয়েছিল। যার ফলে সকলেই তাকে বিশ্বাস করে এবং ইনভেস্ট করতে থাকে। অবাক করার থেকে শপিং করার জন্য শুধু ওয়ান কয়েন দিলেই হতো না এর সাথে সাথে নরমাল কারেন্সিও দেওয়া লাগতো। প্রতিদিনের একটি নির্দিষ্ট সেলিং লিমিট থাকতো এবং কোন ইনভেস্টর তার ইচ্ছামতো তার কয়েন বিক্রি করতে পারতো না। ভেবে দেখলেন ! কি অভিনব ভাবে সাজিয়েছিল তারা স্কামটি।
এখন কথা হচ্ছে, সকল ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্লক চেইন টেকনোলজি দ্বারা আবদ্ধ। যার ফলে এটির ট্রানজেকশন এর ডিটেইলস অন্য কেউ জানতে পারে না এবং এটার নিয়ন্ত্রণ কোন নির্দিষ্ট মানুষের হাতে নেই, এই ব্লক চেইনের পার্টগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন কম্পিউটারের মধ্যে। কিন্তু ওয়ান কয়েনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ছিল আলাদা, ওয়ান কয়েনের নেই কোন ব্লক চেইন। এটি সম্পূর্ণভাবে তৈরি করা হয়েছে এসকিউএল( SQL) সার্ভারের উপর ভিত্তি করে, এবং এটি নিয়ন্ত্রণ করছিল ওয়ান কয়েন টিম।
২০১৬ সালে Bjorn Bjercke ( বিয়র্ন বিয়র্কা ) নামের একজন ব্লক চেইন ডেভেলপারকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ওয়ান কয়েন এর ব্লকচেইন টেকনোলজি ডেভেলপ করার জন্য । কিন্তু Bjorn Bjercke( বিয়র্ন বিয়র্কা ) এই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরবর্তীতে তিনি জানান যে, ওয়ান কয়েনের কোন ব্লক চেইন ছিলো না। এটি পরিচালনা করা হতো SQL সার্ভারের সাহায্যে।এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্লকচেইন টেকনোলজি যদি না ই থাকে তবে এই কয়েনের মাইনিং হতো কিভাবে? এর উত্তর হচ্ছে, SQL সার্ভারে কম্পিউটার কোডিং এর মাধ্যমে করা হতো মাইনিং।
২০১৬ সালে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া ওয়ান কয়েনের উপর তদন্ত শুরু করে এবং এর পর বেরিয়ে আসে একে একে সব সত্য। তদন্ত কমিটি জনসাধারণকে সচেতন করতে শুরু করে এই বানোয়াটদের ফাঁদে পা দেওয়া থেকে।
ওয়ান কয়েনের রয়েছে ব্লক চেইন মাইনিং এবং লেনদেনের প্রমানের অভাব, ওয়ান কয়েনের সাথে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি Dr. রুজা সহ আরও অনেকেরই রয়েছে নানাধরনের আইনি জটিলতা। ওয়ান কয়েনের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে কতৃপক্ষ বিভিন্ন ধরনের অসাধু উপায় এবং ভুয়া ডকুমেন্টস ব্যাবহার করেছে। এমন আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে এই তদন্তের ফলে।
২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে পর্তুগালে একটি অনুষ্ঠানের ঘোষনা দেওয়া হয় কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে Dr. রুজা আসেন না এমনকি এরপর থেকে তাকে আর কোথাও দেখা যায় নি।যদিও পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে wire fraud, securities fraud, এবং money laundering এর অভিযোগ আনে কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ জানেনা তিনি কোথায় আছেন। ক্রিপ্টোকুইন খ্যাত Dr. রুজা নিখোঁজ হওয়ার পর তার ভাই কন্সটানটিন ইগনাতোভা ওয়ান কয়েনের দায়িত্ব নেন। ২০১৯ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বেশ কয়েকটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বর্তমানে তিনি প্রসিকিউটরদের সাক্ষী হিসেবে সহযোগিতা করছেন।
আচ্ছা, ওয়ান কয়েন স্ক্যামের এই ঘটনা শুনে আপনাদের কি মনে হয়? কোথায় হারিয়ে গেল রুজা ইগনাতোভা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি সামরিক শক্তি সম্পন্ন দেশ কেন ই বা তার কোন খোঁজে পাচ্ছে না? বিশ্বের সকল শক্তিশালী পুলিশ ফোর্সরা তার নিখোঁজ হওয়ার ছয় বছরেও তাকে কোথাও খুঁজে পেলনা! আসলে তিনি কি জীবিত আছেন এখনও, নাকি তিনি মৃত? সেই প্রশ্ন না হয় তোলা থাকল ভবিষ্যতের কোন খবরের পাতায়। সে পর্যন্ত ভাল থাকুন আর নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করে ফেলুন